পাটের আঁশ থেকে নানান ধরণের উদ্ভাবনের কথা প্রায়ই শোনা যায়। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের কয়েকজন শিক্ষার্থী পাটের আঁশ থেকে তৈরি করেছিল বাইসাইকেল। এবার পাটের আঁশ থেকে তৈরি হলো রেসিং কার।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থীরা ফর্মুলা কারের আদলে তৈরি করেছেন ‘কিলোফ্লাইট আলফা’ নামের একটি রেসিং কার। কুয়েট এর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের ৫০ সদস্যের একটি দল, যার নাম “কিলোফ্লাইট” এ গাড়িটি প্রস্তুত করেছে।
এ গাড়িটির বিশেষত্ব হলো, গাড়িটির সম্পূর্ণ বডি ও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই রেসিং কারটিতে উন্নত মানের ইঞ্জিন, গিয়ার, ব্রেক, মিটার দেওয়া রয়েছে। চালকের আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যও রয়েছে সুরক্ষা ব্যবস্থা। ‘কিলোফ্লাইট আলফা’ ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার বেগে চলতে পারবে।
রেসিং কারটির প্রস্তুতকারী সকল সদস্য খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এর শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে ২৮ জন সদস্য নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয়। যাত্রা শুরুর পর থেকে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাদের নিরন্তর কাজের মধ্য দিয়ে ২০২১ সালের জুলাই মাসে গাড়িটি তৈরি সম্পন্ন হয়।
রেসিং কার ‘কিলোফ্লাইট আলফা’ নিয়ে কথা হয় কিলোফ্লাইট-এর ক্যাপ্টেন, এরফান ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। আমাদের নানান অর্জন আছে। এদেশে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার আছে, অনেক অনেক মেধা আছে। তাহলে আমরা কেন তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করবো না? অটোমো্বাইলের ক্ষেত্রে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে এবং দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার তৈরিতে আমাদের যদি কোন অংশগ্রহণ থাকে, আমরা গর্বিত হবো।”
রেসিং কারে পাটের আঁশ কেন? উত্তরে এরফান ইসলাম বলেন, “কোন দেশ যখন কোন কিছুর উন্নয়নের চেষ্টা করে তখন তারা চেষ্টা করে সে দেশের সহজলভ্য নিজেদের পণ্য কিভাবে ব্যবহার করা যায়। সেদিক দিয়ে চিন্তা করে আমরা পাটকে বেছে নিয়েছি। তাছাড়া পাট শতভাগ পরিবেশবান্ধব।”
এরফান ইসলামের কাছ থেকে আরও জানা যায়, এই রেসিং কারটি নির্মাণ করতে “কিলোফ্লাইট”-কে নানান সীমাবদ্ধতার মুখোমুখী হতে হয়েছে। সীমাবদ্ধতাগুলি কেমন ছিল প্রশ্নের উত্তরে এরফান বলেন, দুই ধরণের সমস্যায় আমরা পড়েছিলাম। টেকনিক্যাল সাপোর্টের অভাব এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা। আমরা যে কাজটি করেছি এই ধরণের কাজে প্রচুর যন্ত্রাংশের দরকার হয়েছে আমাদের। আমরা বেশিরভাগ পার্টস নিজেরা ডিজাইন করে তৈরি করেছি। সেটা করতে প্রয়োজনীয় উপকরণ বাংলাদেশের বাজার থেকে সংগ্রহ করছি। আমাদের এই রেসিং কারটি তৈরি করতে এমন কিছু নিখুঁত ও বিশেষ পার্টস এর দরকার হয়েছে যেগুলি আমাদের নিজেদেরই তৈরি করতে হয়েছে। এগুলি তৈরি করতে আমাদের প্রয়োজনীয় মেশিন ছিল না। তাই বিকল্প পদ্ধতিতে আমাদের সেগুলি তৈরি করতে হয়েছে, এতে অনেক সময় লেগেছে আমাদের। পাশাপাশি আমাদের টাকার দরকার হয়েছে, সেই টাকার উৎস’র জন্যও আমাদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে, যার ফলে কাজটি সম্পন্ন করতে আমাদের লম্বা সময় লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ও আমাদের নিজেদের অর্থায়নে এই রেসিং কারটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এমন সৃষ্টিশীল উদ্যোগে সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি এবং বেসরকারি ইনভেস্টমেন্ট বা অর্থায়ন পেলে আমাদের চেষ্টাটা আরও মসৃণ ও ভাল হতো।
কিলোফ্লাইটের ডেপুটি ক্যাপ্টেন সাগর মজুমদার বলেন, পাটশিল্পকে এগিয়ে নিতে এমন উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। সাধারণত, এই ধরণের গাড়িতে বিশ্বের সব ক্ষেত্রে কার্বন ফাইবার ব্যবহার করা হয়। সেখানে যদি দেশীয় তৈরি জুট ফাইবার দিয়ে রিপ্লেস করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরণের সুযোগ আসার সম্ভাবনা থাকবে। তাছাড়া, পাটের আঁশ নিয়ে আমাদের গবেষণা চলমান আছে। ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত পরিসরে পাটের আঁশের ব্যবহার বাড়তে পারে।
সম্প্রতি, “ফর্মুলা স্টুডেন্ট ইউকে” নামের একটি ইভেন্টে অংশ নেয় “কিলোফ্লাইট আলফা”। করোনার সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ কিছু দেশ এবার অনলাইনে অংশ নেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিযোগী কুয়েট ৩৩তম স্থান লাভ করেছে এই ইভেন্টে। আগামী বছরগুলিতে ফর্মুলা স্টুডেন্টকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে কিলোফ্লাইট।
আগামীতে ইলেক্টিক ভেইকলের পাশাপাশি ড্রাইভারবিহীন ভেইকল তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কিলোফ্লাইট।