অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

আমি মাসুমা খাতুন শ্রোতাদের কাছে বিদায় চাইছি


আমি মাসুমা খাতুন শ্রোতাদের কাছে বিদায় চাইছি
আমি মাসুমা খাতুন শ্রোতাদের কাছে বিদায় চাইছি

শুক্রবার, 30 ডিসেম্বর 2011

আমি মাসুমা খাতুন শ্রোতাদের কাছে বিদায় চাইছি

মাসুমা খাতুন

আমি মাসুমা খাতুন আজ শেষ বারের মত ভয়েস অব আমেরিকার একজন কর্মী হিসেবে প্রিয় শ্রোতা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছি। আজ দু’হাজার এগার সালের তিরিশে ডিসেম্বর - ভয়েস অব আমেরিকায় এবং আমার দীর্ঘ কর্ম জীবনের শেষ দিন। আমি অবসর নিচ্ছি। ভেবে পাইনা কী বলে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নেব।

১৯৬৫ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগ মিলিয়ে ৪৬ বছর দর্শক শ্রোতাদের নিয়ে ছিলাম। এ ছিল আমার জীবন ও জীবিকা, আমার পেশা ও নেশা। আর দর্শক শ্রোতারাই ছিলেন আমার সকল কাজের অনপ্রেরণা। বিশ্বাস করুন যখনই কোন অনুষ্ঠান করেছি ওপর ওয়ালাদের কথা ভাবিনি, শুধু মনে হয়েছে আপনাদের ভাল লাগবে কিনা, আপনারা কী চান? আমার মাধ্যমে যখন যা চেয়েছেন, যা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন পূরন করতে না পারলে আমার কি পরিমানে খারাপ লেগেছে আপনাদের বলে বোঝাতে পারবনা।

যারাই চাকরী করেছেন ভালভাবেই জানেন কর্মক্ষেত্র সদা কুসুমাস্তীর্ন নয়। কখনও যদি কোন কারনে মনে হয়েছে দূর ছাই কাজটা ছেড়েই দেব তখনই দর্শক শ্রোতাদের কথা ভেবেছি। ক্যামেরা বা মাইক্রোফোনের সামনে গেলে সব ভুলে শুধু আপনাদের সঙ্গে কথা বলেছি।

লক্ষ্য করবেন আমি একই সঙ্গে দর্শক ও শ্রোতাদের সম্বোধন করছি, তার কারন আমাকে অনেকে জানিয়েছেন তাঁরা বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমায় দেখতেন এখন ভয়েস অব আমেরিকা থেকে আমার কথা শোনেন। এমনও ঘটেছে এখানে আমেরিকাতে বহু প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিষ্ঠিত মানুষ এসে আমায় বলছেন ‘আপা আমাকে চিনতে পারছেন? আমি টেলিভিশনে আপনার ছোটদের আসরে অংশ নিয়েছি।’ এই তো কিছুদিন আগের কথা এখানে এক বাড়ীতে নিমন্ত্রন ছিল, এক ভদ্রলোক তাঁর মা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমার কাছে হাজির। মা বললেন আমার ছেলে ছোটবেলায় টেলিভিশনে আপনাকে দেখতো, পর্দা থেকে আপনি মিলিয়ে গেলে কেঁদে উঠতো। সেই মানুষটি তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমায় আলাপ করিয়ে দিলেন। আমার তখনকার অনুভূতি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে অপারগ। এমনি অনেক ঘটনা ও অভিজ্ঞতার মহামূল্যবান সঞ্চয় নিয়ে আমি আজ বিদায় নিচ্ছি।

বাংলাদেশ টেলিভিশন ও ভয়েস অব আমেরিকা আমার জীবনকে সার্থক ও ধন্য করেছে। আমি বলব টেলিভিশনের পথ ধরে আমার ভয়েসে আসার সুযোগ।

১৯৬৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে পরীক্ষামূলকভাবে টেলিভিশন শুরু হয়েছিল। তার আগেই একটা চিঠি পেয়েছিলাম ‘দেশে টেলিভিশন শুরু হচ্ছে আপনি একবার এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করুন।’ যেতে পারিনি কারন ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারী মাসে আরেকটি চিঠি। এক সন্ধ্যায় ঢাকার ডিআইটি বিল্ডিংএ তত্কালীন টেলিভিশন স্টুডিওতে হাজির হলাম। আজ শুধু একঢ়ি মাত্র নাম উচ্চারণ করব, সবার নাম বলা সম্ভব নয় বলে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠাতা, প্রথম পরিচালক, রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষক প্রয়াত কলিম শরাফী একটা লেখা ধরিয়ে দিয়ে বললেন ক্যামেরার সামনে গিয়ে পড়ে এসো। পড়লাম এবং সেদিন থেকেই বহাল হলাম। তিনি কী ভেবে আমায় ডেকে পাঠালেন কোনদিন প্রশ্ন করা হলোনা। তিনি আর এ পৃথিবীতে নেই।

সেই শুরু হয়েছিল আমার জন্য এক আনন্দের কর্ম জীবন। তবে আমার সামনে ছিলনা দেখে শেখার কিছু, ছিলনা কোন প্রশিক্ষন। যা কিছু করতে বলা হয়েছে নিজের মত করে ক্যামেরার সামনে বলে এসেছি। দর্শকরা আমায় গ্রহন না করলে আমি টিকে থাকতে পারতামনা।

বাংলা ভাষায় প্রচারিত পৃথিবীর প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠানমালা উপস্থাপন করেছি আটবছর। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের বিপুল বিজয় এবং অবশেষে জল্লাদ পাক বাহিনীর গনহত্যার মুখে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ ও বিজয়লাভ, পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলা দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন, ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফর--- এমনি সব ঐতিহাসিক ঘটনার কথা দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছি।

টেলিভিশনে আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, ছোটদের আসর পরিচালনা, ক্যামেরায দর্শকদের চিঠিপত্রের জবাব, বিদেশী শিল্পী ও শিল্পীদলের পরিবেশনা উপস্থাপনা। ওদের নাম সঠিক উচ্চারন করা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ।

বাংলাদেশ টেলিভিশন ছেড়ে এলেও, টেলিভিশনকে ছাড়তে পারিনি। বৃহত্তর ওয়াশিংটন এলাকার জন্য আমি এবং আমার স্বামী ওয়ালিউল্লাহ ফাহমী যিনি ছিলেন একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রযোজক-পরিচালক, আমরা স্থানীয় বাংলা ভাষীদের জন্য একটি সাপ্তাহিক টেলিভিশন অনুষ্ঠান তৈরী ও সম্প্রচার করেছি দীর্ঘ বার বছর - ১৯৯৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত। স্থানীয় শিল্পী, সাহিত্যিক আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেছি। অনুষ্ঠানটির নামকরণ করেছিলাম ‘বাংলা ভালবাসি’। হ্যা বাংলাকে ভালবেসেই প্রবাসে এই উদ্যোগ নিয়েছিলাম।

১৯৭৩ সালের জুন মাস শেষ ক’রে ওয়াশিংটন পৌঁছুলাম ভয়েস অব আমরিকার কাজ নিয়ে। যখন এলাম তখন ওয়াটার গেইট কেলঙ্কারীকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ইমপিচ করার প্রক্রিয়া চলছে। অবাক হলাম সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে একজন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের অপরাধ নিয়ে এমন খোলামেলা খবর আমরা সম্প্রচার করছি! যুক্তরাষ্ট্র এবং ভয়েস অব আমেরকিার প্রতি শ্রদ্ধা বোধ নিয়ে সম্পুর্ণ নতুন পরিবেশে নতুন ধারার কাজ শুরু করলাম।

আমার সবচেয়ে ভাল লাগার অনুষ্ঠান ছিল মিতালী, যা শুরু করেছিলাম ১৯৭৪ সালে, ‘মহিলা জগত্’ যা দীর্ঘ তেইশ বছর করেছি, সাপ্তাহিক ‘গীতি বিচিত্রা’। আপনাদের জন্য অনুষ্ঠান উপস্থাপনা অবশ্যই। সবচেয়ে স্মরণীয়? ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ও ভারতে আটটি শহর ঘুরে শ্রোতা বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি। ভয়েস অব আমেরিকা আমাকে পাঠিয়েছিল বলে সম্ভব হয়েছিল। তখন শ্রোতা ও শ্রোতা সঙ্ঘ গুলোর কাছ থেকে যে আদর ও সম্মান পেয়েছি তা আমার জীবনের সর্ব শ্রেষ্ঠ পাওয়া। আলাদা ভাবে কোনও নাম নিচ্ছিনা সবার নাম বলা সম্ভব নয় বলে। ১৯৮৫ এবং ১৯৯৫ সালে আমাকে যথাক্রমে নাইরোবী ও বেজিংএ আয়োজিত জাতিসঙ্ঘের দুটি বিশ্ব নারী সম্মেলনে পাঠিয়েছিল ভয়েস অব আমেরিকা আমি কৃতজ্ঞ সেজন্য।

ভয়েস অব আমেরিকার নাম করে কত জ্ঞানী গুনী মানুষের শরনাপন্ন হয়েছি, সময় অসময় তাদেঁর সাক্ষাত্কার নিয়েছি, বক্তব্য নিয়েছি কেউ বিমুখ করেননি। তাঁরা আমায় সমৃদ্ধ করেছেন। আজ তাদেঁর জানাই আমার কৃতজ্ঞতা।

এসব অমূল্য স্স্মৃতি নিয়ে আজ আমি বিদায় নিচ্ছি।

অনেকগুলি ঐতিহাসিক ঘটনা, কয়েকজন প্রেসিডেন্ট ও ভয়েস অব আমেরিকার কয়েকজন ডিরেক্টর এলেন এবং গেলেন। প্রত্যক্ষ করলাম আমেরিকান ইতিহাসে মহা বিপ্লব ঘটে গেল। যে দেশটি ক্রীতদাস প্রথা বিলোপ করার প্রশ্নে এদেশের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লড়েছিল, সে দেশের মানুষই ভোট দিয়ে প্রথমবারের মত একজন আফ্রিকী বংশদ্ভুত মানুষকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করলেন। সেই নির্বাচনে ভোট দিয়েছি। আর দেশ বিদেশের বাংলাভাষী মানুষদের কাছে বাংলা ভাষায় সেসব খবর পৌছেঁ দেয়ায় অংশ নিতে পেরেছি -- আজও রোমাঞ্চ হয়। তবে একটা দুঃখ থেকে গেল – যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষনা করে যেতে পারলামনা।

ভয়েস অব আমেরিকা, যে প্রতিষ্ঠান চল্লিশটিরও বেশী ভাষায় সারা পৃথিবীতে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে, যেন এক জাতিসঙ্ঘ। প্রতিদিন করিডোরে বেরুলে বিভিন্ন ভাষায় মানুষের সংলাপ শুনি, দশটা মানুষ সম্বোধন করে বলে মাসুমা কেমন আছ? প্রতিবারই অনাবিল ভাল লাগার একটা অনুভূতি হয়।

একসময় এই ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠান অন্যতম সেরা সার্ভিস বলে বিবেচিত ছিল। ইংরেজী বাদ দিয়ে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক চিঠি পেত বাংলা সার্ভিস। আর ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের শ্রোতারা যত শ্রোতা সঙ্ঘ গঠন করেছেন আর কোন ভাষার অনষ্ঠানে তেমন নজির নেই। এই সব শ্রোতা সঙ্ঘ আমাদের অনেক দিয়েছে। প্রতিদানে আমরা তাদের সামান্যই দিতে পেরেছি। তবু বন্ধুরা আপনারা কখনও মুখ ফিরিয়ে নেননি। আমরা আপনাদের কাছে কৃতঙ্গ। আর তাই বলছি আমার কাজ আমায় ধন্য করেছে, আমার জীবনকে সার্থক হয়েছে।

আমার প্রিয় শ্রোতা বন্ধুরা আপনারা যে যেখানে আছেন, আজ বিদায় বেলায় আপনাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জানাই ভালবাসা, শুভকামনা ও শুভ নববর্ষ।

সবশেষে একটা কথা - অদেখা শ্রোতাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল যেন ‘বিনি সূতোয় মালা গাঁথা – সেই মালা গলায় পরে আজ আমি বিদায় নিলাম।’

XS
SM
MD
LG