রবিবার কলকাতার ঘুম দেরিতে ভাঙে। ইদানীং শহরাঞ্চলে অনেক জায়গায় সকাল ৮টাতেও ভাল করে বাজার বসে না। অথচ সেদিন ব্যারাকপুরে সকাল থেকে হই হই ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জনসভা সকাল সাড়ে ১১টায়। এত সকাল সকাল কারণ মাত্র এক-দেড়শ কিলোমিটার পরিধির মধ্যে সেদিন পশ্চিমবঙ্গেই পর পর চারটি সভা প্রধানমন্ত্রীর।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ভোটের প্রচার নিয়ে দশ বছর আগেও একটা শব্দ প্রচলিত ছিল। তা হল কার্পেট বম্বিং। এও এক প্রকার তাই। তামাম পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারতবর্ষের এই সাধারণ নির্বাচনে কোনও ওয়েভ বা তরঙ্গ নেই। হিন্দিবলয় এবং দক্ষিণ ভারতের বহু রাজ্যে পৌঁছে গেলে মনে হতে পারে, এখানে আদৌ ভোট হচ্ছে কি! কিন্তু বাংলা তেমন নয়। বিমানবন্দরে নামা ইস্তক মনে হবে, ভোট বুঝি শুধু এই এখানেই।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলা ছিল বিজেপির কাছে একেবারেই অধরা। ১৯৯৯ সালে তৃণমূলের শরিক হয়ে বিজেপি একবার লোকসভায় দুটি আসনে জিতলেও, তাতে একার কৃতিত্ব ছিল না। ২০১৪ সালে দেশজুড়ে চরম মোদী হাওয়াতেও বাংলায় কেবল মাত্র ২টি আসনেই জিতেছিল তারা। তবে হ্যাঁ, তাদের ভোট শতাংশ বেড়ে হয়েছিল ১৭।
কিন্তু ,২০১৯ সালের লোকসভা ভোট থেকেই বাংলায় ভোটের হাওয়া অনেকটা বিজেপির অনুকূলে। হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলিতে বিজেপি সম্পৃক্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছে। সেখানে আসন বাড়ানোর আর সুযোগ নেই। এই অবস্থায় হাতে গোনা যে কটি রাজ্যে বিজেপি তাদের আসন বাড়ানোর সম্ভাবনা দেখছে, তার মধ্যে পয়লা নম্বরে রয়েছে বাংলাই।
কৌতূহলের বিষয় হল, বিজেপি এভাবে বাড়ল কীভাবে? এবং এবার বাংলায় ভোটের পরিস্থিতি কেমন?
এর উত্তর সন্ধান করতে গেলে পাঁচ বছর আগে ফিরে যেতে হবে। দেখা যাবে, বাংলার বিধানসভায় প্রধান বিরোধী শক্তি কংগ্রেস। তাদের সঙ্গে রয়েছেন বামেরা। কিন্তু বাস্তবে অর্থাৎ বিধানসভার বাইরে তৃণমূলের মোকাবিলা করতে দেখা যাচ্ছে শুধু বিজেপিকেই। ২০১৯ সালের সেই লোকসভা ভোটে বাংলায় নির্বাচন হয়েছিল একেবারে স্থানীয় ইস্যুতে। দেশের ভোট, অথচ নির্বাচনে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার যাবতীয় সামগ্রী ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বায়ুসেনা জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর উগ্র জাতীয়তাবাদের স্রোত বইছিল কুল কুল করে।
অর্থাৎ ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে দু’রকমের মেরুকরণ ঘটেছিল বাংলায়। এক প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার প্রশ্নে তৃণমূল বনাম বিজেপি লড়াই। এবং তারপর ধর্মীয় মেরুকরণ।
এই রসায়নের ফলাফল কী হয়েছিল তা ২০১৪ সালের ভোটের ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যাবে। বিজেপির ভোট এক লাফে ১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ৪০.৬৪ শতাংশ। ২০১৪ সালের ভোটে বাংলায় তারা ৮৭ লক্ষের মতো ভোট পেয়েছিল। সেই ভোট বেড়ে হয় ২ কোটি ৩০ লক্ষ।
তবে তৃণমূলের ভোট কিন্তু কমেনি। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল ৩৯.৭৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। তখন তাদের আসন সংখ্যা ছিল ৩৪। তারা সেবার মোট ২ কোটি ৩ লক্ষ ভোট পেয়েছিল। আর ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল পেয়েছিল ৪৩.৬৯ শতাংশ ভোট। মোট ২ কোটি ৪৭ লক্ষ ভোট পেয়েছিল তারা। কিন্তু আসন কমে হয়েছিল ২২।
বিজেপি আর তৃণমূলের এই বর্ধিত ভোট তুলনা করলে দেখা যাবে ২০১৪ সালের তুলনায় শুধু সিপিএমের ভোট কমে গেছিল ১৭ শতাংশ। তাদের ভোট ১ কোটি ১৫ লক্ষ থেকে নেমে এসেছিল ৩৬ লক্ষে। কংগ্রেসেরও ভোট ৪ শতাংশ তথা ১৭ লক্ষ কমেছিল।
অর্থাৎ এক, তৃণমূলকে মোকাবিলায় বিজেপিকে ভরসা করতে শুরু করেছিল বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। সেই কারণে বাম ও কংগ্রেসের একটা বড় ভোট মোদী-শাহ বাহিনীর দিকে চলে যায়। এবং দুই ধর্মীয় মেরুকরণের কারণে বাম কংগ্রেসের সংখ্যালঘু ভোট ও বিজেপি বিরোধী ভোটের একাংশ চলে যায় তৃণমূলে।
বাংলায় এবার লোকসভা ভোটও সেই রসায়নের উপরই ধরে রাখতে চাইছে বিজেপি। এই নির্বাচনেও জাতীয় বিষয়আশয় পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ আলোচিত হচ্ছে না। তা ছাড়া বালাকোটের মতো কোনও ঘটনা না থাকায় উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারের সুযোগ কম। বিজেপি প্রচারের সূচীমুখ করেছে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকে। সেই সঙ্গে চড়া দাগের ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টায় নেমে পড়েছে তারা। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সেদিন ব্যারাকপুরে তাঁর বক্তৃতার বড় অংশ জুড়ে ছিল ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রসঙ্গ। প্রধানমন্ত্রী অনুযোগের সুরে বলেছেন, ‘বাংলায় হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছে। তৃণমূলের নেতারা বলছেন, হিন্দুদের ভাগীরথীতে ছুড়ে ফেলে দেবেন…’ ইত্যাদি।
অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার প্রশ্নে তৃণমূল বিরোধী ভোটের মেরুকরণ যেমন তাঁরা বিজেপির দিকে ঘটাতে চাইছেন। তেমনই ধর্মীয় মেরুকরণেও সচেষ্ট। তা ছাড়া সন্দেশখালিতে মহিলাদের উপর অত্যাচারের ঘটনাকে সামনে রেখে মহিলা ভোটকে কাছে টানার চেষ্টা করছে বিজেপি। কারণ, মহিলা ভোটের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মজবুত জনভিত্তি রয়েছে।
তবে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর অভিযোগ, “তলে তলে আঁতাত হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নরেন্দ্র মোদীর। তাঁরা যড়যন্ত্র করে বাংলায় ধর্মীয় মেরুকরণ তৈরি করতে চাইছেন। সেই কারণেই ভোটের আগে শলা করে নাগরিকত্ব আইনের নিয়ম চালু করা হয়েছে।” অধীরের বক্তব্য, “তৃণমূল জানে ধর্মীয় মেরুকরণ করতে না পারলে তাদের আসন কমে কোথায় দাঁড়াবে ঠিক নেই। ধর্ম নিরপেক্ষ ভোটের ভাগাভাগি হলে তবেই লাভ। তা ছাড়া বিজেপিকে সুযোগ করে দিয়ে দলের দুর্নীতিপরায়ণ নেতাদের তদন্ত এজেন্সি থেকে বাঁচানোরও তাগিদ রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।”
একই মত পোষণ করেছেন প্রবীণ সিপিএম নেতা তথা দমদম লোকসভায় সিপিএম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, “তৃণমূল ও বিজেপি বাংলায় বাইনারি তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু তা হচ্ছে না। মানুষ বুঝতে পারছে যাহাই তৃণমূল তাহাই বিজেপি। মুদ্রার দুই পিঠ তারা। এই ভোটে সেই বাইনারি ভেঙে যাচ্ছে।”
সুজন বা অধীর এ কথা বলছেন ঠিকই। কিন্তু এও বাস্তব নিয়োগ দুর্নীতি, সন্দেশখালি বিতর্ক ইত্যাদি প্রসঙ্গে বিজেপি মাঠে নেমে যে ধরনের লড়াই করেছে, তার তুলনায় বাম-কংগ্রেসের লড়াই কিছুটা ফিকে দেখিয়েছে। ধারাবাহিকতারও অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে নেতৃত্বের সংকট। তার ফলে বাইনারি রোখার চেষ্টা করলেও তাঁরা কতটা সফল হবেন তা নিয়ে বড় প্রশ্ন চিহ্ন রয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “কংগ্রেস ও সিপিএম বাংলায় আর প্রাসঙ্গিকই নয়। কোনও আলোচনায় নেই। তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপিকেই মানুষ একমাত্র বিকল্প বলে মনে করছে। কারণ মানুষ বুঝে গেছে বাংলার ক্ষমতা থেকে তৃণমূলকে সরানোর একমাত্র ক্ষমতা রয়েছে বিজেপির। বাম-কংগ্রেসের সেই শক্তি নেই। তাই তাদের ভোট দেওয়া মানে অপচয় করা। তৃণমূলের সুযোগ করে দেওয়া।”
বস্তুত অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্য এই ভোটেও বাম ও কংগ্রেসের জোট হয়েছে। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ জেলার দুটি আসন তথা মুর্শিদাবাদ ও বহরমপুর এবং মালদহ জেলার দক্ষিণের আসনটিতে সেই জোট বেশ পোক্ত দেখাচ্ছে। মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের সমর্থনে লড়ছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। আর বহরমপুরে বামেদের সমর্থনে কংগ্রেসের প্রার্থী হলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তবে এই তিন আসনের বাইরে রাজ্যের আর কোথাও জোটের তেমন কোনও প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অধিকাংশের মতে, চব্বিশ সালের এই লোকসভা ভোটেও বাংলায় মূল লড়াইটাই এখন তৃণমূল বনাম বিজেপিতে আবর্তিত হচ্ছে। একমাত্র ব্যতিক্রম হল মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর ও মালদহ দক্ষিণ। ওই তিন আসনে ত্রিকোণ লড়াই হয়েছে।
এবার অনিবার্যভাবেই যে প্রশ্নটা উঠতে পারে তা হল গোটা দেশে কমবেশি ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের মধ্যে আসন সমঝোতা হল, কিন্তু বাংলায় হল না কেন?
তার কারণ হল, বাংলায় কংগ্রেস ও সিপিএম হল তৃণমূলের বিরোধী দল। এই ভোটে তারা তৃণমূলের সঙ্গে জোট করলে হয়তো এক-দুটো আসনে তারা অনায়াসে জিততে পারত। কিন্তু বাংলার ঘরোয়া রাজনীতিতে এর পর তারা আরও বেশি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেত। তৃণমূলেরও এ ব্যাপারে অনাগ্রহ ছিল। কারণ, তারা বুঝতে পারছিল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করলেও তাদের ভোট তৃণমূলের দিকে ট্রান্সফার হবে না। কেন না যে সব মানুষ এখনও কংগ্রেসের সমর্থক তারা তৃণমূল বিরোধী। তাই জোট হলেও তাদের ভোট পেত না তৃণমূল।
তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের কথায়, “বাংলায় তৃণমূলই ইন্ডিয়া জোটের প্রতিনিধি। বাম ও কংগ্রেস এখানে বিজেপির বি-টিম হয়ে ভোট কাটাকাটির চেষ্টা করছে। কিন্তু মানুষ জানে মোদী-শাহ বাহিনী তথা এ দেশের দুই জমিদারকে বাংলায় রুখে দেওয়ার শক্তি শুধু জোড়াফুলেরই রয়েছে।”
সার্বিক এই পরিস্থিতিতে তাদের দূর্গ বাঁচিয়ে রাখতে তৃণমূলের মূল ভরসা দুটি। এক সংখ্যালঘু ভোট। মুর্শিদাবাদ ও মালদহর বাইরে যে ভোটের ৯০ শতাংশ তারা পাবে বলে মনে করছে তৃণমূল। দুই, মহিলা ভোট। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের সময়েই দেখা গেছিল যে মহিলাদের বড় রকমের সমর্থন পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার লোকসভা ভোটের আগে তাই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যোজনায় ভাতা দ্বিগুণ করে ১ হাজার টাকা করা হয়েছে। তফসিলি জাতি ও উপজাতি মহিলাদের জন্য সেই ভাতা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২০০ টাকা। তা ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার একটা ভোট তৃণমূলের এখনও বেশ মজবুত। তা ছাড়া রাজ্যে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রচার করছে বিজেপি তার মোকাবিলায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ তুলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
চুম্বকে বাংলায় এই ভোটের রসায়ন অনেকাংশেই ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের মতই। বরং বিজেপি এখন আরও শক্তিশালী। বাংলায় বিরোধী রাজনীতির পরিসর আগের তুলনায় অনেক বেশি তাদেরই দখলে।