উগ্রবাদ নিয়ে উৎকন্ঠা এখন বিশ্বব্যাপী । যুক্তি পরাস্ত হচ্ছে বার বার অপশক্তির কাছে । ভক্তিও আনত প্রায় অপশক্তির উপদ্রবেই ।
মানবতাবোধের প্রতি অকষ্মাৎ এই চ্যালেঞ্জ কেন , এর স্বরূপ কি , কী ভাবেই বা এ থেকে বেরিয়ে আসা যায় , এ সব কিছুর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ নিয়ে আমাদের এই রবিবারিক আয়োজন।
সভ্যতার সংঘাত বা ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশান তত্বটি নিয়ে যে নানা মুনির নানা মত রয়েছে , সে কথা আমরা গত অনুষ্ঠানগুলোতে আলোচনা করেছি এবং তাঁর এই তত্বের সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত ও প্রকাশ করেছেন , কিন্তু বিষয়টি সম্পুর্ণ ভাবে অবজ্ঞা করার মতো নয় । সে কথাই বলছিলেন ব্রিটেন থেকে পরমাণু বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক ড আনিসুর রহমান ।
অধ্যাপক আনিসুর রহমান বলছেন যে কবি রুডিয়ার্ড কিপলিং যেমন ভাবে পূর্ব-পশ্চিমকে আলাদা করে দেখেছেন এবং তাঁর কবিতায় বলেছেনও যে পূর্ব-পশ্চিম কখনই একত্রিত হবে না ,তেমন চাঁচাঁছোলা অর্থে এই সভ্যতার সংঘাতকে অধ্যাপক রহমান দেখছেন না। তিনি বলছেন এ সংঘাত হচ্ছে এক ধরণের আদর্শগত সংঘাত। তিনি
বলছেন যে পশ্চিমের মূল্যবোধের সঙ্গে ইসলামি মূল্যবোধের এক ধরণের দ্ব্দ্ব রয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি তাঁর এই ধারণার সমর্থনে ডেনমার্কের বিখ্যাত মনস্তত্ববিদ নিকোলাই সেনেলসকে উদ্ধৃত করে বলছেন তিনি বলছেন যে নিকোলাই সেনেলস মনে করেন যে রাগ দেখানোটা মুসলিম সংস্কৃতির একটা অংশ। উষ্মা প্রদর্শন করেই এক মুসলমান অন্য মুসলমানের তূলনায় গুরুত্ব পায় । তাঁর তত্ব অনুযায়ী মুসলমানদের মধ্যে সমতার অভাব রয়েছে। তাঁরা মনে করেন হয় আপনি তাদের ঊর্ধ্বে নয়ত নিম্নে । এই মনস্তাত্বিক কারণেই নিজের গুরুত্ব প্রদর্শনের এক ধরণের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে । এবং সেখানে রাগারাগি ও চেঁচামেচিটাই প্রধান হয়ে ও ওঠে। কিন্তু নিকোলাই সেনেলস এর এই তত্ব মেনে নেয়া যায় না কারণ তিনি যে ধরণের মুসলমানদের নিয়ে গবেষণা করেছেন , তারা অনেকেই বন্দি জিহাদি তাদের উষ্মা প্রকাশের উপায় হিসেবে তাঁরা নিজেদের গুরুত্ব প্রদর্শনের কথা বলেছে কিন্তু এটাকেই সার্বিক সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না। আর জাতিগত সহিংসতা সে কি আজ নতুন ? এতো কেবল একুশ শতকের কথা নয় । এ সম্পর্কে বিখ্যাত ভাষাতত্ববিদ এবং রাজনৈতিক চিন্তক নোয়াম চমস্কি প্রশ্ন তুলেছেন এটা কি ঠিক যে কুড়ি বছর আগেকার তুলনায় এখন জাতিগোষ্ঠিগত সহিংসতা বেড়েছে ? তিনি বলেন যে বেশির ভাগ যে সব লড়াই এখন চলছে তা তো শীতল যুদ্ধের সময় থেকেই চলে এসছে। বুরুন্ডি আর রোয়ান্ডার কথাই ধরুন না কেন , সেই সত্তরের দশকের গোড়া থেকেই সেখানে লড়াই চলছে। পরে ও সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের কোন রাজ্যে লড়াই হয়েছে। চেচনিয়ার কথাই ধরুন কিংবা আজারবাইজানের কথাই ধরুন কিংবা আর্মেনিয়া অথবা তাজিকিস্তান . এ সব লড়াই তো হয়েছে কিন্তু সে সব নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। তবে সেটাই স্বাভাবিক । যখনই কোন অত্যাচারী সাম্রাজ্যের পতন ঘটে তখন দেখবেন সব ধরণের সংঘাত শুরু হয়ে গেছে। মনে করুন ইউরোপীয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার কথা। কাজেই তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতেই এই ক্ল্যশ অফ সিভিলাইজেশান সঠিক নয়। তত্বের দিক থেকেও যে হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত ভুল সে সম্বন্ধে চমস্কি বলেন যে তাহলে ইসলামের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ কেন করা হয় ?
চমস্কি বলছেন সব চেয়ে বেশি মৌলবাদী , সব চেয়ে কট্টর মুসলিম দেশ হচ্ছে সৌদি আরব কিন্তু তারাতো যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশ । আমরা তো তাদের কোণঠাসা করি না কখনই । সেখানেতো পারিবারিক এক নায়কতন্ত্র চলে , তারা যে পয়সা আমাদের কাছ থেকে উপার্জন করে তেল বিক্রি করে সেটা তো আর জনগণের কাছে যায় না , যায় লন্ডন কিংবা নিউ ইয়র্কে। তারা তো আর সভ্যতার সংঘাতের অংশ নয়।
তবে এক ধরণের সংঘাত যে শুরু হলো এবং পশ্চিমের বিরুদ্ধে অনেকগুলো দেশের ক্ষোভ ও যে দানা বেঁধেছিল সে বিষয়টি নিকট অতীতের ইতিহাস। দূর্ভাগ্যবশত পশ্চিমের সঙ্গে সংঘাত বাধে যে সব দেশের সেগুলো অধিকাংশই মুসলিম প্রধান দেশ । সে জন্যই অতি সরলকৃত ভাবে একে সভ্যতার সংঘাত হিসেবে কেউ কেউ দেখে থাকেন । কিন্তু নামে যাই-ই বলা হোক না কেন এক ধরণের দ্বন্দ্ব দানা বেঁধে ওঠে। এ সম্পর্কে চট্টগ্রাম থেকে প্রবন্ধিক ও বিশ্লেষক আবুল মোমেন দ্বৈত আচরণের কথা বলেন।
এই দ্বিবিধ নীতির কথা নোয়াম চমস্কিও বললেন। চমস্কির মতো ইলিনয় স্টেট ইউনাভির্সিটির পলিটিক্স এন্ড গভর্ণমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজও হান্টিংটনের ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশান তত্বের সঙ্গে সহমত নন । এর আগের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন যে একুশ শতকের আগমনে এবং স্নায়ু যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে যে অতিশয় আশার সৃষ্টি হয়েছিল , সেটা ছিল এক ধরণের ভ্রান্ত আশা তবে তিনি এ কথাও বলেন যে সম্ভাবনা যে একেবারেই ছিল না , তা নয়
শান্তির সম্ভাবনা বিনষ্ট হওয়ার কিছু কিছু কারণ তুলে ধরলেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ । তাঁর কথার সুত্র ধরেই আগামি অনুষ্ঠানে আমরা দেখব উগ্রবাদের উৎপত্তির দিকটি এবং নতুন ওয়াল্ড অর্ডারের পরিবর্তে যে এক ধরণের ডিজ অর্ডার সষ্টি হল সেদিকটিতেও। উগ্রবাদ : উৎকন্ঠা ও উত্তরণ এই অনুষ্ঠানের পরবর্তী সংকলন আগামি রোববার।