কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীর ক্ষমতায়ন বা সামাজিক মর্যাদা বাড়েনি; এ কথা বালেছেন বাংলাদেশের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম।
উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে ইউএনবিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, “অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে নারীদের কথা বলার জায়গা তৈরি করে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাগুলোতে নারীদের নিয়ে আসতে হবে।”
“নারী পরিচয়ের আগে আমার বড় পরিচয় হলো, আমি একজন মানুষ। নারী-পুরুষের মধ্যে যে ভেদাভেদ তৈরি, নারীকে হেয় করা হচ্ছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরুষের থেকে দুর্বল মনে করা হচ্ছে এবং এ কারণে নারীকে অধস্তন করে রাখতে হবে, এটা সম্পূর্ণ অমূলক; যোগ করেন অধ্যাপক সাদেকা হালিম
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের মূল্যায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন হয়েছে, যে সমাজে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের নারী ও পুরুষ সমান। বাস্তবে কোনো দেশই খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে নারীকে পুরুষের সমান ভাবা হয়।
“সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রেই নারীত্ব নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। সেটা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাঙ্গন, ভাগ-বাটোয়ারার ক্ষেত্রে, এমনকি ধর্মীয়ভাবে এমনটা হচ্ছে। পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীকে সমান অধিকার দেয়া হচ্ছে;” সাদেকা হালিম উল্লেখ করেন।
তিনি আরো বলেন, নারীর সন্তান জন্ম দেয়ার বিষয় নিয়েও রাজনীতি করা হয়। সন্তান জন্মের পর পরই সন্তানের অধিকার কীভাবে হবে সেটা ধর্মীয়ভাবে নির্ধারণ করা হয়।
“বাবা ও মায়ের অধিকার কতটুকু, আমাদের সিভিল ল’তে কতটুকু, শরিয়া ল’তে কতটুকু, এসব বিষয় অনেকটাই পুরুষকেন্দ্রিক। পুরুষকে সব সময় প্রাধান্য দেয়া হয়। পুরুষরাই এ সমাজের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে;” যোগ করেন অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে ড. সাদেকা উল্লেখ করেন যে এ অঞ্চলে নারীর ক্ষমতায়ন যে এখন হয়েছে, তা নয়। অবিভক্ত ভারতে নারীরা কিন্তু ইউরোপের নারীদের আগেই ভোটাধিকার পেয়েছিলো; জানান তিনি।
অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় নারীরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, রাণী হয়েছে, ট্যাক্স সংগ্রহ করেছে। আধুনিক রাষ্ট্রে পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের কাজের পরিধি বেড়েছে; তবে নারীদের পণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। নারীর কাজ কে কাজ হিসেবে দেখা হয় না। নারীরা স্ত্রী, মা বা মেয়ে হিসেবে যে ভূমিকা পালন করে তাও অবমূল্যায়ন করা হয়।
“কোনো নারী চাকরি করলেও, তাকে আমরা প্রশ্ন করি তার স্বামী কী করে। সে যদি স্বামীর থেকে বেশি বেতন পায়, তাহলে পুরুষও হীনমন্যতায় ভুগে;” জানান অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
সমাজের সাধারণ নারীদের অবস্থা সম্পর্কে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তো নারীদের মধ্যে অনেকের হয়েছে। গার্মেন্টস সেক্টর, চিংড়ি মাছের ঘের, কল-কারখানায় নারীরা কাজ করছে। এদিক থেকে ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে অনেক বেশি হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, “কিন্তু নারীর সামাজিক মর্যাদা কি বেড়েছে?” বলেন, এটা খুবই জটিল একটা বিষয়।
চরম দারিদ্র্যের শিকার নারীরা কোনো কিছু ভাবে না বলে উল্লেখ করেন ড. সাদেকা হালিম। বলেন, তারা জানে তাদের কাজ করতে হবে, ক্ষুধা মেটাতে হবে, তারাই শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে।
“সাধারণ নারীরা অনেক পরিশ্রমী, সামাজিক সমালোচনা গ্রাহ্য না করে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছে। কিন্তু, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তাদের বাদ দেয়া হচ্ছে; বলেন তিনি।
নারীর সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “আমরা নারীর নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে পারিনি। বাংলাদেশে বা প্রবাসে; আমরা দেখি নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়। খুব নিকট আত্মীয়ের মাধ্যমেও ধর্ষণের শিকার হয় নারী।”
তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, এবং এবারকার কেবিনেটে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নারী মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হয়ে আসছেন।
“এটা ইতিবাচক দিক। সংখ্যার দিক থেকে নারীর অংশ গ্রহণ অনেক বেশি, কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন বা সামাজিক মর্যাদার জায়গায় গুণগত মানের দিক থেকে কতটা বদলেছে, সেটাই বড় বিষয়। যখন নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে আসবে, নেতৃত্ব দেবে, সমাজ কিন্তু তখনই বদলাবে;” বলেন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম।