অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

‘তোমার পতাকা যারে দাও’ – ভারতের ত্রিবর্ণ পতাকা ও দেশপ্রেমের ইতিহাস


ভেক্সিলিওলজিস্ট ও পতাকা বিষয়ক গবেষক শেখর চক্রবর্তী
ভেক্সিলিওলজিস্ট ও পতাকা বিষয়ক গবেষক শেখর চক্রবর্তী

ভারতের ইতিহাসে পতাকার উপস্থিতি ৫০০০-৬০০০ বছর আগে থেকেই আছে, যার উদাহরণ হল ভারতের মহাকাব্য রামায়ন, মহাভারত।

ভারতের জাতীয় পতাকার বিবর্তন নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছিল বর্ষীয়ান ভেক্সিলিওলজিস্ট ও পতাকা বিষয়ক গবেষক শেখর চক্রবর্তী-র সঙ্গে। তিনি বলেন,

"ভারতে যখন জাতীয়তাবাদ-এর ভাবনা এল, আমার বুঝতে শিখলাম - তখন প্রথম এই পতাকা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন রাজনারায়ণ বোস১৮৮৮ সালের “লিবারাল” বলে একটি পত্রিকাতে তিনি লেখেন যে,'আমাদের একটি ন্যাশনাল সিম্বল দরকার, এবং সেটি হল পদ্ম ফুল।' কারণ পদ্ম ফুলের পঙ্কিলতায় জন্মের পরে যে শ্বেতশুভ্র ভাবে তার প্রকাশ সে কথা মাথায় রেখে রাজনারায়ণ বাবু একথা বলেছিলেন। কিন্তু সঠিক অর্থে আমাদের এই দেশ ভারতবর্ষের পতাকার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম ভেবেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা।

ভারতের জাতীয় পতাকার প্রথম নির্মানভাবনা ও ভগিনী নিবেদিতা

সঠিক অর্থে ভারতবর্ষের পতাকার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম ভেবেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। ১৯০৪ সালে সিস্টার নিবেদিতা বোধগয়াতে (বর্তমান বিহারে অবস্থিত) যান, সঙ্গে জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও ছিলেন আরও অনেকে। সেখানে সিস্টার নিবেদিতা মুনি দধীচির মূর্তি দেখেন। দধীচির যে আত্মত্যাগের কাহিনী আমরা জানতে পারি যেখানে দেবতা ইন্দ্রের জন্য তিনি তার শরীরের হাড় দান করেছিলেন, সে কাহিনী সিস্টার নিবেদিতাকে অনুপ্রাণিত করে। এবং সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই নিবেদিতা তৈরী করেন একটি পতাকা। আর সেই পতাকাটি এখনও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে “বসু বিজ্ঞান মন্দিরে” রাখা রয়েছে সকলের দেখার জন্য। এক অর্থে, এই পতাকাটিই ভারতের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা প্রথম পতাকা। ২০১২ সালে একটি ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে এটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। আর তারপর এটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দিল্লীর রেস্টোরেশন সংস্থা “ইন্টাক”।

শেখর চক্রবর্তী বলেন, "এসব কিছু বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম মহিলা ফ্ল্যাগ ডিজাইনার হলেন সিস্টার নিবেদিতা । এই পতাকাটি প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৯০৬ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে, যেখানে প্রেসিডেন্ট ছিলেন দাদাভাই নওরোজি। একমাত্র জগদীশ চন্দ্র বসু এই পতাকাটির সমর্থন করেন।"

জাতীয় পতাকার প্রথম ডিজাইনার কুমুদিনী বসু

ইতিহাস থেকে জানা যায়, সেই সময়েই উত্তর কলকাতাবাসী “সঞ্জীবনী” পত্রিকার সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্রের ছেলে সুকুমার মিত্র ও তার বন্ধু শচীন্দ্রনাথ বোস, যিনি ছিলেন “অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটির” সেক্রেটারি, তারা দুজনে মিলে দেখা করেন কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির সঙ্গে আর সে সময়ে কংগ্রসের সব মিটিঙেই থাকত ইউনিয়ন জ্যাকের পতাকা। সুকুমার ও শচীন্দ্রনাথের কথা শুনে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত ও অন্যন্য কংগ্রেসী নেতারা ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট হলে একটি সভার আয়োজন করেন এবং সেখানেই প্রথম ঠিক করা হয় যে ভারতেরও পতাকা তৈরি করা হবে। সেই পতাকার ডিজাইনার ছিলেন সুকুমার মিত্রের বোন কুমুদিনী বসু।

শেখর চক্রবর্তী এই তথ্য বিষয়ে বলেন, "কিন্তু আমরা সাধারণত জানি যে, আমাদের দেশের প্রথম ফ্ল্যাগ যিনি দেখিয়েছিলেন তিনি হলেন 'মাদাম কামা', কিন্তু প্রথম ফ্ল্যাগ ডিজাইনার যদি বলতে হয়, তাহলে তিনি ছিলেন এই কুমুদিনী বসু। তার কোন ছবি পাওয়া যায়নি আজও। ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গের এক বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে, ৭ই অগাস্টে তদানীন্তন “গ্রিয়ার পার্কে” এই পতাকাটি প্রথম উত্তোলিত হয়েছিল, এবং এই পতাকাটিকেই প্রথম সে অর্থে সারা ভারতবর্ষের মান্যতাপ্রাপ্ত পতাকা হিসেবে ধরা যেতে পারে, যা হয়ে ওঠে আমাদের জাতীয়তাবাদের প্রতীক। এবং সেই অধিবেশন বা অনুষ্ঠানেই প্রথম 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি আমাদের “ওয়ার ক্রাই” হিসাবে মান্যতা পায়।"

মাদাম কামা ও ভারতের জাতীয় পতাকা

মাদাম কামা ১৯০৭ সালে ভারতবর্ষ ছেড়ে প্রথমে যান যুক্তরাজ্যে, তারপর প্যারিসে গিয়ে থাকতে শুরু করেন এবং ভারতের প্রবাসী বিপ্লবীদের কাছে তিনিই ছিলেন তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ের জায়গা। আর সেই সময়েই বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো প্যারিসে গিয়েছিলেন বোমা বানানো শেখার জন্য ও আশ্রয় পেয়েছিলেন মাদাম কামার কাছে। তিনি ১৯০৬ সালের বানানো পতাকাটি দেখেছিলেন ও সেই স্মৃতি থেকে হেমচন্দ্র একটি রুমাল আকৃতির পতাকা তৈরী করেন। হেমচন্দ্র কানুনগোর লেখা থেকে জানা যায়, তিনি এই পতাকাটির প্রতীকগুলির ব্যাখ্যা করেছিলেন, যদিও তিনি নিজে তৈরি করেছেন তা বলেননি। তিনি বলেছিলেন, "যারা এই পতাকাটি তৈরি করেছিল, তারা সবাই বর্তমানে আন্দামানের সেলুলার জেলে রয়েছেন।" এই সূত্র ধরেই শেখর চক্রবর্তী ব্যাখ্যা করেন, "তাই সেই সময়ের যারা জেল খাটছিলেন তাদের সম্পর্কে জানলেই আমরা দেখব যে, বীর সাভারকর আমাদের পতাকা ডিজাইন করেননি। কলকাতা ও প্যারিসে বসে দুই দল মানুষ একই ডিজাইনের পতাকা তৈরি করছেন, সেটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। পার্থক্য ছিল কলকাতার ফ্ল্যাগে লেখা ছিল “বন্দে মাতরম” আর প্যারিসের-টায় “বন্দে মাতরং”। আর যেহেতু হেমচন্দ্র নিজে তার স্মৃতি থেকে এই পতাকাটি তৈরি করেছিলেন তাই এই ঘটনাটি ঘটে।"

হেমচন্দ্র কানুনগোর তৈরী করা ফ্ল্যাগই মাদাম কামা জার্মানির স্টুটগার্ট-এ ২২শে অগাস্ট “সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল সোশালিস্ট কংগ্রেসের” অধিবেশনে দেখিয়েছিলেন বা হয়েস্ট করেছিলেন। এই ফ্ল্যাগটি বর্তমানে ভারতের মহারাষ্ট্রের পুনেতে রয়েছে।

এরপর ১৯১১ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রোধ হয় এবং কলকাতা থেকে রাজধানীকে দিল্লিতে সরিয়ে নেওয়া হয়, তারপর থেকেই এই পতাকার ব্যবহার কমে আসতে শুরু করে।

অ্যানি বেসান্ত, জাতীয় পতাকা ও ব্রিটিশ প্রতীক

এরপর ১৯১৬ সালের হোমরুল আন্দোলনের শুরুতে অ্যানি বেসান্ত - বাল গঙ্গাধর তিলক , বি পি ওয়াদিয়া, মহম্মদ জিন্না, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহায়তায় একটি নতুন ফ্ল্যাগের ডিজাইন তৈরি করেন। এই পতাকাটির ওপরের বাঁদিকের অংশে যুক্তরাজ্যের পতাকা রাখা হয়েছে দেখা যায়। এর পিছনে ধারনা ছিল যে, ব্রিটিশদের স্বীকার করে নিয়েই স্বায়ত্বশাসনের অধিকার পাওয়া।

এই পতাকার ডিজাইন নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের ভিতরে চরমপন্থীদের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও গান্ধী ও তার অনুসরণকারীদের কোন বিরুদ্ধ মনোভাব ছিল না। তাই ১৯১৭ সালের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে যেখানে অ্যানি বেসান্ত ছিলেন সভাপতি, তিনি সেখানে এই ফ্ল্যাগটি সর্বসমক্ষে উত্তোলন করেন। এই পতাকাটিতে ৭টি তারা ব্যবহার করা হয়েছিল, যা আমাদের পুরানের সাতজন ঋষি-র কথা মাথায় রেখে। এই পতাকাটিতে সবুজ রং ছিল মুসলমানদের প্রতীক আর লাল রং ছিল হিন্দুত্বের প্রতীক। এবং এই ফ্ল্যাগটি ছিল 'ডাভ-টেল' র স্টাইলে তৈরি।

পিঙ্গালী ভেঙ্কাইয়া ও খারিজ হওয়া জাতীয় পতাকার ডিজাইন

এরপর আসে পিঙ্গালী ভেঙ্কাইয়া-র কথা। তিনি কাজ করতেন সাউথ আফ্রিকা-তে, ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক। হোমরুল লীগ পতাকার যোগ্যতা নিয়ে যখন অনেকেই কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, সেই সময় ১৯১৬ সালে মসলীপত্তম ন্যাশনাল কলেজে তার উদ্যোগে স্থাপিত হল 'ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ মিশন'। পতাকা অনুরাগী পিঙ্গালী ভেঙ্কাইয়া এই সময়েই ৩০টির মতো ডিজাইন নিয়ে তেলেগু ভাষায় প্রকাশ করেন- “ভারতা দেশানিকী ওকা জাতীয় পতাকা ” অর্থাৎ ভারতের জাতীয় পতাকা। কিন্তু এই একটি পতাকাও কংগ্রেসী নেতাদের ও গান্ধিজীর পছন্দ হয়নি। "কিন্তু পিঙ্গালীর এই উদ্যোগ গান্ধীজীকে বুঝিয়ে দেয় যে ভারতবর্ষের পতাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এবং তাই গান্ধীজীর ১৯২১ সালের “ইয়ং ইন্ডিয়া” পত্রিকার লেখায় পাওয়া যায় যে তিনি বলছেন, 'আমাদের জাতীয় পতাকার প্রয়োজন রয়েছে। এরপর পিঙ্গালী গান্ধীজীর পরামর্শ অনুযায়ী ১৯২১ সালে বিজয়ওয়ারা কংগ্রেসের অধিবেশনের আগে ভারতের দুই সম্প্রদায়ের প্রতীক স্বরুপ, লাল ও সবুজ রঙের পতাকা তৈরী করে নিয়ে আসেন। যদিও সেই অধিবেশনে সেই ফ্ল্যাগ হয়েস্ট করা যায়নি কারণ পিঙ্গালীর ডিজাইন তৈরী করতে দেরী হয়েছিল। এরপর গান্ধীজীর পরামর্শ অনুসারে পিঙ্গালী বাকী সম্প্রদায়ের কথা মাথায় রেখে এই পতাকাটিতে লাল, সবুজের সাথে সাদা রং-কেও জুড়ে দেন," জানালেন শেখর চক্রবর্তী।

সময়ের প্রয়োজনে তৈরি ফ্ল্যাগ কমিটি

ইতিহাস অনুযায়ী, সেই সময়েই জলন্ধরের লালা হন্সরাজ, গান্ধীজীকে বলেন এই পতাকাতে আত্মনির্ভরতার প্রতীক হিসেবে চরকাকেও স্থান দেওয়া হোক। গান্ধীজী এই পরামর্শে সম্মতি দেন। এবং সেই পরামর্শ অনুযায়ী পিঙ্গালী ভেঙ্কাইয়া নতুন ডিজাইনে চরকা-কে যোগ করেন। এবং সেই পতাকাটিই ডিসেম্বরের কংগ্রেসের অধিবেশনে ওড়ানো হয়েছিল। ডিজাইনে ছিল ওপরে সাদা, মাঝে সবুজ ও নীচে লাল রং, আর সবকটা রং ছুঁয়ে ওপরে কালো রঙের চরকা। পরে দেখা যায়, এই পতাকাটিকে প্রায় বুলগেরিয়ার ন্যাশনাল ফ্ল্যাগের মতো দেখতে হয়েছে। এবং এই নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই। যদিও এই ফ্ল্যাগ ১৯৩১ পর্যন্ত চলেছিল।

১৯৩১ সালে অকালী দল জানায় যে, তাদের শিখ ধর্মাবলম্বীদের কথা মাথায় রেখে পতাকাতে তাদের স্থান থাকতে হবে, আর সে রং হবে গেরুয়া। কিন্তু তদানিন্তন কংগ্রেসের মন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেন যে, "এইভাবে চলতে থাকলে তবে সব ধর্মাবলম্বীদেরই আমাদের পতাকায় জায়গা দিতে হয়, আর তা হতে পারে না।"

এছাড়াও এই সময়েই অর্থাৎ ১৯৩১-এ অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় “মডার্ন রিভিউ” পত্রিকায় লেখেন যে, "যে পতাকা তৈরী হবে তার সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা করা যাবে না, যারা করবেন তারা হবেন অ্যান্টি ন্যাশনাল এবং ফ্ল্যাগের রং হওয়া উচিত লম্বালম্বি।" এর সঙ্গেই তিনি বলেন চরকার জায়গায় চক্র নিয়ে আসা হোক, যা অগ্রগতির কথা বলে। কিন্তু তার এই পরামর্শ মানা হয়নি।

এমতাবস্থায়, করাচীর কংগ্রেসের অধিবেশনে একটি “ফ্ল্যাগ কমিটি” গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই ফ্ল্যাগ কমিটি এরপর একটি সমীক্ষার আয়োজন করে, যেখানে তিনটি প্রশ্নের ভিত্তিতে পতাকা গঠন করা হবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই তিনটি প্রশ্ন ছিল-

১। জাতীয় পতাকা ডিজাইন সম্পর্কে আপনার প্রদেশের কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন কোন অনুভূতি কি আছে যা কমিটির বিবেচনা করা উচিত ?

২। পতাকাটিকে জনপ্রিয় করার জন্য আপনার কাছে কোন সুনির্দিষ্ট পরামর্শ আছে কি?

৩। বর্তমান প্রচলিত পতাকার ডিজাইনে কোন ত্রুটি আছে কি, যার প্রতি আমাদের নজর দেওয়া উচিত?

এরপর ফ্ল্যাগ কমিটি থেকে তৈরি করা হয় একটি পতাকা যেটি ছিল সম্পূর্ণ গৈরিক একটি পতাকা, সঙ্গে কোনায় একটি চাকা। তা সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল করে দেওয়া হয়। কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি এই সময়ে একটি ফ্ল্যাগ ডিজাইন করে। সেখানে ওপরে গেরুয়া, মাঝে সাদা ও নীচে সবুজ এবং মাঝে চরকা, শুধু সাদার মধ্যে। এটিই ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত কংগ্রেসের পতাকা ও দেশের পতাকা ছিল একই। কংগ্রেসের পতাকাকেই জাতীয় পতাকা হিসেবে ধরে নেওয়া হত।

ভারতের জাতীয় পতাকা ও বি আর আম্বেদকর-এর ভূমিকা

১৯৪৭-এর স্বাধীনতার আগে আরেকটি ফ্ল্যাগ কমিটি তৈরী হয় ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের সভাপতিত্বে জুন মাসে। এই কমিটিতে বি আর আম্বেদকর থেকে সরোজিনী নাইডু এবং আরো অনেকে ছিলেন। সে সময়ে হরিজন কাগজে, ৬ই জুলাই ১৯৪৭-এ, নাগপুরের এস ডি কালেলকর একটি লেখা লেখেন “এ থটফুল সাজেশন” বলে। সেখানে তিনি চক্রের জায়গায় অশোক চক্র ব্যবহার করা যেতে পারে সে কথা বলেন।

১৭ই জুলাই কংগ্রেসের সেই ফ্ল্যাগ কমিটির শেষ মিটিং হয়। এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে সেই মিটিং-এ কংগ্রেস নেতা বি আর আম্বেদকর-ই অশোক চক্রের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। কেননা স্বাধীনতার পরে যখন বি আর আম্বেদকর তার নিজের দল “রিপাবলিক পার্টি” তৈরী করেন সেই ফ্ল্যাগের রং ছিল নীল এবং মাঝে অশোক স্তম্ভ। সেই মিটিং-এর ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন বদ্রুদ্দিন তায়েবজী। তার স্ত্রী সুরাইয়া তায়েব এই ভাবনার কথা মাথায় রেখে একটি ফ্ল্যাগ তৈরী করে ফেলেন। কিন্তু এটা আনুমানিক। এবং সর্বোপরি ১৯৪৭ সালের ২২শে জুলাই-এর অধিবেশনে রাধাকৃষ্ণন এই পতাকা উত্তোলন করেন এবং এই পতাকাকেই ভারতের জাতীয় পতাকার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ভারতের জাতীয় পতাকা ডিজাইন করেছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন-ও

এই সময়েই লর্ড মাউন্টব্যাটেন এসেছিলেন ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে গভর্নর জেনারেল হয়ে, ভারতের স্বাধীনতার চুক্তি স্বাক্ষর করাতে। সে সময়ে ঠিক করা হয়েছিল যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে এই স্বাধীনতা দেওয়া হবে। এই সময়ে মাউন্টব্যাটেনও দুটি পতাকা ডিজাইন করেছিলেন ২৪শে জুন, ফ্ল্যাগ কমিটি গঠনের দুদিনের মধ্যে, একটি ভারতবর্ষের জন্য ও অন্যটি পাকিস্তানের জন্য। দুটিতেই ফ্ল্যাগের বামদিকের কোনায় ছিল যুক্তরাজ্যের পতাকা।

শেখর চক্রবর্তী জানান, "স্বাভাবিকভাবেই মহম্মদ আলি জিন্না এই ফ্ল্যাগ মেনে নেয়নি, কিন্তু গান্ধীজীর এই ফ্ল্যাগ নিয়ে কোন অসুবিধা ছিল না, তা তিনি হরিজন পত্রিকাতে লিখেওছিলেন। পন্ডিত নেহেরু গান্ধীজিকে দেশবাসীর প্রতিক্রিয়া জানান যে, তারা এই ফ্ল্যাগ মেনে নেবে না। এছাড়াও কংগ্রেসের বাকী নেতারাও এই ফ্ল্যাগের বিরোধিতা করেন।"

তথ্যসূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ আনফার্লড থ্রু ফিলাটেলি, লেখক – শেখর চক্রবর্তী

XS
SM
MD
LG