অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

অ্যাসিড অ্যাটাক সার্ভাইভার-রা ব্রেভ সোলস - তাঁরা কখনওই নিজেদের হেরে যাওয়া বলে মনে করেন না – শাহিন মালিক


শাহরুখ খানের সাথে শাহিন মালিক।
শাহরুখ খানের সাথে শাহিন মালিক।

শাহিন মালিক ভারতের রাজধানী দিল্লির বাসিন্দা। ছোটবেলা থেকে হতে চেয়েছিলেন আইএএস অফিসার, কিন্তু সে বিষয়ে খুব বেশি কেরিয়ার গাইডেন্স না থাকায় এমবিএ করেন। যৌথ পরিবারে মা, বাবা, দাদা, বৌদির সঙ্গে পরিবার। ২৬ বছর বয়সে এমবিএ পড়া, সেইসঙ্গে চাকরির পাশাপাশি যখন আর পাঁচ জন তরুণীর মতোই নিজের আগামী দিনগুলি নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন তখন ২০০৯ সালে আচমকা এক দিন অ্যাসিড আক্রমণে মুহূর্তের মধ্যে শুধু তাঁর ত্বকই পুড়ে যায়নি, বালিঘড়ির মতো জীবনের স্বপ্নগুলোও যেন হাতের আঙুল গলে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু নিজের জীবনটাকে হাতছাড়া করেননি শাহিন। অ্যাসিড আক্রমণের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে উঠে কীভাবে এক নতুন পথ চলা শুরুই করেছিলেন আর কীভাবে অ্যাসিড আক্রমণ সার্ভাইভার ব্রেভ সোলস্‌-দের সঙ্গে নিয়ে এক নতুন যাপনের গল্প বলছেন তিনি তাই নিয়েই ভয়েস অফ আমেরিকা-র সঙ্গে কথা বলেছেন শাহিন মালিক।

ভয়েস অফ আমেরিকা-র হয়ে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনার উপরে অ্যাসিড আক্রমণের কারণ কী ছিল?

শাহিন মালিক: ২০০৯ সালে আমি দিল্লি থেকে হরিয়াণা (দিল্লির পার্শ্ববর্তী রাজ্য) গিয়েছিলাম একটি অথরাইজড লার্নিং সেন্টারে যোগ দিয়ে, যেখানে আমি স্টুডেন্ট কাউন্সেলার হিসাবে কাজও করছিলাম আর নিজের পড়াশোনাও করছিলাম। ওটাই আমার অফিস-ও ছিল আর স্টাডি সেন্টার-ও। সেখানেই কিছু মানুষ আমার কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেন, যারা আমাকে পছন্দ করতেন না, ঈর্ষা করতেন। যিনি আমার বস ছিলেন, তিনি আমাকে নানাভাবে যৌন হেনস্থা করতেন। এইসব নানা কারণে আমি কিছু সময় পরে সেখানে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলাম, জানিয়ে দিয়েছিলাম যে –“আমি আর এখানে চাকরি করব না।”

সেটা ছিল ১৯ নভেম্বর। রেজিগনেশন দেওয়ার তিন দিন পর সন্ধ্যা ছ’টার সময় আমি অফিস থেকে বেরোচ্ছিলাম, আর আমি দূর থেকে দেখলাম যে রাস্তায় একটি ছেলে রুমালে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি ভাবলাম এমনি পথচারী কেউ, দূষণের জন্য মুখে রুমাল বেঁধেছে। আমাকে ওখান থেকেই রাস্তা পেরোতে হত, আমি একদম তার পাশে গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লাম। আর তার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকানো মাত্র, সে আমার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে দিল। আমি তো তখন জানতামই না এটা অ্যাসিড না কি! প্রথমে ভাবলাম কোনও স্টুডেন্ট মজা করেছে। সেকেন্ড-এর মধ্যে বুঝতে পারলাম এটা অ্যাসিড।

শাহিন মালিক।
শাহিন মালিক।

আমি তার আগে কোনও দিন অ্যাসিড দেখিনি, ব্যবহার করিনি। যে মুহূর্তে বুঝলাম ওটা অ্যাসিড আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, মনে হল জীবন থেকে আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। আমি প্রচণ্ড জোরে জোরে চিৎকার করতে লা্গলাম, আমার সেই চিৎকার ভয়ঙ্কর ছিল। আমি আবার অফিসের দিকেই দৌড়ে গেলাম, সেখানে পৌঁছে বসে পড়ে আমি খুব চিৎকার করছিলাম, কিন্তু কেউ সেখানে আমার সাহায্যের জন্য আসেনি। হয় তারা করতে চাননি, নয়তো তারা বুঝতে পারেননি কী করতে হবে, মানুষের মধ্যে তো কোনও সচেতনতাই ছিল না। আর আমার মাথা সম্পূর্ণ ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেছিল, মাথা কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিল। গাড়ি বের করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছিল। হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তার বললেন, সবার প্রথমে চিকিৎসা হল জল দিয়ে ধুতে হবে। জলের প্রতিটি বিন্দু ক্ষতের উপর পড়লে সূঁচ ফোটানোর মতো যন্ত্রণা হচ্ছিল। সেই হাসপাতাল থেকে আমাকে দিল্লির এইমস্‌ হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হল।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনার পুরো চিকিৎসা প্রক্রিয়াটা কতদিন ধরে চলেছিল? কী কী হয়েছিল?

শাহিন মালিক: এর চিকিৎসা অনেক দীর্ঘ হয়, কখনও কখনও সারা জীবন ধরে চলে। আমার ক্ষেত্রে তাই চলবে। দশ বছর ধরে আমার রি-কনস্ট্রাকটিভ সার্জারি করিয়েছি। এখনও পর্যন্ত আমার ২৫টি সার্জারি হয়ে গেছে। আমার একটা চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। আমার অন্য চোখের চিকিৎসা সারা জীবন চলবে, সারা জীবন চোখে ওষুধ দিয়ে যেতে হবে, চেক-আপ করিয়ে যেতে হবে। এতকিছুর পরেও যন্ত্রণা থাকেই।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এই ঘটনায় আপনার পরিবারের সদস্যদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

শাহিন মালিক: আমার মা পরে বলেছেন, তিনি তো আসলে জানতেনই না যে অ্যাসিড ছোঁড়া হয়, কোথায় কীভাবে ছোঁড়া হয়। আমার দাদা কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন, আমাকে হরিয়াণা থেকে আনতে গিয়ে। মা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না, যখন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনও উনি মনে করেছিলেন যে ডাক্তার আমাকে ঠিক করে দেবেন। জানতেন না যে, অ্যাসিড-এর প্রভাব বছরের পর বছর থাকে, চেহারা পুরো বিকৃত হয়ে যায়, চোখ নষ্ট হয়ে যায় - এতকিছু কেউই ভাবেননি।

পাঁচ, ছ’দিন কেটেছিল। আমি দেখতে পেতাম না। আমার দু’টো চোখই কোমায় চলে গেছিল। তখন, যখন আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতাম, “আমার ঠিক হতে কত সময় লাগবে?” উনি বলতেন, “এটা এখন জানতে চেয়ো না।” আমি ভাবতাম ১৫-২০ দিন বলবেন, এই ক’দিন আমি কী করে ম্যানেজ করব। উনি বললেন, “এক, দেড় বছর এই প্রশ্নটা কোরোই না।” আমি তখন অবাক হয়ে ভেবেছিলান, “এক, দেড় বছর আমি কী করে কাটাব!” কিন্তু, দেখুন এখন ১৩ বছর কেটে গেল। চলে যাচ্ছে। (হাসি)

ভয়েস অফ আমেরিকা: এই ঘটনার পর আপনার অফিস থেকে কেউ এসেছিলেন? আপনি পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছিলেন?

শাহিন মালিক: এফআইআর করার সময় আমি এতটাই শকড ছিলাম যে বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কার নাম করব। চোখও বন্ধ ছিল। আমি শুধু শুনতে পারছিলাম। আমি পুলিশকে বলেছিলাম যে অ্যাসিড ছুঁড়েছে আমি তাকে দেখলে চিনতে পারব আর সে আমার অফিসেরই কেউ। সেই সময়ে আমি বুঝতে পারছিলাম না, কে করেছে, কেন করেছে। আমি আসলে খুব ‘বোল্ড’ ছিলাম, কারওর সঙ্গে কোনও সমস্যা হলে সোজাসুজি তাকে গিয়েই বলতাম, সবার সঙ্গে এরকমই ব্যবহার করতাম।

আমার বস আমার পর্যন্ত পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল, ও আসলে বুঝতে চাইছিল আমি কী করব – এগুলো আমি পরে জেনেছি। আমার দাদা কিছু একটা আন্দাজ করেছিলেন – আমার বস আসলে এতটাই নিরাপত্তা ডিঙিয়ে আমার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল। তাই দাদা আমাকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ক্রমাগত শিফট করে গেছেন তখন।

কিছুটা জানাবোঝার অবস্থায় পৌঁছে আমি পুলিশকে বললাম আমি বয়ান দিতে চাই। পুলিশ এল, আমি বয়ান দিলাম, কিন্তু তারপর চার বছর পুলিশ আর আমার কাছে আসেনি। কারণ হরিয়াণায় আমার অফিসের লোকেরা খুব প্রভাবশালী ছিল, রাজনীতি করত, ঘুষ-টুষ দিয়ে দিয়েছিল, পুলিশও আর আসেনি। চার বছর কেটে গেছিল। আমি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার তো পরিচিতিটাই হারিয়ে গেছিল। আমি বুঝতেই পারতাম না কী করব। পুলিশকে ফোন করলে তারা আমাকে ধমকে দিত – “আমরা এখন খুব জরুরি কেসে ব্যস্ত। বিরক্ত করবেন না।”

শাহিন মালিক।
শাহিন মালিক।

আমি উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে নই, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমার চিকিৎসার পেছনে প্রচুর টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছিল। সার্জারিতে লাখ-লাখ টাকা লাগছিল। পরিবারেও আমি যেন কিছুটা বোঝা হয়ে উঠেছিলাম। আমি না ছোট থেকে এরকম ছিলাম যে, কখনও কিছু চাইব না, নিজের জন্য কিছু বলব না। দেখুন, সেই আমার কী অবস্থা হয়ে গেছিল। তাই তখন আমি চেষ্টা করলাম যাতে কোথাও একটা কাজ পাই। যা একটু চোখে দেখতে পেতাম তাই দিয়েই অনলাইন-এ অর্গানাইজেশন খুঁজতাম। কেউ ডাকলেই আমি খুব আশা নিয়ে যেতাম, কারণ তখন একজন রিসেপশনিস্ট-এর চাকরি পাওয়াও আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল – আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ শূণ্য হয়ে গেছিল। আমি কোনও বাচ্চাকে ছুঁতাম না পর্যন্ত, মনে হত সে রাগ করবে। সেই সময়ে সবার থেকে নিজের মুখ লুকিয়ে রাখতাম। সেই সময়টা সত্যিই খুব যন্ত্রণাদায়ক ছিল।

নির্ভয়া কেস-এর পর যে ১৮১ হেল্পলাইন খুলেছিল আমি সেখানে ফোন করেছিলাম। ওঁরা প্রথমে বললেন এটা তো আমাদের আওতায় পড়ে না, তারপর আমাকে দেখা করার জন্য ডেকে পাঠালেন, আমি গেলাম। আমি গেলাম। ওখানকার যিনি সেই সময়ে কো-অর্ডিনেটর ছিলেন তিনি দেখা করলেন, বললেন, “দেখো বেটা, আমরা কিছু করতে পারব না, কিন্তু আমি তোমার কেসে একটা চেষ্টা করতে চাই।” আমি হরিয়াণার মুখ্যমন্ত্রীকে একটা চিঠি পাঠালাম, যেটা ওঁনার তরফ থেকে ফরোয়ার্ড হল যেখানে আমি লিখেছিলাম যে আমার অর্থনৈতিক অসুবিধা আছে, ওষুধের জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন হয় ইত্যাদি।

এই চিঠিটা একজন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-কে ফরোয়ার্ড করা হয়, পানিপথের, যেখানে এই অ্যাসিড অ্যাটাক হয়েছিল। সেই চিঠিতে আমি আমার অ্যাসিড অ্যাটাকের আগের আর পরের ছবি লাগিয়েছিলাম। একজন নতুন ম্যাজিস্ট্রেট তখন সদ্য দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উনি পরে বলেছিলেন – “বিকেলে আমার কাছে মেইলটা আসার পর আমি স্ক্রল করে দেখছিলাম, দেখলাম খুব সুন্দর দেখতে একটা মেয়ের ছবি, তারপরেই নীচের ছবিটা দেখে আমি সম্পূর্ণ শকড হয়ে গেলাম! আমি জীবনে প্রথম এরকম দেখলাম। কোনও মেয়ের এরকম হতে পারে?” উনি পুরো রাত ঘুমাতে পারেননি, পরদিন সকালে উঠেই আমাকে ফোন করেন। আমি কোনও আশাই করিনি, কারণ সব জায়গায় অ্যাপ্লিকেশন পাঠালেও কিছুই হত না। উনি ফোনে বললেন, “বেটা আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই, তুমি একবার পানিপথে ফিরে এসো।” আমি বললাম, “ভয় করে।” “আমি তোমাকে সিকিওরিটি দেব,” উনি বলেছিলেন। আমি যাওয়ার পর প্রথমবার উনি বললেন, “তুমি কী চাও বলো। তুমি বললে এখনি ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়ে যাবে না কি তোমার কেসে যে লোকেরা ছিল, তুমি তাদের শাস্তি চাও?” “ম্যা’ম আমার ক্ষতিপূরণ চাই না, যে লোকেরা যুক্ত আপনি তাদের ধরুন,” আমি জানিয়েছিলাম। ঘটনার ৪ বছর পর ৪ নভেম্বর ২০১৩-তে প্রথমবার ১৬৪ বয়ান রেকর্ড হল। সেই দিনটায় আমার মধ্যে অদ্ভূত আত্মবিশ্বাস কাজ করছিল। যা কিছুর আশা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম, তাই হচ্ছিল। রাত্তির বারোটায় দিল্লি ফিরলাম, সিকিওরিটি দিয়ে আমাকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনি একা গিয়েছিলেন?

শাহিন মালিক: হ্যাঁ। কারণ আমার বাড়ির লোকেদেরও আমার কেসটা নিয়ে আর কোনও আগ্রহ ছিল না, আর আমার মনে হচ্ছিল, আমাকে আটকাবেন। আমি ভোর ছ’টার সময়ে ট্রেন ধরে পানিপথ চলে গিয়েছিলাম, কাওকে কিছু না বলে। কারণ আমার জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার যন্ত্রণ, আমার কষ্ট আর কেউ বুঝবে না।

আমি আমার স্টেটমেন্ট দিলাম, সেই লোকগুলোকে পুলিশ স্টেশনে ডেকে পাঠানো হল। তারাও এতদিনে ভুলেই গেছিল। ভেবেছিল – চার বছর হয়ে গেছে, কোন্‌ মেয়ে আর এখন ফেরত আসবে? যখন তাদের ডেকে পাঠানো হল, আন্দাজও করতে পারেনি যে কেন ডাকা হচ্ছে! সেখানে তাদের জেরা করা হল। পুলিশ বের করল যে, দু’জন স্টুডেন্টকে যুক্ত করা হয়েছিল ষড়যন্ত্রে, ৪০০০০ টাকা দেওয়া হয়েছিল। আমার বস, তার স্ত্রী সহ মোট ৪ জন যুক্ত ছিল। সেই সময়ে এই খবরটা বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাদের গ্রেফতার করা হল, কিন্তু তারা এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, দ্রুত জামিন পেয়ে গেল। আমার যিনি আইনজীবী ছিলেন তাঁকেও হয়রানি করা হচ্ছিল, তাঁর ছোট বাচ্চাকে ফলো করে ভয় দেখানো ইত্যাদি। তিনি বললেন, “আমি এই কেসটা বেশিদিন সামলাতে পারব না, আপনি এই কেসটা দিল্লিতে ট্রান্সফার করে নিন।” আমি সুপ্রিম কোর্টে ট্রান্সফারপিটিশন করলাম আর সৌভাগ্যবশত কেসটা দিল্লিতে ট্রান্সফার হয়ে গেল। রোহিণীতে ট্রায়াল শুরু হল। এখন কোনও অর্ডার আসলে ওরা হাইকোর্ট চলে যায়, যদি তাতে আমি হেরে যাই তো আমি সুপ্রিম কোর্ট চলে যাই। তবে থেকে আজ ১৩ বছর হয়ে গেল ট্রায়াল চলছে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: অভিযুক্তরা এখন কেমন জীবন কাটাচ্ছেন আপনি কিছু জানেন?

শাহিন মালিক: তারা তো স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছেন, কারওর বাচ্চা হয়ে গেছে, কারওর বিয়ে হয়েছে। দু’জন ছেলের বিয়ে হয়েছে। আমি দেখলাম যে, এই সমাজ ভিক্টিম-এর তুলনায় অভিযুক্তকে সহজে মেনে নেয়। আমার সারা জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে গেল, সব জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কথা বলতে হয়, সবাইকে সচেতন করতে হয়, অভিযুক্তদের কিছুই করতে হয় না। তারা মেয়ে পেয়ে গেল, পছন্দ করে বিয়েও হয়ে গেল। যে অ্যাসিড ছুঁড়েছিল যে নাবালক প্রমাণ হয়েছিল। তার সাজাও হয়েছিল, অ্যাডাল্ট কেস এখনও চলছে, অথচ তারও বিয়ে হয়ে গেছে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বিচারব্যবস্থা অভিযুক্ত শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করলেও আইনের ফাঁক গলে তারা অনেক সময়েই বেরিয়ে যায়, স্বাভাবিক জীবন কাটায়। অ্যাসিড অ্যাটাক সার্ভাইভারদের ন্যায় দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থার ভূমিকা নিয়ে কী বলবেন?

শাহিন মালিক: আমার মনে হয় সার্ভাইভারদের জন্য কোনও ন্যায় নেই। এই ধরনের কেস ধর্ষণের কেসের মতোই ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে ডিল হওয়া দরকার। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টেও ছ’মাসের মধ্যে যেন রায় চলে আসে। কারণ, দেখুন, যা হয়েছে তা কখনও বদলাবে না, আমাদের সারাটা জীবন যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েই কাটবে। তবু আইন যতটুকু বলে সেটা তো অন্তত পাওয়া উচিত। সেটার জন্যও দরজায়-দরজায় ঘুরতে হয়। আমার যেমন, বিপরীতে ওরা তো লাখ টাকা অ্যাপিয়ারেন্স ফি এরকম আইনজীবী নিয়ে আসেন, আমি কোথা থেকে এত টাকা দেব? তাই এধরনের কেসে স্পেশাল প্রসিকিউটর অ্যাপয়েন্ট হওয়া দরকার। আমাদের ব্রেভ সোলস ফাউন্ডেশন যেমন এমন অভিজ্ঞ আইনজীবীদের সঙ্গে রেখেছে যাঁদের মাধ্যমে আমরা সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারি। আমাদের সংগঠন পুরো দায়িত্ব নিয়ে নেয়। কিন্তু সেই সময়ে তো কোনও সাহায্যই ছিল না। এমন অনেক সময় হয় যে কেসের দিন পড়ল অথচ বিচারপতি ছুটিতে, তখন আবার তিন-চার মাস পরের তারিখ পাওয়া যায়। এভাবে ট্রায়ালে অনেক সময় লেগে যায়। এরফলে সমাজে এধরনের অপরাধ ঘিরে যে ভয় তা চলে যায়। তাছাড়া যে ভিক্টিম তাঁর সঙ্গে এটা এক ধরনের অন্যায়। তাই তথাকথিত যে ন্যায় না কি রয়েছে, তা তাঁর পাওয়া উচিত। এছাড়া বিচারপতিসহ বিচারব্যবস্থাকে এধরনের কেসে কীভাবে সংবেদনশীল হতে হবে তার প্রশিক্ষণও দেওয়া দরকার। সেটা অবশ্য ডাক্তার থেকে শুরু করে সকলেরই হওয়া দরকার বলে আমার মনে হয়। সমাজ থেকে এই অপরাধ পুরোপুরি দূর করতে হলে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। ২০১৩-তে আইনে যে সংশোধন আসে, সেকশন ৩২৬এ ধারায়, সেখানে ন্যূনতম শাস্তি আছে ১০ বছর। আপনি দেখবেন সব বিচারপতিরা ন্যূনতম ১০ বছরেরই শাস্তি দেন। কেন সর্বোচ্চ শাস্তি দেন না? যাবজ্জীবন কারাদন্ডও তো দেওয়া যায়।

ভয়েস অফ আমেরিকা: স্টপ অ্যাসিড অ্যাটাক ক্যাম্পেন-এ খোলা বাজারে অ্যাসিড বিক্রি বন্ধের কথা জোর দিয়ে বলা হয়। এর তো আইনও আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। কী বলবেন?

শাহিন মালিক: ২০১৩-র ১৮ জুলাই আরেকটি অর্ডার আসে যে বাজারে অ্যাসিড বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেউ বিনা রশিদে কিনলে তাকে ৫০০০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে আর এটা এসডিএম নজরদারি করবেন। কিন্তু আমাদের দেশে অর্ডার তো খাতায়-কলমেই রয়ে যায়। বাস্তবে প্রয়োগ হয় শূণ্য। আজও অ্যাসিড খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আজও কারওর টয়লেট ক্লিনার লাগলে অ্যাসিড কেনে। আমার বাড়ির গলিতেই চিৎকার করে ফিনাইলের সঙ্গে অ্যাসিডও বিক্রি করে। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকাই মানা হচ্ছে না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি যে অবর্ণনীয় মানসিক ট্রমা তা কীভাবে সামলেছিলেন?

শাহিন মালিক: অদ্ভূত ব্যাপার জানেন, যাঁর সঙ্গে হয় তিনিই বুঝবেন। একটা সুস্থ-স্বাভাবিক মেয়ে, তাঁর উপর অ্যাসিড ছোঁড়া হলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাঁর জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়। এতটাই বদলে যায় নিজেকে সামলাতেই বছরের পর বছর লেগে যায়। কারণ চেহারাই আমাদের পরিচিত। অধিকাংশ মেয়েই সাজতেগুজতে ভালবাসেন। দেখতে যেন ভালো লাগে, মুখে একটা ফুসকুড়ি বেরোলেও চিন্তায় পরে যায়। একটা মেয়ে কত্তটা পিছিয়ে যায়, তার পরিচিতিটাই হারিয়ে যায়, সেটাও জন্মগত নয়, কেউ কেড়ে নিয়েছে। এটা মেনে নেওয়া যে আমি এখন প্রতিবন্ধী হয়ে গেছি, এটা মেনে নেওয়াও খুব মুশকিল। সারা জীবন এখন এরকম থাকব এটা মেনে নিতে অনেক সময় লাগে। প্রথম কয়েকটা সার্জারি তো প্রাণ বাঁচাতে করা হয় আর রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি তো চলতেই থাকে, যাতে প্রতিটা সার্জারিতে ১০-১৫ শতাংশ পার্থক্য হয়। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সবসময়েই যুঝতে হয়। যেহেতু চেহারায় ছাপ পড়ে যায়, যখনই আয়না দেখব তখনই তো মনে পড়বে, বাইরে বেরোলে লোকের চোখে ধরা পড়ে, কেউ ফিরে-ফিরে তাকায়, বাচ্চারা চোখ ঢেকে উঁকি দিয়ে দেখে, বৈষম্য করা হয়। এখন আমি শিখে গেছি – অল্প হেসে তাকাই।

২০১৩ পর্যন্ত আমি সম্পূর্ণ অবসাদে ডুবে ছিলাম। কিছুই যেন আমি অনুভব করতাম না – সুখ-দুঃখ কিছুই না। চাকরি খুঁজতে খুঁজতে সৌভাগ্যক্রমে এমন একটা কাজ পেলাম যেখানে আমাকে সার্ভাইভারদের জন্য কাজ করতে হত। প্রথমবার আমি জানলাম যে অন্য মেয়েদের সঙ্গেও এমনটা ঘটে। ঈশ্বরের আর্শীবাদে যখন আমি তাঁদের জন্য কিছু কাজ করতে পারলাম, আমি মাধ্যম হয়ে উঠলাম তাঁদের জীবনে ভালো কিছু ঘটার তখন নিজের ভেতরে একটা অদ্ভূত শান্তি অনুভব করলাম। আমি যা বহুদিন ধরে কিছুলাম জীবনের সেই লক্ষ্য খুঁজে পেলাম – তাঁদের মুখে হাসিয়ে ফুটিয়ে, একটা কাজ করে আমার ভালো লাগছে। সেই থেকেই আমি এই ক্ষেত্রে কাজ করতে চলে এলাম আর তবে থেকে আমি অ্যাসিড অ্যাটাক সার্ভাইভারদের জন্যই কাজ করছি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনার সংগঠন ব্রেভ সোলস ফাউন্ডেশন-এর ভাবনা কীভাবে এল, কাজ কীভাবে শুরু করলেন?

শাহিন মালিক: যখন আমি আলাদা আলাদা সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছিলাম তখন একটা জিনিস তো দেখেছিলামই যে এই বিষয়ে সংবেদনশীলতার খুবই অভাব রয়েছে। সবাই আশা করে যে আমরাও বাকিদের মতো ৭-৮ ঘন্টা টানা কাজ করব, যেটা আমরা করতে পারি না, কারণ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব দুর্বল হয়ে যায়, চোখে ক্ষত রয়েছে, কয়েক ঘন্টা অন্তরই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি, এতগুলো সার্জরি হয় আর তাতে জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়া দেওয়া হয়। অন্যরা আমাদের কিছু সময়ের জন্য দেখেন, সাময়িকভাবে বোঝেন, যন্ত্রণাটা হয়তো অনুভব করেন, তারপর নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অন্যদের মতো আমাদের কাজের সুযোগ দেওয়া হয় না। আমি এমন কোনও সংগঠন তখন দেখিনি যারা পুরোপুরি অ্যাসিড আক্রমণের উপরে কাজ করছে – যেখানে তাঁদের চিকিৎসা, শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্যের থেরাপি, ফিটনেস-এর ক্লাস, চাকরির সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে আর তাঁদের ফৌজদারি মামলাগুলি দেখা এবং সরকারের থেকে সঠিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

তখন আমি ভাবলাম যে এরকম একটা সংগঠন শুরু করা দরকার। কিন্তু বেশ ভয়ও পেয়েছিলাম – আমার কাছে ফান্ড ছিল না, কী করে করব, কী করব – কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু ঐ যে বলে না যে যখনইও আপনি ভালো কিছু করার কথা ভাবেন রাস্তা ঠিকই তৈরি হয়ে যায়। ব্রেভ সোলস নামটা ঠিক করেছিলাম অ্যাসিড অ্যাটাক সার্ভাইভারদের সাহসীকতার কথা মাথায় রেখে – তাঁরা কখনওই নিজেদের হেরে যাওয়া মনে করেন না। পরাজিত তো তাদের বলে যারা পড়ে গিয়ে উঠতে রাজি নন, আর এঁরা তো উঠে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত, শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষা। দিল্লিতে ২০২১-এ ‘আপনা ঘর’ নামের একটা শেল্টার হোম দিয়ে আমি এর কাজ শুরু করি। যেখানে দেশের বিভিন্ন রাজ্য, এমনকি অন্য দেশ থেকেও সার্ভাইভার-রা চিকিৎসার জন্য আসেন, দিল্লির সেরা প্রাইভেট হাসপাতালে আমরা তাঁদের চিকিৎসা করাই, তাঁরা সেখানে থাকেন, বিশেষ ডায়েটের ব্যবস্থা করা হয়। বাকি সার্ভাইভারদের মধ্যে কেউ পড়ছেন, কেউ স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং নিচ্ছেন – কম্পিউটার, ইংরেজি শেখার ক্লাস হয়। একটা লিটিগেশন অফিস আছে যেখানে আমরা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর সব কাজ করি। আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারি না কীভাবে সব হয়ে গেছে ধীরে ধীরে।

২০১৭ সাল থেকে আমি অপরাজিতা বোস-কে চিনি। পশ্চিমবঙ্গে আমরা তখন একটা সংস্থার মাধ্যমে কিছু কাজ করতাম, কিন্তু সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখানে সার্ভাইভারদের হয়ে কাজ করার জন্য কিছুই ছিল না। তারপর আমরা দু’জন কথাবার্তা বলে ২০২২-এর ৩০ মার্চ কলকাতায় ব্রেভ সোলস ফাউন্ডেশন শুরু করি। যেখানে আমরা কথা দিয়েছি যে তাঁদের চিকিৎসা-ওষুধপত্র, লেখাপড়া, মামলা আর তাঁদের ছোট ব্যবসার সেট-আপ তৈরিতে আমরা তাঁদের সাহায্য করব। বিনা ফান্ডিং-এই পশ্চিমবঙ্গে কাজ শুরু করি, ব্যক্তিগত ফান্ডিং-এর অনুরোধ করতাম। এফসিআরএ, সিএসআর নেই আমাদের, ইন্ডিভিজুয়াল ডোনারদের উপরেই নির্ভরশীল। আমরা এক বছর হয়ে যাওয়ার পর পরিকল্পনা করেছি যে পশ্চিমবঙ্গে কলকাতাতেও একটা ‘আপনা ঘর’ শেল্টার হোম বানাব। কারণ এখানে জেলাগুলো অনেক দূরে দূরে। চিকিৎসার জন্য আসতে সমস্যা হয়, তাই তাঁরা চিকিৎসা করাতে এসে এখানে থাকতে পারবেন, কেউ চাকরি করলে বা কিছুর প্রশিক্ষণ নিলেও ওখানে থাকতে পারবেন।

ভয়েস অফ আমেরিকা: পশ্চিমবঙ্গে ব্রেভ সোলস-এ এই মুহূর্তে কতজন যুক্ত?

শাহিন মালিক: এই মুহূর্তে ৩০ জন। আমি, অপরাজিতা বোস ও মণীষা পৈলান যিনি নিজে একজন সার্ভাইভার আমরা প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখি। তাছাড়া রয়েছেন কয়েক জন প্রো-বোনো আইনজীবী। দিল্লিতে আমাদের দল একটু বড়। সেখানে আমাদের সঙ্গে ৪ জন আইনজীবী আছেন, গবেষক আছে। একজন সার্ভাইভার রেশমা, যিনি নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উইক-এ র‍্যাম্প-এ হেঁটেছিলেন তিনি দিল্লিতে আমাদের কো-অর্ডিনেটর। একজন বয়স্ক সার্ভাইভার, বাকি সার্ভাইভারদের দেখাশোনার দায়িত্ব সামলান। আমরা সার্ভাইভারদেরই কাজের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করি। তাছাড়া বিনোদনের ব্যবস্থাও করি, যাতে বাকি সমাজের সঙ্গে তাঁদের যুক্ত রাখা যায়, যাতে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ থাকে, তাঁরা বাইরে যান, মেলামেশা করেন। সিনেমা দেখা, বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা শাহরুখ খানের মীর ফাউন্ডেশন একরকমভাবে ব্রেফ সোলস ফাউন্ডেশন-এর পাশে আছে। সে বিষয়ে একটু বলুন।

শাহিন মালিক: আমি যখন সার্ভাইভারদের নিয়ে কাজ করতাম তখন একবার একটা জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান করেছিলাম, যেখানে ১০০ জনেরও বেশি সার্ভাইভার এসেছিলেন। সেখানে এই বিষয়টির উপরে যাঁরা যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা এসেছিলেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন মীর ফাউন্ডেশন-এর ডিরেক্টর এসেছিলেন, যিনি আমার কাজ দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন, বুঝেছিলেন আমি কতটা গভীরভাবে এই কাজটির সঙ্গে জড়িত। তখন থেকেই আমার সঙ্গে তাঁর একটা যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেছিল। তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে একেক জন সার্ভাইভার-এর জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করতাম, এখন সংগঠন দু’টি জুড়ে গেছে। দিল্লিতে যদিও বা আমরা স্পনসর যোগাড় করতে পারি, পশ্চিমবঙ্গে সার্ভাইভারদের সার্জারি করানোর জন্য সেটা আমাদের পক্ষে খুব কঠিন – এক্ষেত্রে সার্জারি, চিকিৎসায় মীর ফাউন্ডেশন আমাদের সাহায্য করে, সাপোর্টিং অর্গানাইজেশন বলতে পারেন।

ভয়েস অফ আমেরিকা: শাহরুখ খান আপনাদের এই লড়াই দেখে কী বলেন?

শাহিন মালিক: শাহরুখ খান – এসআরকে – একজন ভীষণ ভালো মানুষ। ওঁনাকে দেখলেই সার্ভাইভারদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। উনি এমনভাবে কথা বলেন, যেন কতদিনের পরিচিত – “বলুন, আপনি কী করতে চান?” “আপনার কী পছন্দ?” এমন সব আপন করে নেওয়া প্রশ্ন করেন। এটাও সার্ভাইভারদের জন্য একটা মোটিভেশন। উনি এ ধরনের প্রোগ্রাম প্রায়শই অর্গানাইজ করেন। সার্ভাইভারদের জন্য উনি অনেক কিছু করতেও চান। আমি ওঁনাকে একটা আইডিয়া দিয়েছিলাম যে পুনর্বাসন না রিহ্যাবিলিটেশন-এ চিকিৎসা তো হচ্ছে, কিন্তু আরও অনেক কিছু করা যায়। উনি সেগুলো করার চেষ্টা করছেন।

ভয়েস অফ আমেরিকা: দিল্লি হোক বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকা নিয়ে আপনি কি আশাবাদী?

শাহিন মালিক: দিল্লি হোক বা পশ্চিমবঙ্গে এক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা শূণ্য। ক্ষতিপূরণের নামে তিন লাখ টাকা সরকার দিয়ে দেয়। পশ্চিমবঙ্গের একজন সার্ভাইভার ঝুমা, যিনি চোখে দেখতে পান না তিনিও মাত্র তিন লাখ টাকা পেয়েছেন। একটা সার্জারিতেই তো তিন লাখ টাকা লাগে। আমিও বোধহয় তাঁর যন্ত্রণা বুঝতে পারব না, কল্পনাও করতে পারব না তাঁর কষ্ট। সারা জীবন উনি দৃষ্টিহীন হয়ে থাকবেন, প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে বাঁচবেন। পুনর্বাসন দেওয়া কার দায়িত্ব? সরকারের দায়িত্ব ছিল যাতে অপরাধটা না হয়। যেহেতু এটা আপনার ব্যর্থতা যে এটা আটকাতে পারেননি তাঁর সারা জীবনের পুনর্বাসন, খরচ-খরচা আপনি দেবেন। কিন্তু সরকার তো ধারেকাছেই নেই। কেস-ও চলতেই থাকে। যেহেতু সরকার কিছু করে না, তাই আমাদের মতো সংগঠনদের আসতে হচ্ছে। কী লজ্জার বিষয় যে সুপ্রিম কোর্ট দিল্লিতে এবং সেখানেও এর কোনও প্রয়োগ নেই।

ভয়েস অফ আমেরিকা: অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনা সারা দেশে ক্রমেই বাড়ছে। কারণ কী বলে মনে হয়?

শাহিন মালিক: কারণ এটা খুব সস্তা, খুব সহজে পাওয়া যায়। মাত্র ২০ টাকার অ্যাসিড দিয়ে আপনি একজন মানুষের সারাটা জীবন নষ্ট করে দিতে পারেন। এটা এতটাই বিপজ্জনক। কেন এটাকে নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না? এটা টয়লেট ক্লিনার বলে বিকল্প থাকা সত্ত্বেও অ্যাসিডকে বাজারে রেখে দিয়েছেন! ১০-২০ টাকা বেশি দেবেন না বলে, দেখুন কত মেয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছেন। এতটাই সহজলভ্য যে ভয় হয়, কারওর সঙ্গে যেকোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এই আক্রমণের সঙ্গে কোথাও সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাও জড়িয়ে থাকে কি?

শাহিন মালিক: অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিকতা এর একটা বড় কারণ। পুরুষেরা সবসময়েই ভাবেন যে তাদের কথা শোনা হবে। যতই আমরা বলি না কেন আমাদের সকলের পরিবারেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই বিষয়টি এখনও আছে। মেয়েদের শেখানো হব পরিবারের পুরুষদের কাজ করে দিতে। ছেলেরাও তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এটাই বাড়তে বাড়তে মেল ইগো হয়ে যায়। এখন যখন আমি কলেজে যাই ওয়ার্কশপ, সেমিনারে – আমি বলি কীভাবে প্রত্যাখান মেনে নিতে হয়। না সহ্য হয় না আর একটা প্রতিশোধ নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে আপনি কি কোনও আর্থ-সামাজিক প্যাটার্ন লক্ষ্য করেন?

শাহিন মালিক: এই ধরনের ঘটনা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে খুব বেশি ঘটে। উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে খুব কমই ঘটে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: যে মহিলারা স্বাধীন, নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চান, তাঁদের উপরে কী বেশি হয়?

শাহিন মালিক: বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাই হয়। আমাদের কাছে এরকম অনেক কেস আছে যেখানে মেয়েটি স্বাধীন ছিল, অনেকগুলো কেসে স্বামীরা স্ত্রীদের উপর আক্রমণ করেছেন। তাছাড়া প্রত্যাখ্যানজনিত কেসগুলি তো আছেই। এখন এতটাই বেড়ে গেছে ১০০-র মধ্যে ৫% আক্রমণ পুরুষদের ক্ষেত্রেও হয়। কোনও জিনিস যখন এত সহজে ঘটে তখন তো তা অসুখের মতো ছড়িয়ে পড়ে। যারা এই ঘটনা ঘটান তাদের মধ্যে কোনও অনুশোচনাও দেখা যায় না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ভারতে এখন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য যে আইন আছে ‘রাইটস অফ পার্সনস উইথ ডিসএবিলিটিস অ্যাক্ট, ২০১৬’ – সেখানে অ্যাসিড অ্যাটাক সার্ভাইভাররা অন্তর্ভুক্ত। এই বিষয়টিকে আপনি কি ইতিবাচকভাবে দেখছেন?

শাহিন মালিক: একজন সার্ভাইভার হিসাবে আমি বলতে চাই যে এটাকে লোকমোটর ডিসএবিলিটির মধ্যে রাখা হয়েছে। একজন অ্যাসিড অ্যাটাক সার্ভাইভার কি সমস্ত ডিসএবিলিটির পরীক্ষাগুলি ঠিকভাবে দেওয়ার মতো অবস্থায় থাকেন? একজন যিনি ছোট থেকেই প্রতিবন্ধী, আর একজন আমরা যাদের হঠাৎ করে প্রতিবন্ধকতা এসেছে – আমি তো এত দ্রুত শিখতে পারব না, আমি কী করব? এই অ্যাক্ট অনুযায়ী একজন সার্ভাইভার-ও কি এখনও পর্যন্ত এমপ্লয় হয়েছেন? অ্যাসিড অ্যাটাক সার্ভাইভারদের মেডিক্যাল কন্ডিশন, তাঁদের চাহিদা বুঝে এটা হওয়া দরকার ছিল। আমাদের তো চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। যাঁদের চোখ পুরো নষ্ট হয়ে যায়, তাদেরও যাতে সংক্রমণ না হয় তারজন্য বারবার আই ড্রপ দিতে হয়। প্রক্রিয়াটা সহজ হওয়া প্রয়োজন। এখানে ৪০% বেঞ্চমার্ক ধরা হয়। ধরুন যাঁর একটা চোখ চলে গেছে, তাঁকে ২৫% ডিসএবিলিটি ধরছেন, তাহলে তিনি তো ক্যাটাগরিতে আসছেনই না। কী অদ্ভূত না?

ভয়েস অফ আমেরিকা: এখন জীবন কেমন কাটছে?

শাহিন মালিক: আমার কাজই আমার জীবন। আমি দুয়া করি যেন যত বেশি সম্ভব মানুষের জীবনে ভালো কিছু হওয়ার আমি মাধ্যম হয়ে উঠতে পারি, তাদের জন্য ভালো কিছু করতে পারি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: পরিবারের সদস্যদের এখন প্রতিক্রিয়া কী?

শাহিন মালিক: এখন তাঁদের ভালো লাগে যে আমি ভালো কিছু করছি, আমি কিছু অর্জন করেছি, যদিও এই সব কিছুতে তাঁদের কোনও সাপোর্ট ছিল না। কিন্তু যখন একসঙ্গে থেকে তাঁদেরও ভালো লাগে আমারও ভালোই লাগে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনি উত্তর দিতে না চাইলে স্বচ্ছন্দে না বলতে পারেন – জীবনে কি অতীতে কোনও ভালবাসার জন ছিলেন? এখন কি আছেন?

শাহিন মালিক: অনেক সার্ভাইভারদের বয়ফ্রেন্ড হয়েছে, বিয়ে হচ্ছে। কিন্তু আমার জীবন থেকে এখনও এটা মিসিং। হয়তো আমার জীবনেও কেউ আসবেন। (হাসি)

ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনার শখ বা হবি কী?

শাহিন মালিক: আমি মেক-আপ করতে খুব ভালবাসতাম, বিশেষত চোখের। শপিং করতে, সিনেমা দেখতে পছন্দ করতাম। কমিউনিকেশন আমার পছন্দের ছিল। অন্যদের আনন্দ দিতে ভালবাসতাম। মনখোলা মেয়ে ছিলাম একটা। কাওকে ভয় পেতাম না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: যেগুলো বললেন সবটাই অতীতে। এখন কী ভালোবাসেন?

শাহিন মালিক: এখনও আমার বাইরে যেতে ভালো লাগে। কিন্তু সব ভালো লাগাটাই এখন আমার কাজের সঙ্গে জুড়ে গেছে। নতুন নতুন প্রজেক্টে কাজ করতে ভালো লাগে। নতুন চিন্তাভাবনা করি যে আরও কী করতে পারি, কীভাবে কাজটাকে বাড়াতে পারি, কোন সার্ভাইভারের কী প্রয়োজন।

XS
SM
MD
LG