সিরিয়ায় ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের হাতে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর দেশের ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বব্যাপী ডাক উঠেছে। সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে আলাউই সম্প্রদায় নিয়ে, যাদের মাঝ থেকে আসাদ পরিবার এসেছিল।
যে দ্রুত অভিযানের মাধ্যমে বিদ্রোহীরা দামেস্ক দখল করে, তার নেতৃত্ব দেয় ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম বা এইচটিএস এবং অন্যান্য তুরস্ক-সমর্থিত ইসলামি গোষ্ঠী। যুক্তরাষ্ট্র এইচটিএসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা আলাউই সহ অন্যান্য জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সমুন্নত রাখার অঙ্গিকার করেছে।
অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এখন পর্যন্ত এই প্রতিশ্রুতি মোটামুটি রক্ষা করা হচ্ছে। তবে অনেকে আশঙ্কা করছে যে, বিদ্রোহীরা দেশের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করার পর তারা প্রাক্তন সিরিয় সরকারের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে আলাউই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লেগে যেতে পারে।
আলাউইরা শিয়া ইসলামের একটি অংশ এবং তারা সিরিয়ার দুই কোটি ৪০ লাখ জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ। তারা মূলত উপকূলীয় লাতাকিয়া এবং তারতুস প্রদেশে বাস করেন। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আলাউই দামেস্ক এবং হোমস-এ বসবাস করেন।
আসাদ পরিবার ১৯৭০ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আলাউইদের উপর নির্ভর করেছে, এবং তারা পরবর্তীতে সামরিক এবং গোয়েন্দা বাহিনীতে অনেক উচ্চ পদে নিয়োগ পায়।
সিরিয়ার একজন শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার আইনজীবী আনোয়ার আল-বুন্নি ভিওএ-কে বলেন যে, বাশারের পিতা, হাফেজ আল-আসাদের নৃশংস শাসনামল “আলাউই সম্প্রদায়ের প্রতি চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করে।”
তবে বুন্নি বলেন যে, এইচটিএস প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানির বিবৃতি আলাউইরা ভাল ভাবেই গ্রহণ করেছে। গত শুক্রবার জোলানি সিএনএনকে বলেন, “এক গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার অধিকার কারো নেই। এই গোষ্ঠীগুলো শত শত বছর ধরে এই অঞ্চলে বাস করছে, এবং তাদের নির্মূল করার অধিকার কারো নেই।
“সরকারের পতনের পর আলাউই সম্প্রদায়ের নেতারাও বেশ ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন, কিন্তু এটা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে,” বুন্নি বলেন। “জবাবদিহিতা এবং ন্যায় বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হবার পর তাদের অবস্থান বদলাতে পারে।”
বুন্নি বলেন যে, যখন বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে প্রাক্তন সরকারের কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে, তখনই আলাউইদের অবস্থানের আসল পরীক্ষা হবে।
“ভবিষ্যতে জবাবদিহিতার উদ্যোগগুলো আলাউই সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব সমর্থন করবে কি না, সেটাই নির্ধারণ করবে একটি গণতান্ত্রিক এবং মুক্ত সিরিয়ার প্রেক্ষিতে অন্যান্য সিরিয়রা তাদের কীভাবে দেখবে,” তিনি বলেন।
লাতাকিয়া প্রদেশে আসাদের শহর কারদাহার কয়েক ডজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি সোমবার এক বিবৃতির মাধ্যমে দামেস্কের নতুন শাসকদের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করেন এবং পূর্ণ সহযোগিতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তার কিছুক্ষণ পরেই, সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায়, কারদাহাতে আসাদের মূর্তি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।
লাতাকিয়ার এক বাসিন্দা ভিওএ-কে বলেন, সোমবার কারদাহায় বিদ্রোহীদের এক প্রতিনিধিদল এবং আলাউই সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।
নিরাপত্তার কারণে নাম না প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক একজন আলাউই অ্যাক্টিভিস্ট বৈঠকটি নিশ্চিত করেন, এবং বলেন যে বৈঠকের খবর স্থানীয় সম্প্রদায় ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করেছে।
“দু’পক্ষের বৈঠক করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আস্থার একটি পরিবেশ তৈরি হয়,” অ্যাক্টিভিস্ট বলেন। “সব আলাউই প্রাক্তন সরকারকে সমর্থন করে নাই, এবং অন্যান্য জায়গার সিরিয়দের সেটা বুঝতে হবে।”
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অফ ডেমোক্রেসিজ-এর গবেষণা ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেভিড আডেসনিক বলেন, সহনশীলতার ভাবমূর্তি তুলে ধরার গুরুত্ব এইচটিএস বোঝে।
“মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এইচটিএস কি মনে করে যে, আসাদের আলাউই পরিচয়ই তাঁর নৃশংসতার কারণ। যদি তা না হয়, তাহলে আলাউই সম্প্রদায়কে দোষারোপ করে প্রতিশোধ নেয়ার কোন কারণ থাকবে না,” তিনি ভিওএ’কে বলেন। “অন্য দিকে, এইচটিএস এবং অন্যান্য বিদ্রোহীরা রাশিয়া আর ইরানের সাথে আসাদের দীর্ঘস্থায়ী মিত্রতাকে সমস্যা হিসেবে দেখে।”
আডেসনিক আরও বলেন, “আলাউই সম্প্রদায় বা তাদের কোন নেতার উপর আর কোন দিন আস্থা রাখতে এইচটিএস এবং অন্যান্যদের সমস্যা হতে পারে, কিন্তু তাদের একঘরে করে দিয়ে সেই বিষয়টির সমাধান করা যায়। এখানে সহিংসতার পথ বেছে নেয়ার কারণ নেই।”
আলাউই সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে সিরিয়ার উপকূলীয় এলাকায় স্বতন্ত্র অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা উঠেছে। তবে লাতাকিয়া-ভিত্তিক অ্যাক্টিভিস্ট বলেন এ’ধরনের ডাক সিরিয়াস নয়।
আডেসনিক বলেন আলাউইদের জন্য স্বায়ত্তশাসন সম্ভাব্য নয়। তিনি যোগ দেন, “উপকূল কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, কারণ এর মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করা যায়।
“আলাউইদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করলে অন্যান্য অনেক সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ সুবিধা দাবী করার দরজা খুলে যাবে। এর ফলে, দামেস্কের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়বে,” তিনি বলেন। “কুর্দি অঞ্চলের জন্য এক ধরনের ব্যবস্থা হয়তো অনিবার্য, কিন্তু আমার মনে হয় না যে সিরিয়ার সরকার অন্যান্য অঞ্চলে এই জিনিস করতে চাইবে।”