অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: কবির দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রবাসের নানা দিক


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি একজন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি একজন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক ছিলেন।

বাইশে শ্রাবণ – রবীন্দ্রনাথ পাড়ি দিয়েছিলেন চির অজানার দেশে। এই দিনটিতে ভয়েস অফ আমেরিকা ফিরে দেখল তাঁর মতো এক চির পথিকের যুক্তরাষ্ট্রে অতিবাহিত সময়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী।

আজকের যুগের ভাষায় যাকে ওয়ার্ল্ড ট্যুর বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তার একজন পথিকৃত বলা যেতে পারে। তাঁর আগে পৃথিবীর কোনো কবি বা সাহিত্যিক বা খ্যাতনামা ব্যক্তি এভাবে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত মহাদেশে নিজের কাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াননি, এমন সমাদরও পাননি কেউ এত দেশের মানুষের থেকে। কবির ভ্রমণের মানচিত্র থেকে বাদ যায়নি যুক্তরাষ্ট্রও। যুক্তরাজ্য বাদ দিলে যুক্তরাষ্ট্রেই তিনি থেকেছেন সবচেয়ে বেশি অন্য কোনো দেশের থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি মোট চারবার সফর করেছেন, প্রথম সেখানে যান ১৯১২ সালের মে মাসে, তখন তাঁর বয়স সদ্য পঞ্চাশ। আর শেষবার ১৯৩০-এর অক্টোবরে, কবির বয়স তখন সত্তর ছুঁই ছুঁই। প্রত্যেক সফরেই তাঁর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয় সেগুলি যেমন তাঁর শিল্প, সাহিত্য ও কর্মজীবনে ছাপ ফেলে তেমনি আবার কিছু অভিজ্ঞতা সেই সময় ও তাঁর জীবন সম্পর্কে মজার তথ্য তুলে ধরে।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সিদ্ধান্ত আচমকাই। লন্ডনে তখন তাঁর কবিতা সদ্য সমাদৃত হচ্ছে। আইরিশ কবি ইয়েটসের প্রণোদনায় তাঁর কবিতার অনুবাদ ‘সঙ্গস অফারিং’ ছাপার কাজ চলছে এমন সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন যুক্তরাজ্য থেকে। যুক্তরাষ্ট্র তাঁর কাছে অপরিচিত ছিল না। সশরীরে না গেলেও, এর আগেই তিনি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাঠান কৃষি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য। রথীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়েই তিনি ১৯১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছন। এবং প্রায় মাস ছয়েক থাকেন। এই সফরের পরিকল্পনা ছিল তাঁর হঠাতই। যুক্তরাজ্যে তাঁর লেখালিখি ঘিরে যে উন্মাদনা ও উচ্ছাস তার থেকে মুক্তি পেয়ে নিরিবিলিতে কাটানোর সংকল্প ছিল তাঁর, এ ছাড়া অ্যালোপাথির শল্যচিকিৎসকদের ছুরি-কাঁচির হাত থেকে বাঁচতে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করাবেন তখন যুক্তরাষ্ট্রে বিখ্যাত হোমিও্যাথির এক ডাক্তারকে দিয়ে – এই কারণও ছিল। ইলিনয়-এর আর্বানাতে গিয়ে তিনি থাকতে শুরু করেন। যদিও তাঁর যুক্তরাজ্যের সাফল্য পিছু ছাড়েনি, ডাক পড়ে উইসকন্সিন ও আইওয়া-তে বক্তৃতা করার। এবং প্রবন্ধ লেখার।

রবীন্দ্রনাথের শেষ যুক্তরাষ্ট্র সফর উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে যে কারণে তা হল এখানে তাঁর অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হয় ও তাঁদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। রবীন্দ্রনাথ – আইনস্টাইন সাক্ষাৎকারের মতো ঘটনা বিরল। সত্তরের কাছের এক প্রকৃত আন্তর্জাতিক ব্যক্তি হিসেবে এ সফরে কবির মোলাকাত হয়েছে বহু বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে, উইল ডুরান্ট থেকে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হুভার – তালিকা দীর্ঘ, কিন্তু বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ দুই মনীষী, একজন কবি ও আরেকজন বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎ ঐতিহাসিক ঘটনা বটেই। এ নিয়ে নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস খবর করে ‘আ ম্যাথামেটিশিয়ান অ্যান্ড আ মিস্টিক মিট অ্যাট ম্যানহ্যাটান’। রবীন্দ্রনাথ এর কিছুদিন আগেই বার্লিন-এ আইনস্টাইনের বাড়ি যান ও তাঁদের কথোপকথন রেকর্ড করা হয় যা ‘রিলিজয়ন অফ ম্যান’ বইয়ে সংকলিত হয়েছিল। এই বার্লিনের কথোপকথনের পর আইন্সটাইনের সঙ্গে কবির যুক্তরাষ্ট্রে সাক্ষাৎ জন মানসে কৌতুহল সৃষ্টি করেছিল তা সে সময়ের খবরের কাগজের বহু রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট – এখনকার ভাষায় এই দু’জনের সাক্ষাৎ ঘিরে রীতিমতো ‘মিডিয়া সেনসেশন’ তৈরি হয়েছিল।

তিনি নিউ ইয়র্ক ও শিকাগোতেও যান। তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে এই শিকাগোতেই ১৯১৩ সালে। আর্মোরি একজিবিশন দেখার সুযোগ হয় তাঁর।

আর্মোরি একজিবিশন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা, ইউরোপ থেকে প্রথম মডার্ন আর্ট এসে পৌঁছয় এবং মাতিস, পিকাসোর মতো আধুনিক শিল্পীর ছবি প্রথম অ্যাটলান্টিকের পশ্চিম পারের মানুষ দেখতে পান। এই প্রদর্শনী রবীন্দ্রনাথ দেখতে গিয়েছিলেন এবং তাঁর আধুনিক ইওরোপীয় চিত্রকলার সঙ্গে প্রথম নাক ঘষাঘষি বলা যায়। এই প্রদর্শনী তাঁকে ভাবিয়েছিল, দেড় দশক পর যখন তিনি ছবি আঁকাকে তাঁর সৃষ্টির আরেক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে গ্রহন করেন, তখন দেখা যায় ওরিয়েন্তাল আর্ট এমনকি তাঁর শান্তিনিকেতনের বেঙ্গল স্কুল নয় তাঁর চিত্র ভাষায় প্রভাব ইউরোপীয় আধুনিক চিত্রের। রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্পী হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রদর্শনীর অবদান অনস্বীকার্য। চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অনেকটাই জড়িয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সফর। তাঁর শেষ সফরকালে দুটো চিত্র প্রদর্শনী হয়। একটা বস্টন ও আরেকটা নিউ ইয়র্কে। তাঁর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রেই দেখা হয় ভারতীয় শিল্প তাত্ত্বিক ও সমালোচক আনন্দ কুমারস্বামীর। কুমারস্বামী রবীন্দ্রনাথের এই প্রদশর্নী দুটোর ক্যাটালগের ভূমিকাও লেখেন।

আরেকটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল কবির কতগুলো কবিতা নিয়ে একটি পারফম্যান্স করেন বিখ্যাত নৃত্য শিল্পী রুথ সেন্ট ডেনিস। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়েছে, ইতিহাসে যাকে গ্রেট ডিপ্রেশন নামে ডাকা হয়। এই অনুষ্ঠান থেকে যে অর্থ সংগ্রহ হয় তা রবীন্দ্রনাথ চাকুরিহীন ও বেকারদের জন্য তহবিলে দান করেন। এই সফরে তাঁর দ্বিতীয়বারের জন্য দেখা হয় হেলেন কেলারের সঙ্গে।

যুক্তরাষ্ট্রেই হেলেন কেলারের সঙ্গে প্রথমবার দেখা হয় রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় সফরে ১৯২০ সালে। কবি হেলেন কেলারকে তাঁর কবিতা ও গান শোনান। তাঁর ঠোঁটে আঙুল রেখে জন্ম মূক-বধীর ও দৃষ্টিহীন কেলার অনুধাবন করেন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় সফর রবীন্দ্রনাথের অনেকটাই কেটেছে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বক্তৃতা দিয়ে। গোটা যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দিয়ে কবির বক্তৃতা করার উদ্দেশ্য ছিল তাঁর বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহ। সবসময় যে এ-কাজে তিনি সফল হয়েছেন তা নয়, কিন্তু গোটা দেশজুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। হয়েছে কত অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে টানা চারমাস ট্রেনে করে ঘোরেন ও বক্তৃতা দেন। তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদ সব সময় খুব আদৃত হয়েছে এমনও নয়, সমালোচিতও হয়েছেন কম নয়। এশিয়ার এই প্রথম নোবেল পদকপ্রাপ্ত লেখকের বক্তব্য শোনার ও ছাপার জন্য সাংবাদিকদের অত্যাচারও ছিল প্রবল। সাংবাদিকদের হাত থেকে তাঁকে আগলে রাখতে হত, এখনকার যুগে যেমন পাপারাৎজিদের হাত এড়াতে হয়, তেমন পিয়ার্সন বা অন্য ভ্রমণসঙ্গীরা খেয়াল রাখতেন সাংবাদিকরা যাতে তাঁকে বিরক্ত না করে বা বেফাঁস মন্তব্য করতে না উশকানি দেয়। এমনকি গদর বিপ্লবীদের হাতে তাঁর খুন হওয়ার সম্ভাবনার গুজবও রটে তাঁর এই দ্বিতীয় সফরে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর চারটে সফর মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন প্রায় উনিশ মাস, এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর বহুবর্ণীয় বহুপ্রজ সৃষ্টি ও ভাবনার বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ‘মিলাবে, মিলিবে’র। হুইটম্যান তাঁর প্রিয় কবিদের একজন ছিলেন। সেই হুইটম্যানের দেশে বসেই তিনি পেয়েছেন ইংরেজি বই বেরনোর খবর এবং সেই বইয়ের প্রথম আন্তর্জাতিক জনপ্রিয়তার সংবাদ, তাঁকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের উচ্ছাসের বন্যায় ভেসে গেছেন আবার সহ্য করতে হয়েছে জনপ্রিয়তার অত্যাচার। তাঁর শেষ বয়সের প্রিয় মাধ্যম চিত্রকলার বিষয়ে যেমন চোখ খোলে এ-দেশে, তেমনি এখানে বসে এঁকেছেন ছবি। তিনি বারবার সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রচার করে গেছেন এখানে, বর্ণভেদের বিরুদ্ধেও মুখ খুলেছেন তিনি সে সময় দাঁড়িয়ে। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও যুক্তরাষ্ট্রের একটা অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক রয়েই গেছে।

তথ্য সূত্র:

রবীন্দ্রজীবনী - প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

রবিজীবনী - প্রশান্তকুমার পাল

XS
SM
MD
LG