প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু, চট্টগ্রামের কর্নফুলী নদীর নীচে ইংলিশ চ্যানেলের আদলে টানেল সড়ক, মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট, যানজট জর্জরিত ঢাকায় বৈদ্যুতিক মেট্রো ট্রেন, নাকি নির্মানের প্রায় শেষ পর্যায়ে থাকা বাংলাদেশের প্রথম পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র?
এসব প্রকল্পের কোনটিকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নের সেরা উদাহরণ বলা যায়?
ঢাকার শেরে বাংলা নগরে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের চারপাশে একটা চক্কর দিলেই দেখতে পাবেন এর দেয়ালে থরে থরে শোভা পাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের এমন নানা উন্নয়নের সচিত্র বিজ্ঞাপন।
দেশের সর্বত্রই এমন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের তিন মেয়াদের অর্জন হিসেবে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের যথেষ্ট প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারতের একটি ঐতিহ্যবাহী খবরের কাগজ দ্য স্টেটসম্যান ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক নিবন্ধে লেখে, স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরনির্ভরতার জন্য যে বাংলাদেশ 'বাস্কেট কেস' বলে বিবেচিত হত, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেটি এখন নজিরবিহীন উন্নয়ন দেখছে।
এই বক্তব্যের সাথে একমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক নাজনীন সুলতানা।
"এটা স্বীকার না করার কোন উপায় নেই বাংলাদেশে যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে গত পনেরো বছরে সেটা আসলে তার আগের বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী যে পঁয়ত্রিশ বছরের উন্নয়ন তার চাইতে কয়েক গুণ বেশি", বলছেন তিনি।
জঙ্গিবাদ থেকে উত্তরণ
পনেরো বছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রায় ৪৮০% বেড়েছে উল্লেখ করে দ্য স্টেটসম্যান লিখেছে, "২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের দুর্বল রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার কারণে দূর্নীতি, সহিংসতা, ধর্মীয় চরমপন্থা এবং জঙ্গিবাদে জর্জরিত হয়ে পড়া দেশটির শাসনভার নেয়ার পরেও, শেখ হাসিনার সরকার পুরো পরিস্থিতি বদলে দেয় এবং বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয় উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শান্তি, স্থিতিশীলতা, সম্প্রীতি এবং উন্নতির দিকে।"
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়ণশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের পথেও রয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তিন মেয়াদের উন্নয়নের উদাহরণ তুলে ধরতে গিয়ে আরটিভি অনলাইন গত জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে লিখেছে, "সাবমেরিন কেবল (২০২০ সালে শুরু হয়েছে, শেষ হবে ২০২৪ সালে) থেকে শুরু করে ফ্লাইওভার, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন, যমুনা নদীর বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে শুরু করে করে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রমাণ করে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের এই ১৪ বছরে উন্নয়নের চিত্র কতটা অর্থপূর্ণ ছিল।"
দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছাড়িয়ে গেছে পার্শ্ববর্তী বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারত ও পাকিস্তানকেও।
ড. রাজ্জাক 'হ্যাপি'
তবে সব উন্নয়নের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নকে সবচে এগিয়ে রাখতে চান বিশ্বব্যাংকের সাবেক জেষ্ঠ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
"আট নয় ঘণ্টা পর্যন্ত লোড শেডিং আমরা দেখেছি। সেই ধরণের পরিস্থিতি থেকে অর্থনীতি বেরিয়ে এসেছে। বেশ একটা নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে", বলছেন ড. হোসেন। অবশ্য আরো কম খরচে এটা করা যেত বলে মনে করেন তিনি।
পনেরো বছর ধরে বাংলাদেশের এই যে উন্নয়ন সেটা সন্তোষজনক বলে মনে করেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।
"আমরা হ্যাপি। আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সকল ক্ষেত্রেই হয়েছে", বলছেন ড. রাজ্জাক।
ইশতেহার কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে তিনি এখন এখন কাজ করছেন আগামী পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ভোটারদের সামনে কী কী প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হবে তা নিয়ে।
এই ইশতেহারে কী থাকবে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার আগে জানাতে চাননি ড. রাজ্জাক। তবে জানালেন, মেট্রোরেলের আরো সম্প্রসারণ, ভূগর্ভস্থ রেল চলাচল ব্যবস্থা চালুর মত কিছু প্রতিশ্রুতি তাদের থাকবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
মুদ্রার অন্য পিঠে গত পনেরো বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বারবার উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, দূর্নীতির অভিযোগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে বিদেশে মুদ্রাপাচার সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ এবং দূর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে প্রকল্পের ব্যয় মাত্রাছাড়া হওয়ার অভিযোগ।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের এলিট বাহিনী র্যাব এবং তার কয়েকজন কর্মকর্তার উপর এসেছে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর প্রতিবছর বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০২২ সালে সেই প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে এসব অভিযোগের উল্লেখ আছে।
ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনগুলোর নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ঘাটতি নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন ওঠা এখন এই নির্বাচনের আগে এসেও থেমে নেই।
'গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে'
গত ১১ ডিসেম্বর সাতটি বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠন এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এই সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট, দ্য ইউনাইটেড এগেইনস্ট টর্চার কনসোর্টিয়াম, এশিয়ান ফেডারেশন এগেইন্সট ইনভলান্টারি ডিজএপিয়ারেন্স, এন্টি ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন এগেইনস্ট এনফোর্সড ডিজএপিয়ারেন্স এবং দ্য এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলছেন, "গত পনেরো বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলে দুটো জিনিস আমরা লক্ষ্য করছি। একদিকে উন্নয়ন বা সামর্থ্যের বাইরের উন্নয়ন, আরেকদিকে আমরা দেখছি যে গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে। কথা বলার অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। মানুষের জীবনের যে অধিকার সেটাও অনেক ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের চোখে, স্বাধীনতাবিহীন উন্নয়ন মানুষের জন্য খুব একটা অর্থ বহন করে না।
তিনি বলছেন, "আর্থসামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, মানবাধিকারগুলো আছে - এর মধ্যে, সাংবিধানিক অধিকারগুলো আছে - বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনাতা - এগুলো সবকিছুকে বিসর্জন দিয়ে, পদদলিত করে যে উন্নয়ন অর্থবহ হবে সেটাতো আশা করা খুব কঠিন। শুধু অর্থবহ না, এটা টেকসই হবে সেটাও আশা করাটা কঠিন"।
"এক ধরণের বাবলের মধ্যে হয়তো আমরা আছি", বলছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
"যখনই যারাই রেফার করে বিশেষ করে যারা বিশেষজ্ঞ, তারা বলে যে হ্যাঁ এটা প্রবৃদ্ধির একটি উদাহরণ। কিন্তু তারাই আবার বলে যে বাংলাদেশ ইজ এ ডিলেমা (বাংলাদেশ একটা সংশয়)"।
"এটা সংশয়ের একটা উদাহরণ"।
আ হ ম মুস্তফা কামালের স্বীকারোক্তি
বাংলাদেশে ২০২১-২০২২ সালের যে বাজেট পেশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সেখানে তখন চলমান দশটি মেগা প্রকল্পের জন্য ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রেখেছিলেন তিনি।
ওই বছরের বাজেটের মোট বরাদ্দের তুলনায় এই বরাদ্দ ছিল ৯%।
কিন্তু এসব প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন আছে।
গত বছর নভেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনকে উদ্ধৃত করে দৈনিক যুগান্তর লিখেছিল, বাংলাদেশে পদ্মা সেতু নির্মাণে যে খরচ করা হয়েছে তা দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত।
অনলাইন সংবাদপত্র বাংলানিউজ টোয়েন্টি ফোরকে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মানের উচ্চ ব্যয়ের কথা স্বীকার করেছিলেন।
বাংলানিউজ টোয়েন্টি ফোরে প্রকাশিত ওই খবরের সাথে যে ছবি ছাপা হয়েছিল, তার ক্যাপশনে লেখা হয়েছিল, "বিশ্বের সবচাইতে ব্যয়বহুল উন্নয়ণের দেশ বাংলাদেশ"।
মুস্তফা কামাল সেখানে বলেছিলেন, "ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান, সেখানে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে সড়ক ও রেলপথ তৈরির ক্ষেত্রে অন্য সবার চেয়ে বেশি টাকার প্রয়োজন হয়"।
কিন্তু অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ও টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান এই উচ্চ ব্যয়ের পেছনে সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতিকেও কারণ হিসেবে দেখেন।
ড. জাহিদ-এর 'ভ্যালু ফর মানি'
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, যে কোন উন্নয়ন প্রকল্পের যখন ব্যয় উচ্চ হয়ে যায় তখন 'ভ্যালু ফর মানি' কমে যায়।
"যত টাকা আমরা বিনিয়োগ করেছি, অন্যান্য তুলনামূলক দেশ ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এখানে ৫০-৬০% উচ্চ ব্যয়ে মেগা প্রোজেক্টগুলো হচ্ছে"।
এটা কেন হচ্ছে?
ড. হোসেনের এক কথায় জবাব, "করাপশন"।
"আপনি বলতে পারেন না যে এটা অদক্ষতার কারণ। কারণ আমরা যাদের সাথে তুলনা করছি তাদের প্রশাসন যে আমাদের থেকে দক্ষ তার প্রমাণ কোন তথ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ওইসব দেশেও আছে। ওইসব দেশে দুর্নীতিও আছে।"
'উন্নয়নের নামে লুটপাট'
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন এই প্রশ্নে আরো সোজা সাপটা।
তিনি বলছেন, "সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরণের ধারণা জন্মেছে, আসলে উন্নয়নের নামে লুটপাটের ব্যবস্থাই করা হয়েছে"।
"সম্ভবত গত পনেরো বছরে আমাদের দেশ থেকে প্রচুর অর্থ বিদেশে চলে গিয়েছে লুটের মাধ্যমে। যেমন কোন কোন প্রজেক্ট দেখা গেছে যে পরিকল্পনা ছিল একশ টাকা সেই প্রজেক্ট শেষ হতে আমাদের হয়তো লেগে গেছে কয়েক গুণ।
''এই যে বেহিসেবি খরচ এটার কারণে প্রজেক্ট খরচ যেমন বেড়েছে লুটপাটের মাত্রাও কিন্তু তেমনটি বেড়েছে। এখানে লুট করেছে আমলারা, লুট করেছে ব্যবসায়ীরা, লুট করেছে রাজনীতিবিদরা" বলছেন নূর খান লিটন।
ড. হোসেনের এই 'করাপশন' কিংবা নূর খান লিটনের 'লুটপাট' আরেকটি আশঙ্কার দ্বারও উম্মুক্ত করে বলের মনে করেন টিআইবি'র ড. ইফতেখারুজ্জামান।
"যে সমস্ত দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা গভীরতা বেশি সেই সমস্ত দেশে আবার মানবাধিকার লঙ্ঘনটা বেশি। সেই সমস্ত দেশে ডেমোক্রেটিক প্রাকটিসের ইন্ডিকেটরগুলো তুলনামুলক দুর্বল। আমরা এর মধ্যে পড়ে গেছি । কাজেই এর মধ্যে উৎকণ্ঠার যথেষ্ট আশঙ্কা আছে।"
অবশ্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি হয়েছে বলে মানতে চান না ড. রাজ্জাক।
তিনি বলেন, "জবাবদিহিতার উর্ধে কেউ নয়।"
প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগ থাকলে সেটা ধরার জন্য অডিট বিভাগ আছে, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা আছে।
"সেটা যদি আমরা করে থাকি তাহলে আমাদেরতো জবাবদিহি করতে হবে," বলেন ড. আব্দুর রাজ্জাক।
যেটা 'বিজনেস' সেটাই 'পলিটিক্স'
বিগত পনেরো বছরে বাংলাদেশে যেমন হয়েছে অনেক বিশ্বমানের অবকাঠামো, বাস্তবায়ন হয়েছে একের পর এক মেগা প্রকল্প সেই একই সাথে দেখা গেছে অতি ধনীর সংখ্যায় বিরাট উর্ধগতি।
যুগান্তরে ২০২০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অতি দ্রুত ধনী হওয়ার গতি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় বাংলাদেশের মোট সম্পদের ৩৮% রয়েছে মোটে ১০% মানুষের হাতে।
কিন্তু অতি ধনী বাড়ার পাশাপাশি দেশটির হতদরিদ্ররা আরো দরিদ্র হয়েছে। বেড়েছে অতি দরিদ্রের সংখ্যাও।
এই প্রতিবেদনের জন্য যে কয়জন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের সবাই একবাক্যে আয় বৈষম্যের ব্যাপারটি সামনে এনেছেন।
ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, এই আয় বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার মূল কারণই হচ্ছে দুর্নীতি ও সুশাসনের ঘাটতি।
তিনি বলছেন বাংলাদেশের 'নীতি কাঠামো দখল' হয়ে গেছে।
এই নীতি কাঠামো দখল হয়ে যাওয়ার অর্থ কী?
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, "কিছু সংখ্যক মানুষ, যারা ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে রাষ্ট্রকাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, প্রভাব ফেলতে পারে, নীতি কাঠামোকে দখল করতে পারে। এই ধরণের প্রভাবশালী মহল যেটা আমাদের দেশে দৃশ্যমানভাবেই বিকাশ ঘটেছে বিজনেস এবং পলিটিক্সের লিংকেজের কারণে"।
"বহুকাল যাবৎই বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেটা হয়েছে যে বিজনেস এবং পলিটিক্স একাকার হয়েছে। যেটা বিজনেস সেটাই পলিটিক্স, যেটা পলিটিক্স সেটাই বিজনেস। পলিটিক্সটাকে এখানে বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হয়"।
"কিছু কিছু বিজনেস সেক্টর - যেমন আরএমজি বা পাওয়ার সেক্টর, এগুলো সব বেশ প্রকটভাবেই কিন্তু বিজনেস লবির নিয়ন্ত্রণে। এই ধরণের খাতগুলি কী ধরণের সিদ্ধান্ত নেবে সেটা সংশ্লিষ্ট সরকার বা কতৃর্পক্ষ বা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে না। এটা নির্ধারণ করে প্রভাবশালী ঋণখেলাপি বা পলিটিকাল নেতারা এবং সেটাই কর্তৃপক্ষ মেনে নেয়। যেটাকে আমি বলি যে নীতি কাঠামো দখল", বলছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
"সে কারণে উন্নয়নের সুফলটা অবারিতভাবে একশ্রেণি পাচ্ছে যাদের ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে"।
নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য উন্নয়ন
ড. ইফতেখারুজ্জামান যাদেরকে নীতি কাঠামো দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, ড. জাহিদ হোসেনও মনে করেন, উন্নয়ন যেটুকু হচ্ছে তার সবটুকু সুফলই তারাই ভোগ করছে।
আয় বৈষম্য সব দেশেই আছে তবে ড. হোসেন বলছেন, "বাংলাদেশ অন্য দেশকে ছাড়িয়ে গেছে।"
আর যেসব অবকাঠামো উন্নয়নের উদাহরণ বারবার সামনে আসছে, সেটার যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন আছে ড. হোসেনের।
"কংক্রিটলি যদি দেখেন, তাইলে এই পদ্মা ব্রিজ, মেট্রো রেল, দুএকটা পাওয়ার প্লান্ট আর কিছু রিজিওনাল হাইওয়েজ, এগুলা ছাড়া আর কী আইডেন্টিফায়েড? এমনতো না যে আপনার প্রাতিষ্ঠানিক স্ট্রেনথেনিং হইছে? তাতো হয় নাই। বরং প্রতিষ্ঠানগুলো দিনকে দিন দুর্বল হয়েছে"।
ওদিকে বিদেশি ঋণ বা জমানো বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বড় বড় ব্যয়বহুল প্রকল্প তৈরি নিয়েও এক ধরণের সংশয় রয়েছে। সরকারের তরফ থেকে একটা দাবি করা হয়ে পদ্মা সেতু নির্মানের ক্ষেত্রে বিদেশি ঋণ নেয়া হয়নি।
কিন্তু বাকি সব মেগা প্রজেক্টই ছিল বিদেশি ঋণ নির্ভর।
একদিকে বৈদিশেক ঋণ এবং অন্যদিকে কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব - সব মিলে বিগত মাসগুলোতে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার এক বেশ ভালরকম ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশকে গত বছর অগাস্ট মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে সাড়ে চারশো কোটি ডলার ধার চাইতে হয়।
এর আগে এত বড় আকারের ঋণ কখনো আইএমএফ-এর কাছে চাইতে হয়নি দেশটিকে।
নূর খান লিটন বলছেন, "আমরা প্রায় অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। এই অবস্থা সামাল দিতে আমাদের হয়তো ২০২৪ সালে অনেক বেগ পেতে হবে এবং আমি জানি না অর্থনীতির কী ভয়াবহতার মধ্যে আমরা পড়তে যাচ্ছি।"
অবশ্য আওয়ামী লীগ এমন মনে করে না। দলটির দাবি বাংলাদেশ তাদের হাত ধরে সঠিক পথে আছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মেগা প্রজেক্ট পদ্মা সেতু ২০২২ সালের জুন মাসে চালু হওয়ার কয়েকদিন পরেই একটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হয় আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে।
সেখানে লেখা হয়, "গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন - এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অন্যতম দর্শন। বঙ্গবন্ধুর সেই মানবিক রাষ্ট্রদর্শনই বাস্তবায়ন করে চলেছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা।"
যদিও এই প্রতিবেদনের জন্য সাক্ষাৎকার দিয়েছেন যেসব বিশেষজ্ঞরা, তারা মনে করেন শুধু অবকাঠামো উন্নয়নের সাথে যদি, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন না করা হয়, তাহলে সেই উন্নয়ন কতটা কল্যানমুখী, কার্যকর ও টেকসই হবে সেটা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়।