বাঙালির ইতিহাসের কালরাত ভয়াল ২৫ মার্চ। বাংলাদেশে দিনটি জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৭১ সালে, নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো গণহত্যার ভয়াবহ স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাসের এক অধ্যায় এই ভয়াল রাত।
পঁচিশে মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় জাতীয় সংসদে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ। সেই থেকে, দিনটি জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি উঠেছে।
‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের অপারেশনে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
নানা আয়োজনে দিবসটি বাংলাদেশে পালিত হয়। শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয় সেই ভয়াল রাতে প্রাণ দেয়া হাজারো মানুষকে।
দিনের অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আলোচনা, প্রদীপ প্রজ্বলন ও স্মরণ অনুষ্ঠান। সারা দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।
আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির দাবি
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যা দালিলিকভাবে প্রমাণিত বলে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন বক্তারা।
সোমবার (২৫ মার্চ) জাতীয় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাব আয়োজিত আলোচনা সভায় এ দাবি জানান তারা।
বক্তারা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের দেশীয় দোসরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ‘অপারেশন সার্র্চলাইট’ নামে যে গণহত্যা চালিয়েছিলো, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সরাসরি লংঘন।
এ নৃশংস গণহত্যার চিত্র দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচার হয়েছিলো। এছাড়া নানা দালিলিক প্রমাণ দ্বারা এ গণহত্যা প্রমাণিত। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর বেশি পার হয়ে গেলেও, আনুষ্ঠানিকভাবে একাত্তরের সেই ভয়াল গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি।
এটি আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের অবজ্ঞা বলে মনে করেন তারা।
‘১৯৭১ এর গণহত্যা ও বিশ্ব স্বীকৃতি’ শীর্ষক এ গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান খান, বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
প্রধান অতিথি শাহজাহান খান বলেন, “এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ২৫ মার্চের গণহত্যার জাতীয় স্বীকৃতি পেতে ৪৭ বছর লেগেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর, দীর্ঘদিন যেসব সরকার ক্ষমতায় ছিলো, তারা সুপরিকল্পিতভাবে ২৫ মার্চের কালরাতে সংঘটিত হওয়া গণহত্যার ইতিহাস মুছে ফেলতে চেয়েছে।”
তিনি উল্লেখ করেন যে গণহত্যার জাতীয় স্বীকৃতি মিললেও, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি।
আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ২৫ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তথ্য উপাত্তসহ নতুন প্রজন্মের কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে যেসব বধ্যভূমি রয়েছে সেগুলোর তথ্য উপাত্তসহ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উপস্থাপন করতে হবে;” তিনি যোগ করেন।
প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যাকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তার প্রতিটি মানদণ্ডে ২৫ মার্চের গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি রাখে। এ দাবির সঙ্গে সাংবাদিক সমাজ একাত্মতা প্রকাশ করছে।
প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন যে বাংলাদেশের বধ্যভূমিগুলোর অবস্থা করুণ এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এখনো কোনো জেনোসাইড মিউজিয়াম স্থাপন করা যায়নি। “ এটা অত্যন্ত দুঃখজনক;” বলেন তিনি।
গণহত্যা স্থানের মাটি সংগ্রহ করে শ্রদ্ধা
২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে নওগাঁয় স্থানীয় সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদের আয়োজনে ১৩২টি গণহত্যার স্থানের মাটি সংগ্রহ করে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।
সোমবার সকালে শহরের মুক্তির মোড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভের পাশে শ্রদ্ধা জানানো হয়। সেখানে ১৩২টি গণহত্যার স্থানের মাটি সংগ্রহ করে আলাদা আলাদা পাত্রে রেখে তাতে গোলাপ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
পরে সেখানে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ও মাটি সংগ্রহ কাজের কর্মী এম, এম রাসেল বলেন, এখনো পর্যন্ত জেলায় জরিপ করে দেখা গেছে ১৩২টি স্থানে গণহত্যা চালানো হয়েছে।
তিনি বলেন, এ গণহত্যার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, শহীদদের নাম, তাদের ঠিকানা, পেশা, বয়স সংগ্রহ করতে প্রায় ১১ বছর ধরে কাজ করা হয়েছে। ১৩২টি গণহত্যা স্থানের মাটি সংগ্রহ করা হয়েছে বদ্ধভূমি বা গণকবরের স্থান থেকে।
তিনি জানান, শহীদদের এই রক্তস্নাত মাটি সংগ্রহ করতে সময় লেগেছে দুই মাসের মতো।
এম এম রাসেল আরো বলেন, “আমাদের দাবি, গণহত্যায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের স্বীকৃতি, গণহত্যার স্থানগুলোকে চিহ্নিত করে স্মৃতিফলক নির্মাণ এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদদের সম্মাননা দেয়া এবং তাদের তালিকাভুক্ত করা।”
সংগঠনটির সভাপতি আইনজীবী ডিএম আব্দুল বারি বলেন, “একুশে পরিষদের উদ্যোগে প্রতিটি স্থান শনাক্ত করে সরকারকে দেয়া হয়েছে। যাদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই দেশ, স্বাধীনতা। তাদের স্মরণ করতে হবে। এদের জাতীয়ভাবে সম্মান করতে হবে।”