উগ্রবাদ নিয়ে উৎকন্ঠা এখন বিশ্বব্যাপী । যুক্তি পরাস্ত হচ্ছে বার বার অপশক্তির কাছে। ভক্তিও আনত প্রায় অপশক্তির উপদ্রবেই ।
গত অনুষ্ঠানে আমরা স্যামুয়েল হান্টিংটনে দ্য ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশান বা সভ্যতার সংঘাত নিয়ে কথা বলেছিলাম । হান্টিংটন যেমন সমসাময়িক কালে এই সভ্যতার সংঘাতকে দেখেছেন , দেখেছেন যে বিশ্বে নতুন সংঘাতের উৎস আদর্শিক নয় ততটা , যতটা সাংস্কৃতিক এবং এই সংস্কৃতির সম্প্রসারণে তিনি এ ক্ষেত্রে ধর্মের প্রসঙ্গটি ও এনেছেন। আসলে সংঘাতটি আদশিক নয় এ কথা যখন তিনি বলেন , তখন বস্তুত তিনি রাজনৈতিক আদর্শের কথাই বলেন , যে আদর্শের ভিত্তিতে শীতল যুদ্ধের সময়কার বিশ্ব ছিল বিভক্ত। কিন্তু আদর্শ তো কেবল রাজনৈতিক নয় , ধর্ম কিংবা সংস্কৃতিকেও কেউ আদর্শ বলে গ্রহণ করতেই পারে । সেখানে হান্টিংটনের তত্ব স্বয়ংসম্পুর্ণ নয় বলে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন। হান্টিংটন যে ভাবে আন্তঃধর্মীয় সংঘাতের কথা বলেছেন , তার সঙ্গে সহমত নন ইসলামাবাদে কায়েদে আজম ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক পারভেজ হুদভয়। তিনি বলছেন যে ধর্মের ভিত্তিতে একক ভাবে , এমন কী ব্যাপক ভাবেও একটি সভ্যতা কিংবা সংস্কৃতির সংজ্ঞা নির্নয় করাটা অতি সরলীকরণ বলা যায়। যেমন ধরুন গুয়াতেমালা কিংবা ব্রাজিলের একজন খ্রীষ্টান বা ধরুন ক্যাথলিক খ্রীষ্টানকে আপনি যদি ইটালি বা জার্মানী বা ফ্রান্সের ক্যাথলিকের সঙ্গে তুলনা করেন , তা হ’লে কতটুকুই বা মিল খুঁজে পাবেন? অথবা ধরুন আপনি যদি একজন পাঠান মুসলিমের সঙ্গে একজন বাঙালি মুসলিমের তূলনা করতে যান দেখবেন কোন অভিন্ন সংস্কৃতি , কোন অভিন্ন সভ্যতা সেখানে নেই।
প্রায় একই কথার প্রতিধ্বনি তুলে স্যামুয়েল হান্টিংটনের তত্বের ভ্রান্তি বিষয়টিকে পরিস্কার ভাবে বুঝিয়ে দিলেন ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির পলিটিক্স এন্ড গভর্ণমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ
বস্তুত হান্টিংটন এ রকম ভ্রান্ত তত্ব দাঁড় করিয়ে , যেন অনেকটাই সভ্যতার সংঘাতকে অনিবার্য করে তুলতে চাইছেন। অথচ অধ্যাপক আলী রীয়াজ এবং অধ্যাপক পারভেজ হুদোভয় যথার্থই বলেছেন যে অতি সরলীকৃত চিত্রটি সম্পুর্ণ ভুল। কেবল ভুল নয় বলা যায় বিপজ্জনক ও বটে। মুসিলম জাহান কথাটি দার্শনিক ভাবে ব্যবহার করাই যেতে পারে অনেকটা বিমূর্ত ভাবে কিন্তু এর প্রায়োগিক ব্যবহার বাস্তবতার নিরিখে বোধ হয় সঠিক নয়। কারণ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিল্প-সাহিত্য , সংস্কৃতি , খাদ্যাভ্যাস , পোশাক আশাকের মধ্যে বড় রকমের পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যকে মাথায় না রেখে কেবল মাত্র ধর্মের জিকির তুলে ১৯৭১ সালে জোর করে তদানীন্তন পাকিস্তান তার পূর্বাঞ্চলের স্বাধিকারকে অস্বীকার করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে ধর্মই অভিন্নতার একমাত্র রক্ষা কবচ হতে পারে না।
বস্তুত হান্টিংটন নিজের সভ্যতার সংঘাত তত্বকে নিজেই যেন খন্ডন করেছেন যখন তিনি বলেছেন যে কেবল আন্ত-সভ্যতার সংঘাতই নয় , একটি সভ্যতার ভেতরেও সংঘাত হতে পারে। যেমনটি পারভেজ হুদোভয় বলছেন যে হান্টিংটন বলছেন যে একই ধরণের সভ্যতার অন্তর্গত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও সংঘাত ও সহিংসতা দেখা দিতে পারে। তবে তিনি বলেন যে এই ধরণের সংঘাতের তীব্রতা , সভ্যতায় সভ্যতায় সংঘাতের তীব্রতার চাইতে কম হবে। আসলে হান্টিংটন সভ্যতার যে সংজ্ঞা দেন , সংস্কৃতি এবং ধর্মকে যে ভাবে অভিন্ন দর্শনে ব্যাখ্যা করেন সেটা বেশ বিভ্রান্তিকর। তা ছাড়া হান্টিংটনের কথা মতো সভ্যতার ভেতরে রাষ্ট্রে রাষ্টে সংঘাত ততটা তীব্র হবে না , এ রকম বক্তবের সঙ্গে ও দ্বিমত প্রকাশ করেছেন , অধ্যাপক হুদোভয় । তিনি বলছেন , যেমনটি আমরা সকলেই আজ দেখছি , সব চেয়ে তিক্ত সংঘাত হচ্ছে একটি ধর্মের ভেতরেই। যেমন ধরুন ইরাক-ইরান যুদ্ধ. যে যুদ্ধে দশ লক্ষের ও বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে । এক পক্ষ অপর পক্ষের শহরে ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, হাজার হাজার শিশু সৈন্য মারা গেছে। আর এই যুদ্ধে বিষাক্ত গ্যাস , রাসায়নিক অস্ত্র ও ব্যবহার করা হয়েছে।