আনন্দ উল্লাস আর বিশ্বমানবের মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে উদযাপিত হলো বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস বেশ প্রচীন। তবে নব পর্যায়ের বর্ষবরণের অনত্যম প্রধান অনুসঙ্গ ঢাকার রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের বৈশাখ আবাহন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের মঙ্গল শোভাযাত্রা।
রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন
প্রথা ও ঐতিহ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার রমনা উদ্যানের বটমূলে পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রবিবার(১৪ এপ্রিল) সকাল সোয়া ৬টায় দেশের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট পরিবেশন করে মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
মর্তুজা কবির মুরাদের 'রাগ আহীর ভৈরব' সুরে মন্ত্রমুগ্ধকর বাঁশি পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই সাংস্কৃতিক উৎসব। দেশের বিশিষ্ট শিল্পীদের পরিবেশনা, গান, আবৃত্তি ও অন্যান্য পরিবেশনা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, ১১টি কোরাস গান ও ১৫টি একক গান এবং ৩১টি একক পরিবেশনা উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে; সত্যম কুমার দেবনাথ, খায়রুল আনাম শাকিল, চন্দনা মজুমদার, তানিয়া মান্নান, রামেন্দু মজুমদার, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়সহ প্রখ্যাত শিল্পীরা প্রকৃতি, মানবপ্রেম, আত্মশুদ্ধি ও দেশপ্রেমের বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
নতুন বাংলা বর্ষপঞ্জি ১৪৩১ সনকে স্বাগত জানাতে রাজধানীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে উৎসবস্থলে সমবেত হয় মানুষ। মেতে উঠে নাচে, গানে, আনন্দ উল্লাসে।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে, নতুন বছরের ভাষণ পাঠ করেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ড. সারওয়ার আলী। দলগত জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে অনুষ্ঠানের।
সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী এবং ১৩তম হুসার্স ওপেন রোভার স্কাউট গ্রুপের স্বেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি ছায়ানটের স্বেচ্ছাসেবকরা অনুষ্ঠানস্থলে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালে। আর, ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতিবছর রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন করছে ছায়ানট। ব্যতিক্রম ছিলো ১৯৭১ সালে; বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। আর, ২০২০ ও ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা বাংলাদেশের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষিত উৎসব হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি বিশ্বের অন্যতম নিয়মিত সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা
পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদ থেকে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়।
ঐক্য, সাংস্কৃতিক গর্ব ও স্থিতিস্থাপকতার প্রতীক এই শোভাযাত্রা। এটি ঐতিহ্যবাহী শিল্পীসত্তা ও চেতনার মন্ত্রমুগ্ধকর প্রদর্শনী।সকাল ৯টা ১৮ মিনিটে শুরু হয় এই শোভাযাত্রা।
মঙ্গল শোভাযাত্রা শাহবাগ, ঢাকা ক্লাব এবং শিশু পার্কের মতো ঐতিহাসিক স্থান হয়ে, ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা অতিক্রম করে। বর্ণিল পোশাকে সজ্জিত ও প্রতীকী নিদর্শন সম্বলিত শোভাযাত্রা বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলত করে এবং আনন্দ-উল্লাসে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়।
সৃজনশীলতা ও শৈল্পিক প্রকাশকে লালনের জন্য পরিচিত চারুকলা অনুষদ। এই প্রতিষ্ঠানটি সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের সূচনা স্থান। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এই আয়োজনে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যের প্রচার ও সংরক্ষণের প্রতি অঙ্গীকারের দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠে।
শোভাযাত্রাটি টিএসসিতে সমাপ্তির পথে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার বাতাস হর্ষধ্বনি, সংগীত এবং অংশগ্রহণকারী ও দর্শকদের সম্মিলিত উল্লাসে অনুরণিত হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু বাংলা নববর্ষের আগমনই উদযাপন করে না, প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঙালি জনগণের সহনশীলতা ও চেতনার সাক্ষ্য বহন করে।
আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে, এই জাতীয় আয়োজন ঐক্য, স্থিতিস্থাপকতা ও একাত্মতার বোধকে লালন করার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্ব নিশ্চিত করে; এমন মত প্রকাশ করেন শোভাযাত্রায় যোগ দেয়া মানুষ।
বাংলা সনের কথা
পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে উদযাপিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হিসেবে উদযাপন করা হয় বাংলা নববর্ষকে।
বাংলা পিডিয়া অনুসারে, এক সময় নববর্ষ উদযাপিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ঋতুনির্ভর। কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মুগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসন-আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)। হিজরি চান্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিলো, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়।
বাংলা নববর্ষ আকবরের সময় থেকে থেকে উৎসবের রূপ লাভ করে। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করতো। পরদিন, নববর্ষে সাধারণ মানুষকে মিষ্টিমুখ করাতেন ভূস্বামীরা।
এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভ দিন হিসেবে উদযাপিত হতে থাকে।
বাংলা নববর্ষের অন্যতম উপাদান হালখাতা। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে, নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরাতন খরিদদারদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজো পালিত হয়।
নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত নববর্ষে তারা বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং সকালে স্নান সেরে পূত-পবিত্র হয়।
দিনটিতে ভালো খাওয়া, ভালো থাকা এবং ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করে। নববর্ষে ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি-পিঠা-পায়েস সহ নানা রকম লোকজ খাবারের আয়োজন থাকে ঘরে ঘরে। থাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়। প্রিয়জনকে উপহার দেয়ার মাধ্যমে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়; যা শহরাঞ্চলে বহুল প্রচলিত।
নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা। এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোক শিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়।