ওয়াশিংটনে পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক জোট নেটোর শীর্ষ সম্মেলনের মূল মনোযোগ ছিল ইউক্রেনের জন্য বাড়তি সাহায্যর দিকে। কিন্তু কিছু পশ্চিমা কর্মকর্তা রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে উদ্ভূত আরেকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য সমানভাবে সংকল্পবদ্ধ : নতুন এক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যার প্রভাব সারা বিশ্বে পড়বে।
কর্মকর্তারা যুক্তি দেখান যে, রাশিয়ার অবিরাম আক্রমণ ঠেকাতে ইউক্রেনের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র নিশ্চিত করা আর যথেষ্ট নয়। তারা বলছেন, নেটোকে একই সাথে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে যে জোট সাহায্য করছে, তাদের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে, তাদের চেয়ে বেশি দ্রুত অগ্রসর হতে হবে এবং তাদের চেয়ে বেশি উৎপাদন করতে হবে।
“আমাদের আর হারানোর মত সময় নেই,” একজন নেটো কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভিওএ-কে বলেন। তিনি প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়ার সাথে চীন, উত্তর কোরিয়া আর ইরানের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার কথা বলছিলেন।
“এটা আমাদের সব মিত্রদের অগ্রাধিকার দিতে হবে, কারণ এটা শুধু বেশি টাকা খরচ করার বিষয় না,” কর্মকর্তা বলেন। “এটা ঐ সক্ষমতা পাওয়ার ব্যাপার।”
কর্মকর্তারা বার বার অভিযোগ করেছেন যে, চীন মস্কোকে কাঁচা মাল আর আধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজন তথাকথিত ‘ডুয়াল ইউজ’ যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এপ্রিল এবং মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রিটেন রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর জন্য ড্রোন উৎপাদনকারী ইরানি কোম্পানি এবং কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার তৈরি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা বলছে, এ’বছর আগের দিকে পিওংইয়াং রাশিয়াকে অন্তত ৬,৭০০ কনটেইনার পাঠিয়েছে, যেগুলোতে ৩০ লক্ষ আর্টিলারি শেল থাকতে পারে।
যে নেটো কর্মকর্তা ভিওএ-র সাথে কথা বলছেন, তাঁর মতে চীন, ইরান আর উত্তর কোরিয়া থেকে আসা সমর্থন রণাঙ্গনে রুশ বাহিনীর অবস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে দিয়েছে। রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে “পুনর্গঠন করতে বছরের পর বছর লাগবে” বলে যে ইন্টেলিজেন্স তথ্য আগে ছিল, তা এখন বাতিল হয়ে গেছে।
“রাশিয়ার সামরিক বাহিনী আর রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প এবং প্রযুক্তির পুনর্গঠনের বিশ্লেষণের দিকে যদি আপনি তাকান, তাহলে দেখবেন ঐ বিশ্লেষণ করা হয়েছিল চীন কীভাবে সাহায্য করবে তা বিবেচনায় না নিয়ে,” কর্মকর্তা বলেন।
আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এটা শুরু হয়েছে মাত্র। রাশিয়া, চীন, ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সহযোগিতা “আমাদের কাজের জরুরি ধরনটা বুঝিয়ে দিচ্ছে,” কর্মকর্তা বলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কোনও কোনও কর্মকর্তা এই উঠতি জোটকে একটি নতুন “অ্যাক্সিস অফ ইভিল” বা “অশুভ চক্র” বলে অভিহিত করেছেন।
“আমাদের অবস্থার প্রেক্ষিতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে,” অ্যাডমিরাল জন অ্যাকিলিনো, ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার মার্চ মাসে কংগ্রেস সদস্যদের বলেন।
রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পর্ক, ইউক্রেনে মস্কোর যুদ্ধকে সমর্থন দেবার জন্য দ্বিপাক্ষিক প্রচেষ্টা থেকে বেরিয়ে আরও বিস্তার লাভ করা দেখে কোনও কোনও বিশ্লেষক চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
“আমরা এখন যেটা দেখতে পাচ্ছি ... ঐসব কৌশলগত সম্পর্ক আরও গভীর হতে, আরও তীব্র হতে,” বলছেন ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অফ ডেমক্রেসিস-এর সিনিয়র উপদেষ্টা রিচারড গোল্ডবারগ।
“তারা প্রতিদিন, সব সময় ১০০ ভাগ সমন্বিত হোক বা না হোক, যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, কৌশলগত সক্ষমতার যে দিক তারা এক সাথে তৈরি করছে, সেখানে তারা এক সাড়িতে আছে,” ভিওএ-কে বলেন গোল্ডবারগ যিনি প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের কর্মকর্তা ছিলেন। “তাদেরকে আমাদের একটি চক্র হিসেবে দেখতে হবে, আলাদা করে না।”
তবে এই চক্র কত দ্রুত সত্যিকার অর্থে নেটোর প্রতিদ্বন্দ্বী একটি জোটে পরিণত হতে পারে, তা পরিষ্কার নয়।
“এই চারটি দেশের মধ্যে এখনো উল্লেখযোগ্য টানাপোড়নের জায়গা আছে যেটা আরও সংহতিপূর্ণ জোট তৈরির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে,” বলছেন র্যান্ড কর্পোরেশনের একজন সিনিয়র পলিসি গবেষক মিশেল গ্রিসে।
“যেমন ধরুন, রাশিয়া আর ইরানের মধ্যে সম্পর্কে জ্বালানি বাজার এবং মধ্য এশিয়ার ককেশাস অঞ্চলে প্রভাবের জন্য প্রতিযোগিতা হচ্ছে টানাপোড়নের জায়গা। ইসরায়েল প্রসঙ্গেও দু’দেশ অন্তত ঐতিহাসিকভাবে ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে,” গ্রিসে ভিওএ-কে বলেন।
“রাশিয়া-চীন-উত্তর কোরিয়া-ইরান চক্র যুক্তরাষ্ট্র আর নেটোর জন্য গুরুতর হুমকি বহন করে, কিন্তু আমি মনে করি না যে এই চক্রকে প্রতিহত করা যাবে না,” তিনি বলেন। “আরও সংহতিপূর্ণ জোট গড়তে হলে, পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি তাদের বৈরিতাকে বদলে ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও সুসংহত করতে হবে, যেটা আমার মনে হয় তাদের জন্য কঠিন হবে।”
তবে নেটো মিত্ররা ধরেই নিচ্ছে না যে, রাশিয়া-চীন-ইরান-উত্তর কোরিয়াকে এ’ধরনের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে লড়াই করতে হবে।
জুলাই মাসের ৯ তারিখে, ওয়াশিংটনে নেটো সামিট ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি ফোরামে দেয়া এক ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি ডিফেন্স সেক্রেটারি ক্যাথলিন হিক্স নেটো মিত্রদের অস্ত্র তৈরি এবং সংগ্রহের ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করার আহ্বান জানানোর সময় “আমাদের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতিরক্ষা শিল্পের দ্রুত সম্প্রসারণ”-এর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেন।
উদাহরণ স্বরূপ, হিক্স ইউরোপে প্যাট্রিওট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন এবং অন্যান্য দেশের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্যে ১৫৫ মিলিমিটার আর্টিলারি শেল উৎপাদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কের যৌথ প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন।
“আমরা কেউ মনে করি না যে এটাই যথেষ্ট,” তিনি বলেন। “ট্রান্স-আটলান্টিক প্রতিরক্ষা শিল্পের সক্ষমতা বাড়ানো শুধু ভালোর জন্য করা না। এটা প্রয়োজনের জন্য করতে হবে, নেটো জোটের জন্য এটা অবশ্যই করতে হবে।”
এমনকি, অস্ত্র উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য নেটোর প্রচেষ্টা যদি যথেষ্ট নাও হয়, কিছু কর্মকর্তা এই প্রচেষ্টাকে পশ্চিমা বিশ্বের এগিয়ে থাকার একটি কারণ হিসেবে দেখতে চান।
“আমার মনে হয়, আমরা যে পদক্ষেপ নিচ্ছি এবং যে অগ্রগতি হচ্ছে, তাতে আসলেই ফলাফল অর্জন করতে পারছি,” নেটো কর্মকর্তা ভিওএ-কে বলে যোগ দেন যে, তারা “খুব বেশি নেতিবাচক হবেন না।”
“গোলা-বারুদের ক্ষেত্রে, আপনি এখন দেখতে পাচ্ছেন যে উৎপাদন বৃদ্ধি আসলেই হচ্ছে,” কর্মকর্তা বলেন। “এবং আমার মনে হয় আমরা যদি আগামী বছরের দিকে তাকাই, তখন আমরা অনেক, অনেক ভাল সংখ্যা পাবো।"