অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

মণিপুরে আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা: রাষ্ট্রের ভূমিকা ও গণতন্ত্র


মণিপুরে গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে অবিরাম হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে চলেছে। এএফপি ফাইল ছবি।
মণিপুরে গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে অবিরাম হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে চলেছে। এএফপি ফাইল ছবি।

ভারতের মণিপুর জনজাতি দাঙ্গায় বিধ্বস্ত। হাতে গোনা কয়েক দিন সাময়িকভাবে শান্ত থাকা পর সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে মণিপুরের এক ভয়াবহ হিংসার ভিডিও যেখানে দেখা যাচ্ছে এক ব্যক্তির গায়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে জনতা। উল্লেখ করা যেতে পারে এর আগে গত ৪ মে দুই কুকি মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ঘটনা ঘটেছিল, যে ভিডিও পরে ভাইরাল হয়ে পড়ে সারা ভারতে আলোড়ন ফেলে দেয়। পুলিশের তরফে দাবি করা হয়েছে, এই আগুন লাগানোর ঘটনাটি ওই একই দিনে কংপোকপি এবং থৌবল জেলার সীমানায় ঘটেছিল।

দুই কুকি মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানো ও গণধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছিল মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে থৌবল জেলায়। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিং ঘটনার ভিডিও সামনে আসার পর বলেছিলেন, দোষীদের কাওকে ছেড়ে দেওয়া হবে না।

কুকি মহিলাদের উপরে এই সহিংসতার ঘটনায় অভিযুক্ত কয়েক জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এক নির্যাতিতা তার বয়ানে বলেছেন, ওই একই দিনে মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষদের হাতে নিহত হন তার বাবা এবং ভাই।

২১ বছরের ওই মহিলা ‘জ়িরো এফআইআর’ দায়ের করেন সাইকুল থানায়। তিনি বয়ানে বলেছিলেন, ৪ মে তাদের বিবস্ত্র করে গ্রামে হাঁটানো ও গণধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছিল বি ফাইনম গ্রামের কাছে থৌবল জেলায় তৌবু গ্রামের পাশে। তিনি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ-সহ একাধিক অভিযোগ আনেন।

ঘটনার দিন প্রায় ১০০ জন দুষ্কৃতী গ্রামে ঢুকেছিল বলে জানান নির্যতিতা, যাদের অনেকের হাতে ছিল, একে-৪৭, ইনসাস সহ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। গ্রামে ঢুকে তারা নির্বিচারে বাড়িতে আগুন ধরায়, গুলি চালায়।। সেসময় নির্যাতিতাসহ তার পরিবারের তিন মহিলা এবং তার বাবা এবং ভাই প্রাণ বাঁচাতে পাশের জঙ্গলে ঢুকে পড়েন। এরপর নংপোক সেকমাই থানা থেকে পুলিশকর্মীরা গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। কিন্তু থানায় ফেরার পথেই দুষ্কৃতীরা তাদের উপর চড়াও হয়।

তিনি জানান, এরপরই তিন মহিলাকে খুনের ভয় দেখিয়ে বলপূর্বক বিবস্ত্র করানো হয়, সেই অবস্থায় ঘোরানো হয় ও গণধর্ষণ করা হয়। করা হয় পুরো ঘটনার ভিডিও। এই হামলাকারী জনতাই তার বাবা এবং ভাইকে হত্যা করে বলেও তিনি দাবি করেন। নির্যাতিতার বয়ানের প্রেক্ষিতেই নতুন এই ভিডিয়োটি ঘিরে ফের মণিপুরের হিংসার চিত্র সামনে এসেছে। এবং এই বয়ানের ভিত্তিতেই পুলিশ অনুমান করছে ভিডিওতে দেখতে পাওয়া নিহত ব্যক্তি নির্যাতিতার বাবা বা ভাই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মণিপুরে জনজাতি দাঙ্গা ও রাজনৈতিক চাপান-উতোর

উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি রাজ্য মণিপুরে বিভিন্ন জনজাতি-আদিবাসী গোষ্ঠীর বাস। এই মণিপুর গত মে মাস থেকে সংবাদ শিরোনামে। সেখানকার মেইতেই ও কুকি-যো জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় বহু সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন, ঘরছাড়া অসংখ্য মানুষ। শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দুই গোষ্ঠীর মানুষই এই সহিংসতায় স্বাভাবিক জীবন হারিয়েছেন। এই সহিংসতা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার উভয়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায়। মণিপুরে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। ভারতের রাজনীতিতে যেসব রাজ্যগুলিতে বিজেপি শাসন সেখানে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কথা মাথায় রেখে বলা হয় ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার চলছে। তবে রাজনৈতিক মহল তথা নাগরিক সমাজের বক্তব্য, মণিপুরের জনজাতি দাঙ্গা বন্ধে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে এই ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার।

রাজ্যে সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংখ্যালঘু কুকি-যো গোষ্ঠীর সংঘর্ষকে সারা দেশের প্রেক্ষিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের প্রতিরূপ বলেই মনে করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হিংসাদীর্ণ মণিপুর পরিদর্শন করেছিলেন একবার, মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মণিপুরের জনজাতি দাঙ্গা বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেননি শুধু তাই নয়, বিশেষ কোনও মন্তব্যও করেননি। যার ফলে হিংসা নিয়ন্ত্রণ প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে।

আদিবাসী নারীদের যৌন নির্যাতনের ভাইরাল ভিডিও

এরই মধ্যে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ায় পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল হয়ে ওঠে। হিংসা শুরুর সময়েই দুই আদিবাসী কুকি-যো মহিলাকে বিবস্ত্র করে প্রকাশ্যে হাঁটানো ও তারপর তারা সহ আরও একজন নারীর উপরে যৌন হেনস্থা ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। প্রায় আড়াই মাস পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এই বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ভিডিওটি। এবং তারপরেই সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে নারী অধিকার আন্দোলনকর্মী, রাজনৈতিক মহল থেকে না্গরিক সমাজ সকলেই এই ঘটনায় শিউরে ওঠেন ও দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলেন।

ঘটনাক্রম

এরপর ঘটনা পরম্পরায় যা ঘটে –

ক) মণিপুরেও এই ঘটনায় সরব হন সমস্ত গোষ্ঠীর মানুষেরা। সংবাদ সূত্রে প্রকাশ অভিযুক্ত মেইতেই ব্যক্তির বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ায় যোগ দিয়েছিলেন মেইতেই গোষ্ঠীর মহিলারাও।

খ) ওয়াকিবহাল মহলের মতে ঘটনার পর দীর্ঘ সময় কেটে যাওয়ার পরে এই ভিডিও সামনে আসার কারণ সংখ্যাগুরু মেইতেই গোষ্ঠী সংখ্যালঘু কুকি-যো গোষ্ঠীর মধ্যে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ বজায় রাখতে চায়।

গ) এই ঘটনা সামনে আসায়, মণিপুরের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কোনও মন্তব্য না করলেও এই ঘটনাকে লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

ঘ) দেশের শীর্ষ আদালত, সুপ্রিম কোর্ট মণিপুর তথা কেন্দ্রের সরকারকে জানায় যদি তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারেন, তবে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে।

ঙ) সোশ্যাল মিডিয়ায় আদিবাসী মহিলাদের প্রতি সহিংসতার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর একাধিক মামলা দায়ের হয়, সুপ্রিম কোর্টে। তারমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল যৌন হেনস্থায় নির্যাতিতা দুই মহিলা ন্যায়ের দাবি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন।

চ) জুলাই মাসের শেষে সুপ্রিম কোর্ট এই ঘটনার তদন্তের ভার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন বা সিবিআই-এর হাতে তুলে দেয় এই বলে যে, তারা যেমন চান এই ঘটনায় নির্যাতিতারা দ্রুত ন্যায় পান, তেমনি একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াও অনুসরণ করতে চান তারা। যদিও অভিযোগকারী নির্যাতিতারা সিবিআই-এর হাতে তদন্তভার তুলে না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, তবে দেশের শীর্ষ আদালত নিজেদের সিদ্ধান্ত বজায় রাখেন।

ছ) অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি সিবিআই এই ঘটনার তদন্তের জন্য ৫৩ সদস্যের এক তদন্তকারী দল গঠন করেছে। তার মধ্যে ২৯ জন মহিলা আধিকারিকদের রাখা হয়েছে কারণমণিপুরে শুধু এই ঘটনাই নয়, প্রায় ১২টি এফআইআর জমা পড়েছে মহিলা নির্যাতিতাদের।

জ) সরকার পক্ষের আইনজীবী বারেবারেই এই ঘটনাকে বিভিন্ন অবিজেপি-রাজ্যের নারী নির্যাতনের সঙ্গে তুলনা করতে চাইলেও প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, এই ঘটনার প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং তাকে কোনওভাবেই অন্য রাজ্যের সঙ্গে এক করে দেখলে চলবে না।

ঝ) সুপ্রিম কোর্ট মণিপুরে এই দাঙ্গাবিধ্বস্ত সময়ে কতজন মহিলা যৌন নির্যাতিতা হয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা তলব করেছিল রাজ্য সরকারের কাছে।

ঞ) মণিপুর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা ভাঙতে বিরোধীরা দেশের সংসদে বাদল অধিবেশনে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। বিতর্কের শেষ দিন জবাবি ভাষণে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত কম সময়ের জন্য মণিপুর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, তার আগেই অবশ্য বিরোধীরা তার ভাষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখিয়ে ওয়াক আউট করেছিলেন।

ট) ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ অগাস্টের দিন রাজধানী দিল্লির লালকেল্লা থেকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

মণিপুর বিষয়ে শুধু বলেন, “সারা দেশ মণিপুরের মানুষের পাশে রয়েছে। একমাত্র শান্তির মধ্যে দিয়েই সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসতে পারে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সমস্ত চেষ্টা করছে, যাতে সমাধান সূত্র বের করা যায়।”

ঠ) সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট জানায় সিবিআই মণিপুরে মহিলা ও শিশুদের উপর হওয়া সহিংসতার ঘটনার তদন্ত কেমন এগোচ্ছে তার তত্ত্বাবধানের জন্য নিয়োগ করা মহারাষ্ট্র পুলিশের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল দত্তাত্রয় পডসালগিকর-এর রিপোর্ট-এর জন্য আর কিছুদিন অপেক্ষা করবে।

এই ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়ে যে চিত্রটি উঠে আসছে তা যেমন একদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারের ভূমিকা এবং বিচারব্যবস্থার সক্রিয় হয়ে ওঠার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তেমনি আবারও মনে করিয়ে দেয় দাঙ্গা বা যেকোনও হিংসা-বিধ্বস্ত সময়েই নারী শরীর হয়ে ওঠে দাবার ঘুঁটি। যে পক্ষই হোক না কেন, অপর পক্ষের নারী শরীরকে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের অন্যতম হাতিয়ার বলে ধরে নেয় তারা। ঠিক এভাবেই দুই জনজাতি গোষ্ঠীর লড়াইতেও সংখ্যালঘু নারী শরীর নিগৃহীত হয়, এবং তা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার আস্ফালন হয়ে দেখা দেয়।

“ভারতে ভূমি সংস্কার আইন সংশোধন করলে আদিবাসীদের মধ্যে সমস্যাগুলি মেটানো সম্ভব হবে”: মানবাধিকার কর্মী ইরম শর্মিলা চানু

মণিপুর তথা উত্তর-পূর্ব ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার কারণে বিগত বহু বছর ধরে সেখানে উগ্রপন্থা দমনের নামে রাষ্ট্রের আফস্পা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট প্রচলিত থাকায় নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ, প্রতিরোধ ইত্যাদি ক্রমশ দানা বেঁধেছে বছরের পর বছর ধরে। রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন যত বেড়েছে ততই আফস্পা প্রত্যাহারের জন্য আন্দোলন ঘনীভূত হয়েছে। মানবাধিকার কর্মী ইরম শর্মিলা চানু মণিপুরে দীর্ঘ ১৬ বছর টানা আন্দোলন করেছিলেন আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে।

জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক স্তরে সুপরিচিত হয়ে ওঠা মানবাধিকার কর্মী ইরম শর্মিলা চানু-র ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “এই ঘটনার কথা জানতে পেরে আমি অবশ হয়ে গেছিলাম।” জনজাতি গোষ্ঠীর এই দাঙ্গায় সংখ্যালঘু কুকি-যো গোষ্ঠীর উপর নানা রকম আরোপ লাগানো হচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতম হল তারা মণিপুরের আইনসম্মত নাগরিক নন। এই প্রসঙ্গে ইরম শর্মিলা চানু জানালেন, “কুকি-রা মোটেই বেআইনি নাগরিক নন। সকলেরই ইতিহাসটুকু জানা প্রয়োজন। নিজের দেশে, নিজেদের রাজ্যে কীভাবে তারা বেআইনি নাগরিক হতে পারেন?” তিনি মনে করেন, কুকি-যো এবং মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ মেটানোর জন্য, আসলে ভারতের ভূমি সংস্কার আইনে বদল আনতে হবে। কুকি-যো এবং মেইতেই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের পেছনে একটা বড় কারণ অবশ্যই জমির অসম বন্টন। “ভূমি সংস্কার আইন সংশোধন করলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সমস্যাগুলি মেটানো সম্ভব হবে এবং তাতে সমাধান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে,” মত ইরম শর্মিলা-র। আদিবাসী মহিলাদের উপর নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় মেইতেই নারীরা মূলত যারা রাষ্ট্রের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বারেবারেই সোচ্চারে প্রতিবাদ করেছেন, তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই প্রেক্ষিতে ইরম শর্মিলা বলেন, “মণিপুরের মহিলারাও পিতৃতন্ত্রেরই অংশ। তারা পারিবারিক হিংসা, নানারকম বৈষম্যের শিকার। বাইরে সকলে শুধু ক্ষমতায়ণ হওয়া মণিপুরী নারীদের কথা জানতে পারেন, কিন্তু সেটাই বাস্তব নয়।” আদিবাসী মহিলাদের যৌন নিগ্রহের ঘটনায় রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের ভূমিকা নিয়ে তার স্পষ্ট বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রীকে তো জবাবদিহি করতেই হবে। রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে তাকে দায়িত্ব নিতে হবে এবং মণিপুরে আদিবাসী মহিলাদের সঙ্গে যে সহিংসতা হয়েছে তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখা দরকার আমরা গণতন্ত্রে বাস করি, কোনও স্বৈরাচারী শাসনে নয়।”

“নারীশরীর একটা যুদ্ধক্ষেত্র”: ভারতের বরিষ্ঠ সাংবাদিক প্যাট্রিশিয়া মুখিম

প্যাট্রিশিয়া মুখিম একজন বরিষ্ঠ সাংবাদিক এবং শিলং টাইমস-এর সম্পাদক। ভয়েস অফ আমেরিকা-র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি জানালেন, “তথ্য অনুসন্ধানকারী দল যারা সেখানে গেছেন, তাদের রিপোর্টে উঠে এসেছে যে সরকারের দ্বারাই এই হিংসা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই দলের বিরুদ্ধেই এফআইআর দায়ের হয়। অর্থাৎ যারাই এই ব্যাপারে মুখ খুলতে যাবেন, তাদের বিরুদ্ধেই সরকার-প্রশাসন কড়া ব্যবস্থা নেবে এমন একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে, সরকারের এটাই এখন কাজের পদ্ধতি। সারা উত্তর-পূর্ব ভারতেই প্রতিবাদ হচ্ছে, শিলং-এও হয়েছে। শুধু নারী সংগঠন নয়, সকলেই করছে। অরুণাচল প্রদেশে হয়েছে, অরুণাচল প্রদেশে উওমেন’স অ্যাসোসিয়েশন প্রতিবাদে শামিল হন। মিজোরামে যে প্রতিবাদ হয়, সেখানে মুখ্যমন্ত্রী নিজে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সুতরাং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে নিশ্চিতভাবেই প্রতিবাদ হচ্ছে, কিন্তু দেশের অন্য রাজ্যের বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। খুব বেশি নারীবাদী সংগঠনকে আমি দেখেনি যারা এখনও প্রতিবাদে শামিল হয়ে, যা বলা প্রয়োজন তা বলছেন। তার একটা বড় কারণ ২০১৪ সাল থেকে তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে স্তিমিত হয়ে পড়েছে।” আবারও নারীকেই ব্যবহার করা হল দাঙ্গায় হিংসা ছড়ানোর মাধ্যম হিসাবে, সে প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, “নারী শরীর একটা যুদ্ধক্ষেত্র। নারী শরীরকে যুদ্ধের সময়ে শত্রুপক্ষ ব্যবহার করে যুদ্ধস্থল হিসাবে, বিরোধী পক্ষের পুরুষদের নৈতিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দেওয়ার জন্য ও লড়াইয়ের জন্য তাদের অনুপযুক্ত করে দেওয়ার জন্য। এবার আমাদের নিজেদের দেশেই তা ব্যবহৃত হচ্ছে, গৃহযুদ্ধে। এবং তা হচ্ছে কোনওরকম জবাবদিহি না করেই। সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এখনও পদে আছেন কী করে? কী করে তিনি সেই অনুমতি পাচ্ছেন? এই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়া উচিত ছিল, কারণ সেখানে ইতিমধ্যেই আর্টিকেল ৩৫৫ জারি রয়েছে, যদিও তা অত্যন্ত অস্বচ্ছভাবে আনা হয়েছে, লিখিত কিছুই নেই, সবটাই মুখের কথায়। উর্দিধারী বহু আধিকারিককে রাজ্যে আনা হচ্ছে, কিন্তু তাদের হাত বাঁধা, কারণ তারা কিছুই করতে পারবেন না, তখন বলা হবে তারা নৃশংসতা করছেন। খুবই জটিল পরিস্থিতি।” ভারতের গণতন্ত্রের নাগরিক হিসাবে কী চান? “এই দেশের একজন নাগরিক হিসাবে আমি রাষ্ট্রকে এই পরিস্থিতির জন্য জবাবদিহি করতে দেখতে চাই। এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কেন? কেন এই মুখ্যমন্ত্রী তার দায় থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন? ভবিষ্যতে অন্য কোনও মুখ্যমন্ত্রী একই জিনিস করতে পারেন, এই হিংসা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নাগরিক সমাজের কন্ঠস্বর খুবই কম শোনা যাচ্ছে। একটা গণতন্ত্রে যদি নাগরিক সমাজের কন্ঠরুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে তা মৃতবৎ হয়ে যায়,” উত্তরে বললেন প্যাট্রিশিয়া।

XS
SM
MD
LG