মোঃ ইমরান হোসেন ভূঁইয়া
সহকারী অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশে গতানুগতিকভাবে প্রায় প্রতি বছরই ক্রমবর্ধমান (ইনক্রিমেন্টাল) হারে বিভিন্ন খাতের বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয় এবং সেদিক থেকে আমাদের জাতীয় বাজেট অনেকটা সংখ্যাতাত্ত্বিক রাজস্বনীতি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাৎসরিক বাজেটে তাই বিভিন্ন খাতে মৌলিক বা গঠনমূলক কোন পরিবর্তন খুব একটা দেখা যায়না। এবার কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে সবার মতো আমারও আশা ছিলো যে বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, ও সামাজিক সুরক্ষা খাত পাবে বাড়তি গুরুত্ব ও বরাদ্দ, থাকবে সংকট উত্তরণে উদ্ভাবনী কিছু দিকনির্দেশনা। এক্ষেত্রে, অগ্রাধিকারভিত্তিতে এই খাতগুলোতে বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে ঠিকই, তবে আশানুরূপভাবে বাড়েনি। স্বাস্থ্যখাতের সক্ষমতা বৃদ্বির মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজানোর মতো বরাদ্দ বা দিকনির্দেশনা কোনটিই দেখা যায়নি এবারের বাজেটে। সেদিক থেকে কৃষি বা সামাজিক সুরক্ষা খাতের বাজেট বেড়েছে তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যখাতের চাইতে বেশি, যা আমাদের স্বাস্থ্যখাতের বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা কতোটা কম তা আরও স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। এই খাতগুলোর বাইরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ অনেকটা বাড়লেও, আলাদা করে শিক্ষা খাতের বাজেট ঘোষণার যে দাবী বহুদিন ধরে শিক্ষাবিদরা করে আসছেন, তা বাস্তবায়ন হয়নি। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমাদের যুব বেকারত্ব ও অদক্ষ শ্রমিকদের বৈশ্বিক শ্রমবাজারে চাকুরির চাহিদা হ্রাস পাওয়ার প্রেক্ষিতে আগামীদিনে আমাদের শিক্ষাখাতে গুণগত সংস্কার, দক্ষ জনবল তৈরী, ও নতুন কর্মসংস্থান সৃজনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে কোন সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়নি বাজেট বক্তৃতায়। দিনশেষে, তাই আমাদের প্রত্যাশা যে, সংশোধিত বাজেটে গতানুগতিক ধারার বাইরে রাষ্ট্রের মৌলিক চিন্তার ও দিকনির্দেশনার ছাপ থাকবে যা সাধারন জনগনকে সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রবৃদ্বি বা রাজস্ব হিসেবের বাইরে যেয়ে আগামীদিনের সংকট মোকাবেলায় রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারগুলো বুঝতে সাহায্য করবে!
শারমিন আক্তার শাকিলা
উদ্যোক্তা সম্বনয়কারী, ইএমকে সেন্টার।
২০২০ সাল আমাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা বছর । এই বছর আমরা দেখছি মানব সভ্যতার এক অন্যতম সংকট। সামাজিক, শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক এবং বৈশ্বিকভাবে এই সংকটের ভুক্তভোগী আমরা সবাই। বাজেট আমাদের দেশের মানুষের জন্য এক ধরণের উৎসবের মতো যেখানে আমরা পলিসি, জীবনমান, উন্নয়ন এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি। সেই কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আমাদের আগ্রহ অনেক বেশী ছিলো এবং প্রতি বছরের ন্যায় বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বা থিঙ্কট্যাংকদের পর্যালোচনা আমরা দেখেছি।
এবারের ৫৬৮,০০০ কোটি টাকার ঘোষিত বাজেটে কয়েকটি দিক আমরা দেখেছি। যেমন, এবার স্বাস্হ্যখাতে বরাদ্দ বারানো হয়েছে, কৃষি, সামাজিক সুরক্ষা, কর্মসংস্হান বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন প্রণোদনা সুবিধা। কিন্তু এই ক্রান্তিকালে আমরা বাজেটে নতুনত্ব দেখিনি খুব বেশী। আমাদের বাজেটে এবার জিডিপি বৃদ্ধি ৮.২ শতাংশ বলা হলেও আন্তর্জাতিক সাহায্য নেবার কথাও বলা হয়েছে। অর্থনীতির চাকা যেখানে পুরোপুরি সচল নয়, বৈদেশিক সাহায্যের কথা বলা হচ্ছে সেখানে এত বড় লক্ষ্যমাত্রা অজর্ন অনেকটা বাস্তবসম্মত কিনা তা সময়ই বলে দেবে। বাজেটে অনেকগুলো বিষয় ত্রুণ হিসেবে আমার মনে হয়েছে থাকা উচিত ছিলো কিন্ত পাইনি। শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ কয়েক বছর ধরে বাড়ছে কিন্তু সম্পূর্ণ বাজেটের তুলনায় তা সমান প্রাধান্য পায়নি। স্বাস্থ্যখাতে গত বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ বাজেট বাড়লেও তা ভংঙ্গুর খাতকে পুনরুদ্ধারের জন্য যথেষ্ট নয়। সামাজিক সুরক্ষাখাতে যে বাজেটও সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করলে তা অপ্রতুল। তার মধ্য অন্যতম হল সামনের সময়গুলোতে যারা কাজ হারাবে তাদের জন্য কোন প্রণোদ্না আমরা দেখিনি যে সামনে একটি বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
সামগ্রিকভাবে এবাবের বাজেটকে অনেক বেশী কোভিড-১৯ সংবেদন্শীল হওয়া উচিত ছিলো যা আমরা দেখিনি।
রাজু হাওলাদার পলাশ,
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, বেকারত্ব, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে আইনত স্বীকৃত। এগুলোই রাষ্ট্র পরিচালনার মূল সূত্র, ভিত্তি ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। যা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক মৌলিক দায়িত্ব। যদিও এ সুযোগ সুবিধা প্রদানে রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে কেঊ আদালতে মামলা করতে পারেনা। তাই জাতীয় বাজেটই এই জীবনমুখী নীতিগুলো বাস্তবায়নের আইনগত পন্থা। কিন্তু করোনাকালীন বিশ্ব দুর্যোগে প্রণীত বাজেট এবারো মানুষের জীবনমুখী এই মূলনীতিগুলোতে আলো ফেলতে পারেনি। পরিসংখ্যানে এখন দারিদ্রের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশ। নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে শহরে ৮২ ও গ্রামে ৭৯ শতাংশ হারে। ভোগের বৈষম্য বেড়েছে দশমিক ৩৫ পয়েন্ট। প্রায় দেড় কোটি মানুষ চাকরি হারানোর শংকায়। নিয়মিত বেতন পাচ্ছে না অনেকে। বাসা বা অফিস ভাড়া বকেয়া থাকায় অনেকেই তা ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। পোশাক খাতের ৪০ লাখ শ্রমিক ভুগছেন। বিনিয়োগ তলানীতে। ক্ষুদ্র, মাঝারী ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে। বন্দরে আমদানী পণ্য পড়ে আছে। তাই প্রশ্ন জাগে এ বাজেট গতানুগতিকভাবে প্রবৃদ্ধি ও রাজস্বমুখী না হয়ে বরং সাংবিধানিক চেতনায় জীবনমুখী ও সৃজনশীল হতে পারত কিনা?
ট্যাক্স, ভ্যাট, সারচার্জ, রাজস্ব, লাইসেন্স ফি ইত্যাদির নামে মানুষের উপর চাপ না বাড়িয়ে বরং টিকে থাকতে তাদেরকে বিকল্প পদ্ধতিতে আরো সহায়তা দেয়ার সুযোগ ছিল কিনা? শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ও ব্যবসা বাড়াতে ভোগান্তি হ্রাস, সাময়িক ট্যাক্স হলিডে বা অর্থ সাশ্রয়ী অন্যান্য সুযোগ দেওয়া যেত। রাজস্ব কমিয়ে বা বিকল্প পদ্ধতিতে বন্দরে পড়ে থাকা আমদানী পন্য সহজে খালাসের সুযোগ দিলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও খাদ্যদ্রব্যে সাময়িক ভ্যাট প্রত্যাহার হতো সাধারন মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক। ঢাকা সহ অনেক শহরের ভাড়া ও অগ্রিমের পরিমান আগে থেকেই হয়রানিমূলক। এই ভাড়া আংশিক হলেও মওকুফ বা সমন্বয় এখন মানুষের প্রাণের দাবী। ১লা জানুয়ারী, ২০২০ থেকে ঋনের খেলাপী শ্রেণিকরণ স্থগিত করে ও সুদহার কমিয়ে সরকার প্রশংসনীয় কাজই করেছে। উৎপাদন ও রপ্তানিতে নিয়োজিত প্রকৃত ব্যবসায়ীদের কিস্তি পরিশোধে আরো সময় দেয়া উচিত। এই সময়ে সাধারন মানুষের সঞ্চয়ে সুদ বাড়ানো যেত। তা না করে বরং তাদের আমানতে শুল্ক বাড়িয়ে কার লাভ হল? করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ করা ভাল উদ্যোগ।
আব্দুল্লাহ আল মামুন খান
তরুণ ই-কমার্স ব্যবসায়ী
তথ্য-প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট এক হাজার ৪১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা যদি প্রকৃতপক্ষে কার্যকরী উপায়ে ব্যয় হয় তাহলে যথেষ্ট। তবে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো জরুরী। গবেষণাটা শুধু আধুনিক প্রযুক্তিতে নিয়ে করলেই হবে না। দেশের ছোট বড় যে সমস্যাগুলো রয়েছে প্রযুক্তি দিয়ে সেগুলো কিভাবে সমাধান করা যায়, সেটা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। সেই গবেষণার ফলাফল স্বরূপ বিভিন্ন প্রডাক্ট আনতে হবে, যেটা দেশীয় ই-কমার্স ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে বিক্রি করানো যেতে পারে দেশে এবং দেশের বাইরে।
ইন্টারনেটের খরচ বৃদ্ধি না করে সেটাকে আরো সহজলভ্য করতে হবে। অনলাইন কেনাকাটায় সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে, কেনাকাটায় ট্যাক্স ভ্যাট কমাতে হবে। নতুন ই- কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা চিন্তা করে মিডিয়া বায়িং এর ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাট- ট্যাক্স আগামি ২ বছরের জন্য হলেও কমিয়ে দেয়া জরুরি। কেননা তারা টিভি কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচারণার খরচ বহনে সক্ষম নয়।
মিজান-উর রশীদ
তরুণ অটোমোবিল ব্যবসায়ী
২০২০-২১ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেট এর পরিমান ৫৬৮,০০০ কোটি টাকা। যেখানে স্বাস্থ্যখাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা, কৃষি খাতে ২২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাবদ ৯৫ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে । যৌক্তিক হলেও আমার ভিন্ন এক জায়গায় একটি মতামত আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে শতভাগ সাফল্য পেতে হলে ইন্টারনেট নির্ভর সকল সেবা ভ্যাট বা করমুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
এছাড়া, করোনার কারণে অনেকের চাকরী চলে গেছে। ফলে দেশে বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে। বেসরকারি বিভিন্ন খাত বেতন কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ প্রবণতা বন্ধে সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার। আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি। সেটি আরও বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। আশাকরছি সরকার এটি গুরুত্ব সহকারে ভাববেন।
ঝুমনা মল্লিক ঝুমি
তরুণ সমাজকর্মী
এবারের বাজেট এ ভ্যাট নিয়ে মোটামুটি সবার মধ্যেই একটা ভুল ধারণা আছে । অনেকেই ভাবছেন অনলাইন সব সার্ভিস উপভোগ করার জন্যেই ১৫% ভ্যাট দিতে হবে। আসল বিষয়টি হলো ৭৬ টি সার্ভিসের কথা বলা হয়েছে যার মধ্যে আপনি যদি কোন সার্ভিসের জন্যে টাকা প্রদান করে তাদের সেবা গ্রহণ করেন, তাহলে এই ভ্যাট প্রযোজ্য। অর্থাৎ আপনি আপনার ব্যবসা পরিচালনার জন্যেই বাংলাদেশ সরকারকে ভ্যাট দিবেন।
এক্ষেত্রে অনেকের অনেক মন্তব্য আছে। কিন্তু যদি বিষয়টি এভাবে ভাবা যায় যে, ব্যাবসার মার্কেটিং এর জন্যে লাখ লাখ ডলার অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। এর অংশ থেকে ১৫% যদি দেশের কোষাগার এ জমা থাকে তবে খুব একটা সমস্যায় পরবেন না এই সার্ভিস ব্যবহারকারিরা।
তবে হ্যা, যারা ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান তারা এতে সমস্যায় পরবেন। কারন তাদের বাজেট খুব কম থাকে। বিশেষ করে যাদের অফিস বা দোকান নাই শুধুমাত্র এই অনলাইন প্লাটফর্ম ই তাদের একমাস ভরসা তাদের টিকে থাকাটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
তবে এই পরিস্থিতির এক ইতিবাচক দিক হতে পারে আমরা এখন কিছুটা হলেও পেইড মার্কেটিং এর উপর ভরসা কমিয়ে অর্গানিক মার্কেটিং এর দিকে মনযোগী হবো।
কানাডা আর আমেরিকা ছাড়া সব দেশই কিন্তু এই সার্ভিসের জন্যে ভ্যাট দিয়ে আসছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও ১৮% ভ্যাট দিচ্ছে অনেক আগে থেকেই।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে আমরা সাধারণত ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইনসহ আরো কয়েকটি সার্ভিস বেশ ব্যবহার করছি। তাই এক্ষেত্রে এখন ভাববার সময় এসেছে দেশি পাবলিশার্সদের নিয়ে। আমরা কিন্তু বিদেশি এই প্লাটফর্মগুলো ভায়া হয়ে দেশেই মার্কেটিং করছি। তাই এতো এতো রেমিট্যান্স দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশের ওয়েবসাইট গুলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়ার ট্রেন্ড চালু করাটা জরুরি।