যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স লয়েড অস্টিন শুক্রবার, ৯ নভেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অ্যান্টনি ব্লিংকেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও দেখা করেন।
এই ‘২+২ মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা’য় মূলত জোর দেওয়া হয় দুই দেশের নিরাপত্তার সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তোলার উপরে। গত ২০১৮ সাল থেকে ‘২+২’ আলোচনা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে চলছে, দুই দেশের জন্যই জরুরি বিষয়গুলি আলোচনার জন্য ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত করার লক্ষ্যে। কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ অঞ্চলের উন্নয়নের কথাও এই আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায়। আলোচনায় উঠে আসে, যুক্তরাষ্ট্র আশা রাখে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত অগ্রণী ভূমিকা নেবে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানান, মধ্য প্রাচ্যের পরিস্থিতি অবশ্যই খুবই চিন্তার বিষয়।
এই আলোচনায় যেমন ইসরাইল-হামাস সংঘাতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়, তেমনি উঠে আসে কানাডায় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের মৃত্যু। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ করেছিলেন কানাডার নাগরিক এই শিখ নেতার মৃত্যুতে ভারত জড়িত। শুক্রবারের আলোচনায় ব্লিংকেন ভারত সরকারকে অনুরোধ করেন এই মৃত্যুর তদন্তে কানাডার সঙ্গে সহযোগিতা করতে।
এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, দুই পক্ষ পুনরায় জোর দিয়েছে ভারতের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে শিল্পক্ষেত্রে দুই দেশের সহযোগিতা রক্ষা, ভারতের প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদন ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে সহায়তা এবং চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য বজায় রাখায়।
দুই পক্ষ এক চুক্তিতে পৌঁছেছে যেখানে ভারতের বিমানের জন্য ভারতে অবস্থিত হিন্দুস্থান এয়ারোনটিকস-এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত জেনারেল ইলেকট্রিক যৌথভাবে জেট ইঞ্জিন তৈরি করবে এবং ভারতে বিক্রি করা হবে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হওয়া এমকিউ-নাইনবি সিগার্ডিয়ান ড্রোন।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নিজের এক্স হ্যান্ডেল (পূর্ববর্তী টুইটার)-এ আলোচনা শেষে লিখেছেন, “একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ২+২ মন্ত্রীস্তরীয় আলোচনা শেষ হল। এই আলোচনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সফরের পরবর্তী পদক্ষেপ। আমাদের এজেন্ডায় যে বিষয়গুলি আলোচিত হয়, তার মধ্যে রয়েছে আমাদের কৌশলগত পার্টনারশিপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যার মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে আমাদের সম্পর্ক মজবুত করা, মহাকাশ গবেষণা ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নয়ন, লজিস্টিক ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সহযোগিতা বৃদ্ধি ও দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি। এছাড়াও ইন্দো-প্যাসেফিক, দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও ইউক্রেন সংঘাত নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতার বিষয়টি বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হয় ও জোর দেওয়া হয় গ্লোবাল সাউথ-এর বিষয়ে।"
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই আলোচনা বিষয়ে নিজের এক্স হ্যান্ডেল (পূর্ববর্তী ট্যুইটার)-এ লিখেছেন, “২+২ ফরম্যাট ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সার্বিক গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ আরও মজবুত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও আইনের শাসনে আমাদের যে যৌথ বিশ্বাস তাই বিবিধ ক্ষেত্রে আমাদের দুই পক্ষের জন্যই লাভদায়ক সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ভিত্তি। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র পার্টনারশিপ সারা বিশ্বের উন্নতির জন্যই এক সত্যিকারের শক্তি হয়ে উঠতে পারে।”
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার উইমেন’স ক্রিশ্চিয়ান কলেজের রাষ্ট্রনীতির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডঃ জয়িতা মুখার্জি এই আলোচনার বিষয়ে জানালেন, “গত কয়েক বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখছি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। তার কারণ এটাই যে দুই দেশের মধ্যে যে কৌশলগত অবস্থান, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারেস্ট তার একটা সমাবেশ হচ্ছে। দুই দেশই চাইছে বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক এরিয়াতে চীনের অনুপ্রবেশ রুখতে, যাতে ভারতেরও ইন্টারেস্ট আছে আর যুক্তরাষ্ট্রও সেটা চায়। সুতরাং, কাছাকাছি আসার তো যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে এবং দুটো দেশেরই স্বার্থ জড়িত রয়েছে। ভারত অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এই সফরে উন্নত মানের প্রযুক্তি পাবে এই ধরনের আশ্বাস পেয়েছে, বিশেষ করে ডিফেন্স বা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে। এটাও ঠিক যে ভারত, রাশিয়ার উপরে তার যে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, মিলিটারি হার্ডওয়্যার-এর ক্ষেত্রে সেটা থেকে সে একটু সরে আসতে চায়, সেইজন্যই সে এই বিষয়ে অত্যন্ত আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্রও তো অবশ্যই চাইবে, ভারত যা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং এতবড় বাজার সেই দেশকে নিজের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসতে। সুতরাং দুটো দেশের ক্ষেত্রেই বিষয়টা অনুকূল বলেই আমরা এই ঘনিষ্ঠতা দেখছি। তবে এখনও বেশ কিছু ধূসর এলাকা রয়ে গেছে। যার মধ্যে অন্যতম হল, ভারত এখনও রাশিয়ার উপরে জ্বালানির বিষয়ে ভীষণ নির্ভরশীল, তুলনামূলকভাবে কম দামী জ্বালানির ক্ষেত্রে। তবে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আমরা দেখব, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই ধরনের যে সামরিক ও রণকৌশলগত চুক্তি ও বোঝাপড়া সেটা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
এই আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও। সে বিষয়ে ডঃ মুখার্জি জানালেন, “দক্ষিণ এশিয়ার যে দেশটির সঙ্গে ভারতের সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব রয়েছে তা বাংলাদেশ। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে যুক্তরাষ্ট্রেরও সদিচ্ছা থাকবে, কারণ চীনের মোকাবিলায় এই দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নতি বিশেষ প্রয়োজনীয়।”