অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাধ্য হয়ে চীনারা এখন দেশান্তরী


গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী চীন থেকে আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭,৭৩২ জন, ২০২০ সালে তা ১০৮,০৭১-এ পৌঁছে যায়।
গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী চীন থেকে আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭,৭৩২ জন, ২০২০ সালে তা ১০৮,০৭১-এ পৌঁছে যায়।

জাতিসংঘের মতে, গত এক দশকে চীন থেকে বিশ্বব্যাপী আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে।

যারা স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাচ্ছেন হংকং এবং চীনের মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দারা তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। কেউ কেউ নিপীড়ন থেকে বাঁচতে চায়, কেউ আবার অন্য দেশে তাদের পরিবারের জন্য নতুন সুযোগ খোঁজে। তাদের বিভিন্ন গন্তব্য রয়েছে, কেউ কেউ তাইওয়ানের দিকে যাত্রা করে এবং অন্যরা যায় এমনকী ইকুয়েডর পর্যন্ত।

আদমশুমারি ও পরিসংখ্যান বিভাগের উপাত্ত অনুসারে, ২০২০-এর মাঝামাঝি থেকে ২০২১-এর মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ৮৯ হাজার ২০০ জন বাসিন্দা হংকং ত্যাগ করেছে, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও বেশি।

চীন থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা ২০১০-২০২০
চীন থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা ২০১০-২০২০

হংকংয়ের একটি অভিবাসন মেলায় স্থানীয় বাসিন্দা এডউইন লাই ভিওএ-কে বলেন, “হংকংয়ে জীবনযাপনের পরিবেশ দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তাই একটি ভালো জায়গা খুঁজছি, যেখানে আমি আরও সুখী জীবনযাপন করতে পারবো”।

কয়েক মাস ধরে চলা সরকার বিরোধী বিক্ষোভের পর, ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে হংকংয়ে একটি নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন কার্যকর হয়।

লাই বলেন, “বাকস্বাধীনতা থেকে শুরু করে শিক্ষা পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে নানারকম সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া অনেক বিধিনিষেধ এবং নতুন নতুন আইন ও নিয়ম চালু করা হয়েছে”।

তাইওয়ান

তাইওয়ানের ন্যাশনাল ইমিগ্রেশন এজেন্সির তথ্য অনুসারে, হংকংয়ের লোকেরা ক্রমশ তাইওয়ানের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে।

ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট ক্যাসি ওং ভিওএ-কে বলেন, “বাক স্বাধীনতার জন্য আমাকে হংকং ছেড়ে যেতে হবে”। কেউ এমন কোনও শহরে বাস করতে চায় না, যেখানে প্রতিনিয়ত ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়”।

২০২০ সালে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ হংকং থেকে তাইওয়ানে চলে গেছে। এই সংখ্যা ২০১৯ থেকে প্রায় দ্বিগুণ, এবং এটা একটা রেকর্ড। তাইওয়ানের জাতীয় অভিবাসন সংস্থার তথ্য মতে, ২০২১ সালের প্রথম সাত মাসে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাইওয়ানে চলে যায় এবং এই স্থানান্তর পুরোটা বছর জুড়েই অব্যাহত ছিল।

ব্রিটেন

স্থানান্তরের জন্য আরও একটি জনপ্রিয় গন্তব্য হল ব্রিটেন। ২০২১ সালের প্রথমার্ধে, ৬৫ হাজারেরও বেশি হংকংবাসী সেখানে যাওয়ার জন্য আবেদন করে।

গত বছর, ব্রিটেন একটি নতুন ভিসা প্রোগ্রাম চালু করে — ব্রিটিশ ন্যাশনাল ওভারসিজ ভিসা বা বিএনও ভিসা — যেটি হংকংয়ের নাগরিক এবং তাদের পোষ্য-পরিজন, যারা বিএনও পাসপোর্ট ব্যবহার করতে পারেন, তাদের জন্য প্রযোজ্য। হংকংয়ের প্রায় ৫৪ লাখ বাসিন্দা ওই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার অফিসের উপাত্ত অনুসারে, গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী চীন থেকে আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭,৭৩২ জন, ২০২০ সালে তা ১০৮,০৭১-এ পৌঁছে যায়।

দূর থেকেও হুমকি প্রদান

পালিয়ে আসা অনেকেই উদ্বিগ্ন যে, তারা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর চীন তাদের নিপীড়নের চেষ্টা করবে; এদের মধ্যে অন্যতম উইঘুর সম্প্রদায়। মূলত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এই তুর্কি জনগোষ্ঠী বর্তমানে চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে বসবাস করে।

চীনা আটক কেন্দ্র থেকে পালিয়ে আসা উইঘুর শরণার্থীদের অন্যতম অভয়-আশ্রয়স্থল হল তুরস্ক। চীনা আটক কেন্দ্রে আটক রাখাকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ "মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ" হিসেবে অভিহিত করে। পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে প্রায় ৫০ হাজার উইঘুর সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করে।

চীন উইঘুরদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করে আসছে। ২০২০-এর আগস্টে, চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যম সিজিটিএন এই আটককেন্দ্র গুলিকে “বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে বর্ণনা করেছে, ধর্মীয় চরমপন্থা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য সেগুলি স্থাপন করা হয়েছিল”, বলে উল্লেখ করে দেশটি।

এনভার টার্ডি নামের এই উইঘুর যুবক তুরস্কে এক বছর আটক থাকার পরেও চীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলে চলেছেন।
এনভার টার্ডি নামের এই উইঘুর যুবক তুরস্কে এক বছর আটক থাকার পরেও চীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলে চলেছেন।

তুরস্কের সাথে চীনের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ে সুসম্পর্ক থাকার ফলে, তুরস্কে অবস্থানরত উইঘুর পরিবারগুলি এবং তাদের আইনজীবীরা বলছেন, সম্প্রদায়টি প্রতিনিয়ত আরও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তারা আশঙ্কা করছে, উইঘুর অধিকার কর্মীদের বিচার ও চীনে ফেরত পাঠানোর জন্য তুরস্ককে চাপ দেওয়া হচ্ছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ২০১৭ সাল থেকে, চীনা সরকার জিনজিয়াং অঞ্চল থেকে কমপক্ষে ১০ লক্ষ উইঘুর মুসলমানকে আটক করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, উইঘুরদের প্রতি চীনের আচরণ গণহত্যার শামিল।

বুগরা আরকিন, যিনি জিনজিয়াংয়ের একজন জাতিগত উইঘুর মুসলিম, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তার আশ্রয় মঞ্জুর করা হয়। তখন তিনি বলেছিলেন, চীনা কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ লোকদের একটি আটক কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল।

আরকিন ভিওএ-কে বলেন, “২০১৮ সালে, আমার বাবা, চাচা, আমার চাচাতো ভাই, আমার কিছু বন্ধু নিখোঁজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি যে, তাদের বন্দী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে”।

ল্যাটিন আমেরিকা

মিলি নামের চীনের একজন প্রাক্তন ইংরেজি শিক্ষয়িত্রী , যিনি এখন ইকুয়েডরে চীন থেকে আসা অভিবাসীদের সাথে কাজ করেন, তিনি বলেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চীন ছেড়ে যেতে চাওয়ার একটা বড় কারণ।

কানাডা

হুয়া ইয়ং, বেইজিংয়ের একজন শিল্পী। তিনি বলেন, তার নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে দরিদ্র চীনা নাগরিকদের উচ্ছেদ ও কষ্টের চিত্র দেখানো হয়েছে বলে তাঁকে বর্তমানে, কানাডায় আশ্রয় প্রার্থনা করতে হয়েছে। তিনি বলেন, তার কাজের কারণে চীনে থাকাকালীন তাকে একাধিকবার গ্রেফতার ও আটক করা হয়। এছাড়া চীনা কর্তৃপক্ষ তাকে ১৫ মাসের "শ্রমের মাধ্যমে পুনঃশিক্ষা" কর্মসূচিতেও আটকে রেখেছিল।

এমিলি পেই নামের এই মহিলা ১২ বছর আগে কানাডায় চলে আসেন
এমিলি পেই নামের এই মহিলা ১২ বছর আগে কানাডায় চলে আসেন

হুয়া ভিওএ-কে বলেন, “আমার শিল্পকর্মের কারণে, আমাকে এত বছর জেলে পুরে রাখা হয়েছিল এবং সরকারের দ্বারা নির্যাতিত হতে হয়েছিল। তাই মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না”।

XS
SM
MD
LG