রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু জাদুঘর ভবনটি এখন ধ্বংসস্তূপ। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ নামে পরিচিত এই বাড়ি ভাঙা শুরু করে বিক্ষোভকারীরা। এক পর্যায়ে বুলডোজার ও ভেকু এনে বাড়ি ভাঙা শুরু হয়।
সারারাত ধানমন্ডি ৩২-এর বাড়িটি ভাঙচুরের পরদিনও বাড়ি ভাঙার কাজ অব্যাহত থাকে। ‘জুলাই ঐক্যজোট’ নামের একটি সংগঠন ৬ ফেব্রুয়ারি বিকালে ধ্বংসস্তূপে পরিণত বাড়িটির সামনে গরু জবাই করে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, উৎসব পালনের জন্যেই জবাই করা হয়েছে এই গরু, যেটির মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করা হবে এবং ধানমন্ডি ৩২-এ আসা সাধারণ মানুষদের খাওয়ানো হবে।
৬ ফেব্রুয়ারি সারাদিন জুড়েই রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধানমন্ডি ৩২-এর বাড়িটি দেখতে এসেছে সাধারণ জনগণ।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় ভারতে নির্বাসিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনলাইনে বক্তৃতা দেন। এর আগেই তার বক্তৃতা দেয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকেও শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিবেন, এমন ঘোষণা দেয়া হয়।
শেখ হাসিনার বক্তৃতা দেয়ার এই সংবাদকে ঘিরে ৫ ফেব্রুয়ারি সারাদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল উত্তপ্ত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা জাতীয় নাগরিক কমিটি সহ একাধিক সংগঠনের সদস্য এবং অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে বিভিন্ন নামে কর্মসূচী পালনের ডাক দেন। ‘বুলডোজার মিছিল’ কিংবা ‘মার্চ টু ধানমন্ডি ৩২’ এর মতো নাম দেয়া হয় এসব কর্মসূচির।
তাদের এই কর্মসূচীর ডাকে সাড়া দিয়েই নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাড়িটি ভাঙতে ছুটে আসেন বিক্ষোভকারীরা।
এদিকে ধানমন্ডি ৩২-এর বাড়ি ভাঙার ঘটনাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া।
সাংবাদিক তাসনিম খলিল লিখেছেন, “ধানমন্ডি ৩২ যেভাবে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেটা নতুন এক ফ্যাসিজমের রাস্তায় প্রথম পদক্ষেপ”।
লেখক অনুপম দেবাশীষ রায় বাড়িটি ভাঙার বিপক্ষে থাকলেও এর পেছনে দায়ী করেছেন বর্তমান সরকারকে। তিনি লিখেছেন, “যদি খুব দ্রুত সরকার আওয়ামী লীগকে সংগঠন হিসেবে আর নিপীড়নকারী আওয়ামী লীগদের ধরে ধরে বিচার না করে, তবে এই মব অন্য উপায়ে তাদের ক্রোধ প্রকাশ করবে।…কাজেই আমি সহ যারা ধানমন্ডি ৩২ এর ওপর আক্রমণে উষ্মা প্রকাশ করেছি, আমাদের বরং উচিত সরকারের কাছে দাবি তোলা যাতে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে তারা বাস্তবায়িত করে।”
অ্যাকটিভিস্ট তাসলিমা আখতার এই ঘটনার পেছনে দুরভিসন্ধি দেখছেন। তার দাবী, এর মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, এই ঘটনার ফলে শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে শেখ হাসিনার পুনর্বাসনের সম্ভাবনা তৈরি হল। তিনি লিখেছেন, “এভাবে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ সারা দেশে আবারও ভাঙচুর-আগুন-গুড়িয়ে দেয়া আতংক ছড়িয়ে দিন শেষে কার লাভ হলো? না থেকেও ফিরে ফিরে আসার পথ প্রশস্ত হলো কার?”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুবাশার হাসান এই ঘটনার পেছনে অন্য ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার মতে, সেনাবাহিনী পরিচালিত আয়নাঘরে সাংবাদিক ও ভিকটিমদের ভিজিট করতে বাধা দেয়া হচ্ছে, এমন সংবাদ প্রকাশের পরদিনই ধানমণ্ডি ৩২ এর বাড়িটি ভাঙা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “হাসিনা হাসিনার বক্তব্য ঠিকই দিলো। ৩২ ভাঙার পরে আওয়ামীলীগের লোকজনের মরাল ঠিকই বুস্ট হলো। মাঝখান দিয়ে সবাই ভুলে গেলো আয়নাঘরের কথা”
ধানমণ্ডি ৩২ এর বাড়ি ভাঙার বদলে অনেকেই অন ও অফলাইনে আয়নাঘর ভাঙার দাবী তুলেছেন। তাদের সেই দাবীর ব্যাপারে লেখক কল্লোল মোস্তফা নিজের পোস্টে উল্লেখ করেছেন, “অনেকে দেখলাম আয়না ঘর ভাঙার কথা বলছেন। এটা খুবই সমস্যাজনক কথা। ডিজিএফআই ও তো আয়নাঘর ভাঙতে চায়। তাদের কলঙ্কের ইতিহাস মুছে দেয়ার জন্য। কাজেই আয়নাঘরকে হুবহু অক্ষত রাখার দাবী তুলতে হবে- নিপীড়নের ইতিহাস ও স্বাক্ষ্য হিসেবে।”
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ ভাঙচুরের ঘটনার বিরোধিতা করে লিখেছেন, “বৈধ হিসেবে মনে করেন, এমন একটা সরকার অস্তিত্ব থাকলে কোন ভবনে বুলডোজার চালানো কিংবা আগুন দেয়া কিংবা ভাঙচুর সন্দেহাতীতভাবেই ফৌজদারী অপরাধ।”
লেখক ও বুদ্ধিজীবী রিফাত হাসান এই ধানমণ্ডি ৩২-এর বাড়ি ভাঙাকে ছাত্রদের শক্তি প্রদর্শনের নমুনা হিসেবে দেখছেন। তিনি লিখেছেন, “এই মুভের মাধ্যমে ছাত্ররা মাঠের দখল ও শক্তি পুনপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হল, দুইটা বড় প্রতিপক্ষের বিপরীতে। এক. শেখ হাসিনা, আওযামীলীগ ও ইন্ডিয়ান শাসকগোষ্ঠী, এই ত্রিবেণী। এইটা সরাসরি প্রতিপক্ষ। যারা এই মুভ কল্পনাতেও রাখতে পারে নাই। দুই. বিএনপি ও বাকি বিরোধী দলগুলো। এরা সরাসরি প্রতিপক্ষ না। কিন্তু প্রতিযোগী।”
সাংবাদিক সুপন রায় এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে লিখেছেন, “এই বাড়িতে বসেই রচিত হয়েছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন! এই বাড়িতে-ই ছুটে গিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া! এই বাড়ি বাংলাদেশের সম্পদ! বঙ্গবন্ধুর, স্বাধীনতার স্মৃতি জড়ানো একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর স্থান! আর ঠিক এই কারণেই পাকিস্তানের ডিফেন্স থেকে ব্রেকিং নিউজ দিয়ে এক্স (সাবেক টুইটার) এ লেখা হয়, End of a traitor's Legacy!”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন ভাঙচুরে অংশ নেয়া জনতাকে কেন ‘মব’ বলা যায় না, সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, “হাজার হাজার মানুষ যখন কোনো রাজনৈতিক কারণে জড়ো হয়, তাকে মব বলে না। তাই যদি হয় তাহলে তো ৩৬শে জুলাই বঙ্গভবনে যে জনতা ঢুকেছিল তারাও মব!!!”
লেখক সহুল আহমদের মতে, এ ধরনের ঘটনায় বর্তমান সরকারই বিপাকে পড়বে। ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে করা এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “এখন সরকারের ছয় মাস চলছে। আজকের ঘটনাতে সরকার ভীষণ চাপে পড়বে। আন্তর্জাতিকভাবে। আন্দোলন চলাকালে রাষ্ট্রিয় সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভ্যান্ডালিজম এবং আজকে ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে পরিকল্পিত ভ্যান্ডালিজমের মধ্যে ফারাক আছে। যে সরকারকে অভ্যুত্থানের বলে দাবি করছি, সেই সরকারকেই এই ঘটনা ভীষণ চাপে ফেলবে।”
লেখক ও বক্তা তাহমিদাল জামি ধানমণ্ডি ৩২-এর বাড়ি ভাঙার ঘটনাকে সাধারণ জনগণের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা হিসেবে মনে করছেন। তিনি লিখেছেন, “তামশাবাজ "বিপ্লবী জনতা"র চিহ্নের রাজনীতি দেখতেছে মানুষ। ক্ষুধার্ত, নিপীড়িত, অপমানিত, আহত সাধারণ মেহনতি মানুষ। জুলাইয়ের আপামর মানুষ -- যারা না চড়ছে বড়ভাইয়ের প্রাডোতে না ছাব্বিশ লক্ষ ভাড়ার হেলিকপ্টারে।”
ধানমণ্ডি ৩২-এর বাড়ি ভাঙার বিরোধিতা যারা করেছেন, তাদের সমালোচনা করে লেখক ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন শুভ্র লিখেছেন, “যারা ৩২ ভাঙার বিরোধিতা করছেন, তাদের একটা কমন ট্রেন্ড হলো ইন্ডিয়ায় বসে শেখ হাসিনার বক্তব্যের বিরোধিতা না করা।”
শিল্পী দেবাশীষ চক্রবর্তী তার ফেসবুক পোস্টে ধানমণ্ডি ৩২-এর বাড়ি ভাঙা সহ অন্যান্য মব ও ভাঙচুরের ঘটনার পেছনে দায়ী করছেন শেখ হাসিনা ও ভারতকে। তার মতে, “অথচ খুনি হাসিনাকে কেউ অভিযুক্ত করছেন না, এত মানুষকে খুন করে, ভারতে পালিয়ে গিয়ে প্রতিনিয়ত উস্কানিমূলক-অপমানজনক কথা বলে এসব ঘটনার পূর্বশর্ত কি এই খুনিহাসিনা আর গং তৈরী করেনি? আপনি যদি গত ৬ মাসের মব নিয়ে চিন্তিত হন, হওয়াই উচিত, তবে এর বৈষয়িক পূর্বশর্ত নিয়ে কথা বলবেন না?”
কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ ভবিষ্যতে এই ঘটনার প্রভাব সম্পর্কে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করে লিখেছেন, “একশটা ৩২ নাম্বারের মূল্য একটা মানুষের জীবনের মূল্যের সমান না। কিন্তু আমার আশঙ্কা ৩২ নাম্বার গুঁড়িয়ে দেয়া দেশরে আরেকটা সুদূরপ্রসারী সংঘাতের দিকে নিয়ে যাবে। যেখানে আরো অনেক মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।”