অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

কলকাতা – সিটি অফ জয় আর তার শতাব্দী প্রাচীন পার্সি সম্প্রদায়ের টুকরো ছবি


কলকাতার পার্সি ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টার, ফায়ার টেম্পল, এই জায়গাগুলো পার্সি হিসাবে পরিচিতি তৈরিতে সাহায্য করে।
কলকাতার পার্সি ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টার, ফায়ার টেম্পল, এই জায়গাগুলো পার্সি হিসাবে পরিচিতি তৈরিতে সাহায্য করে।

আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগেও ভারতের পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরে ১৫০০ থেকে ২০০০ পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষের বাস ছিল। কারণ পার্সিদের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক বহু প্রাচীন। যদিও আজ এই সংখ্যাটা মাত্রই ৩৬০ জনে এসে পৌঁছেছে। তাদের মধ্যে ২৩০-এর জন ষাটোর্দ্ধ। ৩১ জনের বয়স ২০-এর নীচে। এবং তরুণ প্রজন্মের বয়স ১৮-র কোঠায় পৌঁছালেই উচ্চশিক্ষা, ভবিষ্যতের কেরিয়ার ইত্যাদির জন্য তারা পাড়ি দিচ্ছেন দেশের অন্য রাজ্যে। উল্লেখ্য, কলকাতার পার্সিদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি। একটা সময়ে কলকাতার শিল্প-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক উন্নতি, খেলাধূলা, শিক্ষাক্ষেত্র, সামাজিক সেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পার্সিদের অবদান যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ। ষাট পেরোনো পার্সি বা তরুণ পার্সিদের কাছেও কলকাতা আসলেই তাদের ‘বাড়ি’, হৃদয়ের খুব কাছে এই ভালবাসার শহর, ‘সিটি অফ জয়’ - কলকাতা।

পার্সিদের ধর্ম জোরায়াস্ট্রিয়ান। ভারতে যারা এসেছেন তারা ইরানের পারস বলে একটি জায়গা থেকে আসেন, তাই ভারতে তাদের পরিচিতি হয় পার্সি নামে। ইরানে যখন আরবদের আক্রমণ হয় ৬৩৩ এডি-তে, দমন-পীড়ন চলতে থাকে, তখন বহু জোরাস্ট্রিয়ান নৌকা নিয়ে ইরান ছেড়ে অন্যান্য দেশে জলপথে পাড়ি দেয়, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ এসে পৌঁছায় ভারতের গুজরাত উপকূলে, তাদের স্বাগত জানান গুজরাতের তৎকালীন রাজা। শর্ত ছিল – তাদের গুজরাতি ভাষা বলতে হবে, গুজরাতি রীতি-নীতি মানতে হবে, গুজরাতি পোশাক পরতে হবে। কলকাতায় তারা আসে সপ্তদশ শতকে চীনের সঙ্গে আফিমের ব্যবসা করতে। জাহাজে করে ব্যবসা হতো তখন। অবশ্য ইরানের সঙ্গে ভারতের জোরাস্ট্রিয়ান সম্প্রদায়ের কোনও সম্পর্ক অবশিষ্ট নেই এখন আর।

অগাস্ট মাসে পার্সি সম্প্রদায়ের নতুন বছর – নওরোজ। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছিল কলকাতার পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে, ইতিহাস খুঁজে দেখার জন্য, তাদের কলকাতার স্মৃতি পড়ার জন্য, এই ছোট্ট সম্প্রদায়টি নিজেদের আগামীকে কীভাবে দেখে এই শহরের বুকে তা জানার জন্য।

ক্যালকাটা জোরোয়াস্ট্রিয়ান কমিউনিটি’স রিলিজিয়াস অ্যান্ড চ্যারিটি ফান্ড-এর সিইও নশির এস. ওয়াডিয়া শহরে ক্রমশ কমতে থাকা পার্সি জনসংখ্যার কারণ হিসাবে তিনটি বিষয়ের কথা বললেন, “পার্সিদের মধ্যে দেরি করে বিয়ে করার প্রবণতা, একটি বা দু’টি সন্তান এবং অবশ্যই তরুণ প্রজন্মের অন্য রাজ্যে চলে যাওয়া, যার ফলে আমরা আমাদের ‘ইয়ুথ’ হারাচ্ছি কলকাতা থেকে। আমাদের সময়ে আমরা হয় চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হতাম বা ব্যাঙ্কার। কিন্তু এখন সবাই স্পেশালাইজেশন খোঁজে। তাই টুয়েলভ-এর পরেই আরও ভালো কিছুর জন্য তারা অন্যত্র পাড়ি দেয়।”

ক্যালকাটা জোরোয়াস্ট্রিয়ান কমিউনিটি’স রিলিজিয়াস অ্যান্ড চ্যারিটি ফান্ড-এর সিইও নশির এস. ওয়াডিয়া
ক্যালকাটা জোরোয়াস্ট্রিয়ান কমিউনিটি’স রিলিজিয়াস অ্যান্ড চ্যারিটি ফান্ড-এর সিইও নশির এস. ওয়াডিয়া

পার্সিদের সঙ্গে বাঙালি বিয়ের ঘটনাও আছে। তবে পার্সিদের রীতি অনুযায়ী কোনও পার্সি পুরুষ যদি কোনও অ-পার্সি মহিলাকে বিয়ে করেন, তাহলে তাদের সন্তানকে পার্সি বলে মান্যতা দেওয়া হয়, নওজোত বলে থ্রেড সেরেমনি পালন করা হয়। কিন্তু কোনও পার্সি মহিলা অ-পার্সি পুরুষকে বিয়ে করলে তাদের সন্তানকে পার্সি বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। তবে ওয়াদিয়া বললেন, “কলকাতা, দিল্লি, জামশেদপুর – এই জায়গাগুলোতে আমরা এইগুলো অত মানি না। পার্সিদের সব ইনস্টিটিউশনে তারা যেতে পারে, শুধু ফায়ার টেম্পল ছাড়া, কারণ সেটা ট্রাস্ট চালায় যেখানে শুধুই জোরায়াস্ট্রিয়ান-রা আছেন। বাঙালি, মাড়োয়াড়ি, গুজরাতি, মুসলিম সকলের সঙ্গেই বিয়ের উদাহরণ আছে।”

যদিও ক্রমেই জনসংখ্যা কমছে, তবুও সম্প্রদায় হিসাবে পার্সিরা বরাবরেই মতোই হুল্লোড়প্রবণ, আমুদে, নানাভাবে নিজেদের ব্যস্ত রাখে। ট্রাস্ট যেমন দরিদ্র, অসুস্থ, অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মানুষদের চিকিৎসা ও অন্যান্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় পরিষেবা দিয়ে থাকে। কারণ তারা বিশ্বাস করে, পথেঘাটে কোনও পার্সি ভিক্ষুক যেন না থাকেন। কলকাতায় রয়েছে পার্সিদের নিজস্ব পাঁচটি প্রতিষ্ঠান।

  • ক্যালকাটা পার্সি ক্লাব(সমস্ত রকম খেলাধূলার জন্য)
  • ক্যালকাটা পার্সি অ্যামেচার ড্রামাটিক ক্লাব (বছরে একটি নাটক করা হয়, গত ১১৬ বছর ধরে শহরের পার্সিদের জন্য বিনামূল্যে এই নাটকের প্রদর্শন হয়)
  • পার্সি জোরায়াস্ট্রিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (ধর্মীয় বক্তৃতা ইত্যাদির আয়োজক)
  • ক্যালকাটা জোরাস্ট্রিয়ান লেডিস গ্রুপ (দরিদ্র মানুষ, অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাহায্য করে)
  • ফিজিক্যাল কালচার স্ট্রিম (জিম, স্কাউটস-গাইড ইত্যাদির জন্য)

এছাড়াও ধর্মীয় উপাসনার জন্য কলকাতায় রয়েছে ফায়ার টেম্পল, পার্সিদের বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যুর পরে সমাধিস্থ করার জন্য রয়েছে টাওয়ার অফ সাইলেন্স।

ওয়াডিয়া-র মতো অধিকাংশ পার্সি বরিষ্ঠ নাগরিকই কলকাতায় জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, শিক্ষা সম্পূর্ণ করে নিজেদের পুরো কেরিয়ার জীবনই এই শহরে কাটিয়েছেন। অন্য শহরে কেউ কেউ জন্ম গ্রহণ করলেও, জন্মের পরেই শিকড় তৈরি হয়েছে কলকাতায়। কলকাতার প্রথম সারির স্কুল-কলেজে পড়েছেন তারা। চাকরি করেছেন ব্যাঙ্কে, অ্যাডভার্টাইজিং কোম্পানিতে।

“আমি স্কাউটস-এ থাকাকালীন আর তারপর ব্যাঙ্কে চাকরি করার সময়ে বাংলা শিখে গেছিলাম। হিন্দি আমি খুব খারাপ বলি। ইংরেজির পরেই ভালো বলি বাংলা, তারপর গুজরাতি। স্কুল-কলেজেও বাঙালি বন্ধুরা ছিল। আমাদের কাছে ধর্মীয় বা জাতপাতের কোনও বিভেদ ছিল না কখনওই। বাঙালি খাবারের মধ্যে আমার প্রিয় কষা মাংস আর ডাব চিংড়ি। আর বাঙালি বন্ধুরা মাটন ধনসাক খেতে চাইত। কলকাতায় তো আছেই পার্সি ধর্মশালা, পার্সি খাবারের জন্য বিখ্যাত,” অকপটে বললেন ওয়াডিয়া।

কলকাতায় পার্সি জনসংখ্যা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে গুজরাত থেকে পার্সি তরুণদের নিয়ে এসে বসবাস করানোর কথা ভাবছেন তারা। যদিও কাজটি কঠিন। কিন্তু তরুণরা নন, আসতে চাইছেন বয়স্ক মানুষেরা। অধিকাংশই মুম্বই, বেঙ্গালুরু-র মতো শহরে যেতে, থাকতে চান। বিয়ের কথা ভাবা, অন্য শহরে বসবাসকারী পার্সি মহিলারাও অনেক সময়েই কলকাতায় বিয়ে করে আসতে চান না এখন।

ট্রাস্ট-এর সদস্য বি.এস. পোস্টওয়ালা
ট্রাস্ট-এর সদস্য বি.এস. পোস্টওয়ালা

কলকাতায় ক্রমহ্রাসমান পার্সি জনসংখ্যার কথা বলতে গিয়ে হতাশ শোনায় ট্রাস্ট-এর সদস্য অশীতিপর বি.এস. পোস্টওয়ালা-র কন্ঠ, “আগে যখন বছরে একবার আমাদের ড্রামাটিক ক্লাবের পারফর্ম্যান্স হত নওরোজের দিন, কলকাতার প্রথম সারির কোনও হলে, যেখানে আসনসংখ্যা ১০০০-১২০০ হতো, সেখানেও পার্সি সম্প্রদায়ের অনেকে জায়গা না পেয়ে ফিরে যেতেন, লম্বা লাইন পড়তো টিকিটের। আর এখন আমরা একটা ৪০০ আসনসংখ্যার হল ভর্তি করতে পারি না। এটা আমাদের ঐতিহ্য, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বাংলার দাঙ্গা কোনও সময়ে নওরোজের সময়ে এই পারফর্ম্যান্স বন্ধ হয়নি।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ব্রিটিশ শাসনের সময়ে কলকাতায় ভালো ইংরেজি বলতে পারা ও অন্যদের তুলনায় বেশি পাশ্চাত্য চালচলন, রীতি-রেওয়াজে অভ্যস্ত হওয়ায় ব্রিটিশরা পার্সিদের কিছুটা অতিরিক্ত পছন্দ করতেন। সেই সময়েই ক্যালকাটা পার্সি অ্যামেচার ড্রামাটিক ক্লাব ১৯০৭ সালে আর ক্যালকাটা পার্সি ক্লাব ১৯০৮ সালে তৈরি হয়।

পোস্টওয়ালা-র বাবা ১৯১৮ সালে কলকাতায় এসে সার্কাসে কুলির কাজ শুরু করেন। তার মা শহরে আসেন কয়েক বছর পরে। পোস্টওয়ালা-র বাবা এরপর চাকরি পান পার্সি ম্যাডান পরিবারের সূত্রে। ম্যাডান পরিবার ছিল ম্যাডান থিয়েটারের মালিক, যারা কলকাতার সে সময়ের সমস্ত সিনেমা হলের মালিক ছিলেন। তিনি পরে দু-তিনটি হলের ম্যানেজার হন ও তারপরে একটি বার কিনে নিজের ব্যবসা শুরু করেন। যদিও তিনি সারা জীবনে কখনও মদ্যপান করেননি এবং পোস্টওয়ালা-রা দু’ভাইও তাই। পোস্টওয়ালা নিজে একজন সিএ ও তার ভাই ইঞ্জিনিয়ার।

“আমি খুব খুশি যে আমার সারাটা জীবন আমি কলকাতায় কাটিয়েছি। আমি বাংলা বলতেও পারি, কারণ স্কুল-কলেজ, কাজের জায়গা সবখানেই তো বাঙালিদের সঙ্গে মিশেছি। দুর্গা পুজার সময়ে যখন ইয়ং ছিলাম বন্ধুরা মিলে সারা শহর ঘুরে প্যান্ডেল দেখতাম। আমার স্ত্রীর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন এক বাঙালি। কলকাতার ধর্মতলা চত্ত্বরে লাইটহাউস, নিউ এম্পায়ার, গ্লোবে সিনেমা দেখতাম। আমার ছেলে আমার থেকেও বেশি বাঙালি,” জানালেন পোস্টওয়ালা। কলকাতায় তিনি বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠেছেন, যা একটি কসমোপলিটান শহরের সত্তা, বলা যেতে পারে। তাছাড়া পার্সি সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মিশ্র বিয়ে রয়েছে বলেও জানালেন তিনি।

পোস্টওয়ালা মনে করেন, তরুণ প্রজন্মের পার্সিরা কলকাতাকে খুবই ভালবাসলেও মূলত বন্ধুবান্ধবদের চাপেই আরও বেশি করে শহর ছাড়ছেন। যদিও তিনি লক্ষ্য করে দেখেছেন যে, নকশাল রাজনীতির সময় থেকেই শহর ছাড়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল। পার্সিরা অবশ্য ছোট সম্প্রদায় হওয়ার জন্যই কখনওই শহরের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকেননি। ব্যক্তি মানুষ হিসাবে তিনি বাঙালিদের অত্যন্ত পছন্দ করলেও কর্মক্ষেত্রে ইউনিয়ন তৈরি করাকে খুব বেশি পছন্দ করেননি কখনওই। কলকাতায় পার্সি সম্প্রদায়ের ভবিষ্যত সম্পর্কে তার একটাই বক্তব্য, ‘মাইনাস’।

কলকাতার অন্যতম প্রধান অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি সেলভেল। তৈরি করেছিলেন রুসি বি. গিমি। বিরাট বড় ব্যবসা সামলালেও তার মূলত পরিচিতি কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের একজন উদারমনা সোশ্যাল ওয়ার্কার হিসাবে। সামাজিক উন্নয়নে ও দরিদ্র মানুষদের সাহায্যার্থে তিনি অসংখ্য উদ্যোগের সঙ্গে আজীবন যুক্ত ছিলেন। বালুচ থেকে এসেছিলেন ভাগ্যানুসন্ধানে। তারপর কলকাতা-ই হয়ে যায় তার বাড়ি, তৈরি হয় পরিবার। কলকাতার পার্সি ধর্মশালায় প্রথম আশ্রয় পেয়েছিলেন, তারপর বিয়ে করেন ধর্মশালার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা পার্সি ব্যক্তির কন্যাকে। পরবর্তী সময়ে গিমি-র তিন কন্যা জন্ম নেন। তাদেরই একজন প্রোচি মেহতা। প্রোচি-র স্বামী এন.ডি. মেহতা বর্তমানে সেলভেল কোম্পানির কর্ণধার।

তরুণ বয়সে বাঙালিদের উৎসব অনুষ্ঠানে যোগদান তো করতেনই, দু’জনেই বললেন, এখনও তাদের অফিসে সব ধর্মের উৎসবই পালন করা হয় ধূমধাম করে, কারণ কর্মীরা পছন্দ করেন আর “পার্সিরা তো খাবার, পাণীয়, আনন্দ-উৎসব সব সময়েই ভালবাসে।” মেহতা বললেন, “আমরা তো রিফিউজি হয়ে ভারতে এসেছিলাম আর ভারত আমাদের আপন করে নিয়েছিল। ভারতে আমরা অত্যন্ত ভালো আছি। আমরা তো বড় হয়েছি সৎ, আদর্শ মূল্যবোধ নিয়ে, মধ্যবিত্ত জীবনে। কিন্তু কোনও পার্সি-ই বর্তমানে ভারতে যে আলট্রা-মাসক্যুলার হিন্দুত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা মোটেই করছেন না।” মেহতা-রা নিজেদের বাঙালি বলতেই পছন্দ করেন।

প্রোচি একজন লেখক ও বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদকজয়ী অ্যাথলিট, স্মৃতিচারণ করছিলেন কিশোরীবেলার। কলকাতায় তখন অন্যতম জনপরিবহন ট্রাম। বাড়ি ‘সেলভেল হাউজ’ থেকে হাত দেখিয়ে ট্রামে উঠতেন স্কুলে যেতে, ঘুমিয়ে পড়লে ট্রাম কন্ডাক্টরই ডেকে তুলতেন। গোটা শহরটাই যেন ছিল একটা পরিবার। এখনও কলকাতার এই মানবিক দিকটাই প্রোচি-র মতো বার্ধক্য ছোঁয়া পার্সি মানুষগুলিকে কলকাতা ছাড়তে দেয়নি।

মেহতা জানালেন কখনওই পৃথক সম্প্রদায় হিসাবে নিজেদের কথা ভাবেননি। তবে গত এক দশকে এই সম্প্রদায়গত পার্থক্য কলকাতাতেও বেড়েছে বলে খেয়াল করেছেন। তিনি মনে করিয়ে দেন, মিস্টার বনাজি নামের এক পার্সিকে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অফ কলকাতার অন্যতম রূপকার মনে করা হয়। খিদিরপুর ও সালকিয়া বন্দর ছিল তার মালিকানাধীন। ইনসিওরেন্স ও ব্যাঙ্কিং ব্যবসা শুরুর মূলেও ছিলেন তিনি। তিনি নিজের নামও ভালবেসে বলতেন, ‘বেঙ্গলি’।

উল্লেখ্য, কলকাতায় ক্রীড়াজগতে, ক্রিকেট, হকি সবেতেই রাজ্য ও জাতীয় স্তরে পার্সি খেলোয়াড় ও ক্লাব হিসাবে অবদান অনস্বীকার্য। তাছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্টিল ইন্ডাস্ট্রিতে ছিল পার্সিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। চাটার্ড অ্যাকাউটেন্সি ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া-র সভাপতি ছিলেন কলকাতা পার্সি ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা। কলকাতার সামগ্রিক উন্নয়নে পার্সিদের ভূমিকা ইতিহাসে রয়ে গেছে।

প্রোচি লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন, যখন তার নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে মহিলাদের অন্য সম্প্রদায়ে বিয়ে হলে তাদের সন্তানদের প্রতি হওয়া বৈষম্য তাকে ভাবাতে শুরু করে। অনেক গবেষণা, আইনি চর্চা করে তিনি লেখেন তার বই – ‘হোয়াট ইস পার্সি’। গবেষণায় উঠে আসে পার্সি সমাজে ধর্ম, ঐতিহ্য, সবকিছুই আদপে মহিলাদের পক্ষে, বৈষম্যের কোনও জায়গাই নেই। “আমাদের সমাজে ৫০% বিয়েই ইন্টারফেইথ, এবার ছেলেদের যদি সম্প্রদায়ের বাইরে বিয়ে করতে অনুমতি দাও, তাহলে মেয়েরা কাদের বিয়ে করবে?” প্রশ্ন তার। প্রোচি জানালেন এখনও তাদের সম্প্রদায়ের প্রায় ৩০% মহিলা অবিবাহিত রয়েছেন এই কারণেই। তারা চাকরি করছেন, স্বাধীনভাবে বাঁচছেন।

ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল-এর প্রিন্সিপাল টিনা সার্ভাইয়া নিজেকে সম্পূর্ণই কলকাতার মেয়ে মনে করেন। “আমার জন্ম ও বড় হওয়া কলকাতায়, বিয়ের পরে সেটল-ও করেছি কলকাতাতেই। আমার গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার গুজরাত থেকে এখনকার মুম্বইতে শিফট করেন আর তারপর কলকাতায় আসেন। আমার পরিবার এরপর রেলওয়ে কেটারিং-এর ব্যবসা শুরু করে, তারা ছিলেন গোটা পূর্ব রেলওয়ে-র কেটারার। বটলড ড্রিংকস বানাত, ফলে তার কারখানা ছিল, বেশিরভাগ কারখানাই ছিল অধুনা বাংলাদেশে এবং রেস্তোরাঁগুলি ছিল সারা পূর্বাঞ্চলে ছড়ানো। এমনকি শিয়ালদহের একটা প্ল্যাটফর্ম তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা ছিল। স্বাধীনতার পর যখন সবকিছুর জাতীয়করণ হল, তখন এই ব্যবসা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। এই পর্যন্তই আমার পরিবারের ইতিহাস খুঁজে বের করতে পেরেছি,”

টিনার বাবার অটোমোবিল ব্যবসা ছিল আর যেহেতু অ্যালকোহল-এর ব্যবসা জাতীয়করণ হয়নি তাই সেই ব্যবসাটিও তিনি করতেন। তার মা-ও চাকরি করতেন, সদ্যই অবসর নিয়েছেন।

লা মার্টিনিয়ার, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি পড়েছেন ইতিহাস নিয়ে। লোরেটো কলেজ থেকে বি.এড। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স।

ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে বললেন, “স্পোর্টসে যুক্ত ছিলাম খুব বেশি। ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাবে সাঁতার কাটতাম প্রতিদিন সন্ধ্যায়, তারপর লেক-এ রোয়িং শুরু করি। ভোর পাঁচটার সময় বাসে করে লেকে যাওয়ার দারুণ সব স্মৃতি আছে। আগে বন্‌ধের দিনে মা-বাবারা ঘরেই থাকতেন, আমরা বাচ্চারা রাস্তায় খেলে বেড়াতাম, তারা দুশ্চিন্তা করতেন না। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়। শহর কিছুটা অন্যরকম হয়ে গেছে। ‘পাড়া’র মজাটা কমে যাচ্ছে। অনেক নতুন কিছু হয়েছে, কিন্তু পাড়ার ঠেকগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।”

টিনা-র কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুর গ্রুপ ছিল কসমোপলিটান যেখানে শুধু বাঙালিরা ছিল না, সকলেই ছিল আলাদা রকমের। তিনি বলছিলেন সে সময়ের কিছু মজার অভিজ্ঞতা। “প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হওয়ার দিন আমি ‘সিডনি’ লেখা একটা টি-শার্ট পরে গেছিলাম যেটা আমার অস্ট্রেলিয়ায় থাকা কাজিন-রা এনে দিয়েছিল। পরে বন্ধুরা বলেছিল, সেদিন কলেজে প্রচুর হৈ-চৈ হয়েছিল যে প্রেসিডেন্সিতে একটি অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে ভর্তি হতে এসেছে! তারপর আমাদের পার্ট ওয়ান পরীক্ষার সময় সবাই রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট পেয়ে গেল, আমি পেলাম না। আমাকে বলা হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিসে যোগাযোগ করতে। আমি প্রচুর দৌড়াদৌড়ি করে যখন ঠিক ব্যক্তিটির কাছে পৌঁছলাম, আমাকে বললেন, ‘কী করে তোমাকে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট দেব, তুমি তো ভারতীয় নাগরিক নও?’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। তিনি তখন আমার ফর্ম দেখিয়ে বললেন, ‘ধর্মে কী লিখেছো এটা? জরো না কী একটা! এটা কী আমরা জানি না। তুমি ভারতীয় নও।’ তখন আমাকে সেই ব্যক্তিটিকে পুরো বোঝাতে হল জোরোয়াস্ট্রিয়ান মানে কী ইত্যাদি, পার্সি কারা, আমি একজন আদ্যন্ত ভারতীয়, আমাকে তার সঙ্গে বাংলা-হিন্দিতে কথা বলতে হল, পাসপোর্ট দেখাতে হল। তারপর রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট পেলাম,” হাসতে হাসতে স্মৃতিচারণা টিনা-র। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় কলেজ স্ট্রিট-এই হ্যাং আউট, কফি হাউজে আড্ডা তার প্রিয় স্মৃতি।

কলকাতার শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক পার্সি মহিলারা একটা সময়ে চাকরি করতেন। কারণ মনে করা হতো তারা ভালো স্টুডেন্ট, খুবই পরিশ্রমী, মনোযোগী। পার্সিদের একটা ওয়ার্ক এথিক্স আছে।

কলকাতায় নিজেকে সংখ্যালঘু মনে করেন কি না প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কান্ড ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য টার্নিং পয়েন্ট ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, শহরটা আর আগের মতো নিরাপদ নেই। অনেক কথা হয়েছিল – তার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হওয়া নিয়ে, চরিত্র নিয়ে। অনেক ‘শেমিং’ হয়েছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল, যদি তিনি বাঙালি হতেন, তাহলে আলোচনাটা হয়তো অন্যরকম হতো। তখনই প্রথম মনে হয়েছিল, সংখ্যালঘু হলে সামান্য একটু বেশি সতর্ক হতে হবে।

আমি যখন রোয়িং করতাম, আমি জাতীয় স্তরেও রোয়িং করেছি। কিন্তু যখন রাজ্যস্তরে রাজ্য টিম-এ সুযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম, অনেক রকম রাজনীতি চলত। বাঙালি মেয়েদের প্রতি প্রকাশ্যে পক্ষপাতীত্ব করা হতো। এগুলো আগেও হতো, এখনও হয়। যদিও খুব সূক্ষ্মভাবে। কেউ কখনও আপনাকে কিছু বলবেন না, মুখের উপর খারাপ ব্যবহার করবেন না, প্রকাশ্যে গ্রহণযোগ্যতা খুবই বেশি। তবে এই রাজনীতিটাও আছে।”

টিনা মনে করেন, “মহিলাদের, বিশেষত যারা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নন, আপনাদের কন্ঠস্বরটা খুব জোরদার হতে হবে। ভয় পেলে চলবে না, নিজের মতামত জানাতে, নিজের অধিকারটা জেনে দাবি করতে, তারপর তারজন্য লড়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকতে হবে। আপনাদের একটু বেশি দৃঢ় হতে হবে। সব মহিলাদের জন্যই এটা সত্যি, আরও বেশি সত্যি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাদের জন্য, কারণ যেভাবে দেশটা বদলে যাচ্ছে।”

তবে তার স্পষ্ট বক্তব্য, কলকাতায় শিক্ষাক্ষেত্রে কখনও কোনও বৈষম্য দেখেননি। “আমি এখনও মনে করি, অ্যাকাডেমিক্স-এর জন্য পশ্চিমবঙ্গ সবচেয়ে ভালো। কারণ বাঙালিদের মধ্যে একটা অ্যাকাডেমিক মাইন্ডসেট আছে। বাঙালি ইন্টেলিজেন্সিয়া অত্যন্ত সচেতন, অত্যন্ত উদারমনা। মহিলারা দেশের অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে অনেক সহজে ভালো সুযোগ পান, কারণ অন্য রাজ্যগুলি অনেক বেশি পিতৃতান্ত্রিক। সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ যেন প্রায় মাতৃতান্ত্রিক। মহিলারা এখানে সর্বদাই সমানাধিকার পেয়েছেন। এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গকে আমি এত ভালবাসি। আমার মনে হয় না আমি অন্য কোনও শহরে থাকতে পারতাম,” টিনা-র কথা।

তিনি মনে করেন, কলকাতার পার্সি ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টার, ফায়ার টেম্পল, এই জায়গাগুলো পার্সি হিসাবে পরিচিতি তৈরিতে সাহায্য করে। খুব ছোট একটা গোষ্ঠী হলেও খুবই সংযুক্ত। যারা কলকাতা ছেড়ে যান, অনেকেই শহরে ফিরে আসেন শুধুমাত্র সম্প্রদায়ের জন্য, যদি তাদের মা-বাবা আর জীবিত নাও থাকেন। সম্প্রদায়টাই যেন একটা বড় পরিবার, তাই ফিরে আসারও একটা কারণ সর্বদাই রয়ে যায়। তার পরিবার কখনও চাপ দেয়নি সম্প্রদায়ের ভেতরেই বিয়ে করার জন্য। আমি একজন গুজরাতিকে বিয়ে করেছি। এত ছোট একটা সম্প্রদায়কে, কাওকে পছন্দ হল না, এমনটা তো হতেই পারে। আমার স্বামীর পরিবারেও কোনও সমস্যা হয়নি।

তিনিও কলকাতায় পার্সিদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। বললেন, “আমার মনে হয় আমাদের অবস্থা আর্মেনিয়ানদের, ইহুদিদের মতো হবে। বিল্ডিং থাকবে, স্মৃতি থাকবে, কিন্তু কোনও মানুষ থাকবে না। আর এটা খুব দ্রুত হচ্ছে।”

কলকাতাকে নিয়ে একটা ছোট্ট আক্ষেপ আছে, “আমার মনে হয় কলকাতার মানুষ খুব ভালো বোঝেননি যে পার্সি সম্প্রদায়ের এই শহরে কতটা কন্ট্রিবিউশন আছে। এত ছোট একটা সম্প্রদায় ব্যক্তিগত স্তরে এই শহরের জন্য কতটা কাজ করেছেন বাঙালিরা মনে হয় না, তা খুব একটা বুঝতে পারেন।”

টিনা বললেন, “আমি সম্পূর্ণভাবে কলকাতাকে নিজের বাড়ি বলে মনে করি। কলকাতা এখনও অন্তত কিছুটা হলেও ধরে রাখতে পেরেছে ভারত আসলে যা কিছু ভালো, সুন্দর প্রতিফলিত করে। আমি ১০০% বাঙালি। বাংলা বললে বাঙালীরা কত খুশি হয়ে যান, কারণ আমার কাছ থেকে তারা আশা করে না বাংলা শুনবেন। যেরকমই বলি না কেন, বাংলা বলার চেষ্টা করি। এটা খুব সুন্দর একটা অনুভূতি।”

ক্যালকাটা জোরোয়াস্ট্রিয়ান কমিউনিটি’স রিলিজিয়াস অ্যান্ড চ্যারিটি ফান্ড-এ প্রথম মহিলা ট্রাস্টি হিসাবে যোগ দিয়েছেন এভারেডি ইন্ডাস্ট্রিজ ইন্ডিয়া লিমিটেড-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট (লিগাল) ও কোম্পানি সেক্রেটারি তেহনাজ পুনওয়ানি। তার মা পুনে ও বাবা কলকাতার পার্সি। তার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, কেরিয়ার (কোম্পানি সেক্রেটারিজ অফ ইন্ডিয়া) সবটাই এই শহরে। তার বাবার ছিল সিনেমার প্রজেক্টর বিক্রির ব্যবসা। ছোটবেলায় শুধু কলকাতা নয়, কলকাতার আশেপাশে অন্যান্য জেলাতেও সিনেমা মুক্তির দিন বাবার সঙ্গে গিয়ে সিনেমা হলে সিনেমা দেখা, একটা দিন পিকনিকের মতো কাটানো তার প্রিয়তম স্মৃতিগুলির একটি। “বাংলা আমার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমি ফ্লুয়েন্টলি বাংলা বলতে পারি। কলেজে তো বেশিরভাগ লেকচার বাংলায় হতো। আর আমি চাকরিও করছি ১৯৮৩-’৮৫ সাল থেকে। সুতরাং আমি নিজেকে কখনও আলাদা মনে করিনি,” বললেন তেহনাজ। তিনি নিজেকে প্রবাসী বাঙালিদের থেকে বেশি বাঙালি বলেও মনে করেন। কলকাতায় দীর্ঘ লোডশেডিং-এর সময় পেরিয়ে এই শহরের উন্নতি চোখের সামনে দেখেছেন, “আশা করি কলকাতা আগামী দিনে আরও উন্নতি করবে। সত্যিই যে তরুণ প্রজন্মের পার্সিরা কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছে। তবে এটা সময়ের নিয়ম। আমাদের কিছু করার নেই,” মত তেহনাজ-এর।

রতন পোস্টওয়ালা ২৬ বছর বয়সে কলকাতা ছেড়ে গিয়েছিলেন এমবিএ করার জন্য, তারপর বিদেশে চাকরি করেছেন ৭ বছর। তারপর ফিরে আসেন কলকাতায়, কারণ এই শহর ছেড়ে তিনি থাকতে চাননি। তার পেছনে কারণগুলি বললেন নিজেই, “প্রথমত আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আমার মনে হয়েছে ফিরে এসে তাদের সঙ্গেই আমার থাকা উচিৎ। দ্বিতীয়ত, এখানে আমার কমিউনিটি, যারা খুবই ক্লোজ নিট ও অ্যাক্টিভ। তাছাড়া আমি স্পোর্টসে খুবই যুক্ত আর আমার মনে হয়েছে এখানেই সেটা অন্য কোনও জায়গার থেকে আমি বেশি ভালো করতে পারব। সবচেয়ে বড় কথা এই শহর – কলকাতা। কখনওই এরকম মনে হয়নি যে আমি এখানে থাকতে বাধ্য হয়েছি। আমি এখানে থাকতে এঞ্জয় করি। অবশ্যই এই শহরের অনেক দোষ-ত্রুটি আছে, তবে আমার কাছে এর দুর্বলতার থেকে ভালো দিকটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

কলকাতার মানুষ তার কাছে আকর্ষণের অন্যতম কারণ, যাদের তিনি সাধারণভাবেই সহৃদয়, ধৈর্য্যশালী, ভালো ব্যবহারের মনে করেন। শহরের একটু ধীরস্থির গতি আর কেরিয়ার ও অর্থকরী লাভের উপরেও মানবিক সুকুমারবৃত্তিগুলিকে জায়গা করে দেওয়া রতনের কাছে কলকাতার ইতিবাচক দিক। এমনকি বাইরে গিয়ে যদি কলকাতার বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তিনি তাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে আর নিজেকে একজন কলকাতার পার্সি নয়, বরং বাঙালি বলে ভাবতে বেশি পছন্দ করেন, “আমি যদি বা অরিজিনালি বাঙালি নাও হই, একজন অ্যাডপ্টেড বাঙালি তো বটেই।”

রতন মনে করেন কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ পার্সি সম্প্রদায়কে যথেষ্ঠ স্বীকৃতিই দিয়েছে। ভালবেসেছে প্রাণ খুলে। কখনও আলাদা মনে হতে দেয়নি। তবে তরুণ প্রজন্মের পার্সিদের এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার পেছনে শহরের শিক্ষা ব্যবস্থার বিগত কয়েক দশকে উন্নতি না হওয়া, জাতীয় স্তরে পিছিয়ে পড়াকেই মূলত দায়ী করেছেন।

কলকাতায় পার্সি সম্প্রদায়ের ভবিষ্যত কী জানতে চাইলে বললেন, “খুব দ্রুত, কয়েক বছরের মধ্যে তারা এই শহর থেকে হারিয়ে যাবেন। নাম্বার্স ডোন্ট লাই, রাইট? কষ্ট হলেও, এটাই বাস্তব। মেনে নিতে হবে। যদিও এই শহরই আমার ‘হোম’, বাড়ি।”

XS
SM
MD
LG