মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত শহর মায়াওয়াদ্দির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে লড়াইয়ে কারণে এপ্রিল মাসে হাজার হাজার শরণার্থী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র থাইল্যান্ডে চলে যায়।
তবে লড়াই কিছুটা থামার কারণে অনেকে মিয়ানমারে ফিরে গেলেও আরও অনেকে সংঘাত থেকে পুরপুরি বাঁচতে চাইছেন।
সামরিক অভ্যুত্থানের তিন বছরের বেশি সময় ধরে মিয়ানমার একটি সংকটময় সময় অতিবাহিত করেছে। সেখানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো উল্লেখযোগ্য এলাকা দখল করেছে এবং মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন হামলা শুরু করেছে।
অক্টোবর মাসের পর থেকে সশস্ত্র জাতিগোষ্ঠীগুলি সান রাজ্য এবং রাখাইন রাজ্যে সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে।
তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসে কারেণ ন্যাশনাল ইউনিয়ন বা কেএনইউ-এর মাধ্যমে। এপ্রিল মাসের শুরুতে কেএনইউ ঘোষণা করে যে তারা মায়াওয়াদ্দির নিয়ন্ত্রণের থাকা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর শতশত সেনা সদস্যকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করেছে।
জান্তা এরপরে মায়াওয়াদ্দিতে একটি ঘাঁটি দখল করে তাদের অবস্থান পুনরায় ফিরে পেলেও তারা কেএনইউ ও তার মিত্রদের থেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে দখল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, জান্তা বাহিনী সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মায়াওয়াদ্দির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
এই সীমান্তবর্তী শহর দিয়ে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মধ্যে প্রতি বছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা বাণিজ্য হয়ে থাকে।
মায়াওয়াদ্দির একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সো থো কিউই। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পর থেকে শহরের পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।
মায়াওয়াদ্দির মুদি দোকান
তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “তীব্র সংঘাতের সময় আমাকে এক রাতে মিয়ানমারের সীমান্তের কাছাকাছি জায়গায় আশ্রয় নিতে হয়েছিল।” তিনি বলেন, “পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ঠান্ডা হওয়ার পর আমি বাড়িতে ফিরে আসি। কিন্তু, সংঘাতের কারণে আমি দীর্ঘসময় এখানে তো থাকতে পারব না।”
তিরিশ বছর বয়স্ক সো থো কিউই মায়াওয়াদ্দিতে একটি মুদি দোকান আছে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে সরকার বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াই চলার কারণে শহরের মানুষের দৈনন্দিন জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
মায়াওয়াদ্দিতে বর্তমানে কোনো পুলিশ নেই, এমনকি ট্রাফিক পুলিশও নেই। অধিকাংশ সরকারি অফিস-আদালত বন্ধ। শহরে কোনো লড়াই চলছে না কিন্তু তারপরও মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, “অনেক অসামরিক লোকজন কামানের গোলাবারুদ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
এই ধরণের অনিশ্চয়তার মাঝে তার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, আর সে কারণেই সো থো কিউই-কে মিয়ানমার ত্যাগ করার পরিকল্পনা করতে ভাবিয়ে তুলছে।
তিনি বলেন, “রাস্তা বন্ধ থাকার জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার মতো জিনিষ মজুদ থাকেনা। মায়াওয়াদ্দিতে সংঘাতের কারণে আমাদের ব্যবসার ভীষণ ক্ষতি হয়েছে। আমরা খুব খদ্দেরই দেখতে পাচ্ছি, যার অর্থ হচ্ছে বিক্রিও কমে গিয়েছে এবং কখনও কখনও আমাদের দোকান বন্ধ রাখতে হয়।
“বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি এবং জিনিষের দাম বাড়ার সাথে সাথে সবকিছু কঠিন হয়ে পড়েছে। যখন পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে তখন আমরা দুশ্চিন্তায় পরে যাই যে চোরেরা আমাদের দোকান টার্গট করবে। এথেকে বোঝা যায় যে মায়াওয়াদ্দি কতটা অনিরাপদ হতে পারে। আমার একমাত্র বাস্তব সম্মত বিকল্প হচ্ছে থাইল্যান্ডে স্থানান্তরিত হওয়া,” তিনি বলেন।
কারেন বাহিনী প্রত্যাহার
কেএনইউ তাদের বাহিনীকে শহরের একটি ঘাঁটি থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিলেও এপ্রিল থেকে লড়াই অব্যাহত রয়েছে। থাই কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ২০ এপ্রিল বার্তা সংস্থা এপির খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে অন্তত ১ হাজার ৩০০ শরণার্থী থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে।
তবে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে কারণ, যেসব স্বেচ্ছাসেবী শরণার্থীদের সাহায্য করছে, তারা বার্তা সংস্থা ‘মিয়ানমার নাও’ কে বলেছেন যে সীমান্ত শহরটিতে লড়াই সাময়িকভাবে শান্ত হওয়ার কারণে তিন হাজার মানুষ মিয়ানমারে ফিরে এসেছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে থাইল্যান্ডের ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার (১,৪৯১ মাইল) দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে।
থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী শহর মায়ে সট। ঐ শহরটি মায়াওয়াদ্দি থেকে মোয়েই নদীর ওপারে অবস্থিত। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার থেকে হাজার হাজার মানুষ সেখানে যায় এবং অনেকে যুদ্ধের কারণেও সেখানে পালিয়ে যাচ্ছে।
সংঘাতের কারণে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমার থেকে প্রায় এক ডজন শরণার্থী মায়ে সটেতে পালিয়ে যায়।
আইয়ারওয়াদি এলাকার পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক কিয়াও জিন উ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, সামরিক জান্তার বাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ এড়ানোর জন্য তার মিয়ানমার ত্যাগ করা দরকার ছিল।
“আমি এখানে এসেছি ১৭ দিন আগে। আমার সামনে দুটো পথ খোলা ছিল, মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া অথবা এখানে আসা। আমি থাইল্যান্ডে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি কারণ এখানে অন্তত একটি ভবিষ্যত আমি দেখতে পাই। আমার বন্ধুরা বিপ্লবে যোগ দিয়েছে। আমিও যোগ দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। তবে আমি এখন থেকেও তাদের সাহায্য করতে পারি। যেমন অর্থে দিয়ে এবং তাদের জন্য খাবার পাঠিয়ে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য শরণার্থীরা বলেছেন, সামরিক বাহিনী-বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে জান্তা তাদের এবং তাদের পরিবারকে টার্গেট করেছিল বলে তারা মিয়ানমার ত্যাগ করেছেন।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদানের বিষয়ে একটি আইন প্রণয়ন করে। তারা ১ কোটি ৪০ লক্ষ নর-নারীকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের যোগ্য বলে ঘোষণা করেছে এবং বছরে অন্তত ৬০ হাজার জনকে তারা বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগ করবে।
সেনাবাহিনীতে রোহিঙ্গা
দ্য ইরাওয়াদ্দি পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা সম্প্রদায় থেকে সৈন্য নিয়োগ করছে, যদিও ২০১৭ সালে এই জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সামরিক বাহিনীর হাতে জঘন্য হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা প্রতিহত করতে সামরিক জান্তা তাদের বাহিনীকে শক্তিশালী করার দিকে নজর দিয়েছে।
ইয়াঙ্গুনের এক কৃষক চি লিন কো মায়ে সতের একটি মহাসড়কের কাছে একটি বাঁশের তৈরি কুঁড়েঘড়ে বসে তার পরবর্তি পদক্ষেপের কথা চিন্তা করছেন। উনিশ বছর বয়সী ঐ কৃষক এক মাস আগে মিয়ানমার থেকে এসেছেন।
কিন্তু সামরিক বাহিনীর জন্য যুদ্ধ করার সম্ভাবনা তাকে আতঙ্কিত করে তোলে।
“আমি আমার বাড়িতে একটি (সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক) প্যাম্ফলেট বা বিজ্ঞপ্তি পেয়েছিলাম। আমার প্রতিবেশীরা যোগ দিয়েছিল, কিন্তু আমি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে চাইনি বলেই এখানে এসেছি। আমি শুনেছি বেতন দেওয়া হয়, কিন্তু সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরে কোন ক্রমেই সেনাবাহিনী ত্যাগ করতে পারব না।
চিট লিন কো যদি কখনো অস্ত্র হাতে তুলে নেন, তাহলে তা মিয়ানমার সেনাবাহিনী (বা টাট্মাডও)-র পক্ষে হবে না। তিনি বলেন, “আমার পরিবার না থাকলে আমি বিল্পবী দলে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতাম।”
ঐ তরুণের মিয়ানমার ছাড়ার অন্যতম কারণ ছিল তার পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা।
বিশ্বব্যাংকের ডিসেম্বর মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সংঘাত দেশটির অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ কমেছে।
“আমার পরিবার আছে এবং আমাকেই তাদেরকে দেখাশোনা করতে হয় আর তাই আমার উপার্জন করতে হবে” জানালেন চিট লিন লো।
জাতিসংঘ বলছে, তিন বছর আগে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের অন্তত ৪৫,000 শরণার্থী থাইল্যান্ডে প্রবেশ করেছে।
যদিও থাইল্যান্ড সরকার সম্প্রতি "এক লক্ষ" মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীকে স্বাগত জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তবে থাইল্যান্ড ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনের পক্ষ নয় এবং শরণার্থীর ও আশ্রয়প্রার্থীদের সুরক্ষার জন্য অভ্যন্তরীণ কোন নির্দিষ্ট আইনি ফ্রেমওয়ার্ক বা কার্যবিধি নেই।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে এবং ২৬,০০০-এর বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।