বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় নদ-নদীর পানি বাড়ছে। তিস্তা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি পাব্লিত করেছে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের অনেক অঞ্চল। এই আকস্মিক বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন দুই জেলার অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে যে লালমনিরহাটে পানিবন্দী হয়েছে ১৫ হাজার পরিবার; আর কুড়িগ্রামে অন্তত ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, আরো তিন থেকে চার দিন পানি বাড়বে। বাংলাদেশ এবং ভারতে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে এই আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে।
বিপদ সীমার উপর দিয়ে বইছে তিস্তা
উজানের পাহাড়ি ঢলে বাংলাদেশর তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নদী এখন বিপদ সীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে, লালমনিরহাটের ১০ গ্রামের ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
শুক্রবার (১৪ জুলাই) সকাল ৬টায় বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প, তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার, যা স্বাভাবিক জলের স্তর ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটারের চেয়ে ৪০ সেন্টিমিটার বেশি।
তিস্তা ব্যারাজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, বৃহস্পতিবার দিবাগত গভীর রাত থেকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। শুক্রবার ও শনিবার বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা, ধরলা, বুড়ি তিস্তা ও সানিয়াজান নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলাসহ জেলার তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যা দেখা দিয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) ভোর থেকে নদীগুলোর পানি বাড়তে শুরু করে। হাতীবান্ধায় অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজের দোয়ানী পয়েন্টে বিকালে বিপদ সীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে থাকে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, তিস্তাপাড়ের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রবল বৃষ্টিপাতের করণে ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের অধিকাংশ গেট খুলে দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছেন। প্রচণ্ড গতিতে পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে।পানির গতি নিয়ন্ত্রণ করতে তিস্তা ব্যারাজের অধিকাংশ গেট খুলে দেয়া হয়েছে।
তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায়, পাটগ্রামে অবস্থিত আঙ্গরপোতা ও দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, সির্ন্দুনা, পাটিকাপাড়া ও ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নের চর এলাকার ১০ গ্রামের ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
এছাড়া কয়েক হাজার একর আমন ধানের বীজতলাসহ অনেক ফসলি জমি ডবে গেছে। ইতোমধ্যে চর এলাকাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। চর এলাকার মানুষ ও অনেক পানিবন্দী পরিবার অভিযোগ করেন যে তারা দুই দিন ধরে পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। এখন পর্যন্ত তারা কোনো ত্রাণ সামগ্রী পাননি। কেউ তাদের খোঁজও করেনি।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা বলেন, “তিস্তার পানি বিপদ সীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাই, তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অন্তত দুই দিন তিস্তার পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হবে।”
কুড়িগ্রামে ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী
এদিকে, কুড়িগ্রাম জেলার দুধকুমার নদের পানি বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) থেকে ব্যাপক হারে বাড়তে শুরু করেছে। এর আগেই বড়ছিলো নদ-নদীর পানি। ফলে নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলার প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। শুক্রবার (১৪ জুলাই) দুপুর দেড়টার দিকে কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার পোড়ারচর গ্রামের বাসিন্দা শাপলা জানান, সকালে ঘরের মেঝে তলিয়ে গেছে, ফলে সব জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলতে হয়েছে।
পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ ভগবতীপুর গ্রামের নার্গিস নামের আরেক নারী বলেন, “চার দিন থেকে পানিবন্দী হয়ে আছি। কেউ খোঁজখবর নেয় নি। ঘরে পানি, তাই পাশের উঁচু বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আছি। এই গ্রামে প্রায় ৪৫/৫০টি বাড়িতে পানি উঠেছে।”
নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের চর কাফনা গ্রামের নুর বখত জানান,“পানির তোড় বেড়েছে। নিচু এলাকার বাড়িঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। লোকজন গবাদিপশু নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।” এই গ্রামের নাজমা জানান, চারদিকে পানি, ঠিকমতো রান্নাবান্না করা যাচ্ছেনা।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) শুক্রবার দুপুর ৩টার রিডিং অনুযায়ী, দুধকুমার নদের পানি ৫৪ সেন্টিমিটার, ধরলা নদীর পানি ২১ সেন্টিমিটার বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। তবে, তিস্তা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে বিপদ সীমার ২০ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারীতে বিপদ সীমার ৩৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যেভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে এসব নদীর পানিও বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে যে কোনো সময়।
এদিকে, দুধকুমার নদের পানি বৃদ্ধির ফলে সড়ক তলিয়ে গিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। ফলে অন্তত ১০ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, এই পানি বৃদ্ধি অবস্থা ৩-৪দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তিনি জানান, নাগেশ্বরী উপজেলায় একটি সড়ক সংস্কারের কাজ করেছে পাউবো। সেটির দুটি অংশ প্লাবিত হয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ৬৫ টন চাল উপজেলাগুলোতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া, ৫৮৫ টন চাল, ১০ লাখ টাকা ও ১ হাজার ৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার মজুদ রয়েছে।