উগ্রবাদ নিয়ে উৎকন্ঠা এখন বিশ্বব্যাপী। যুক্তি পরাস্ত হচ্ছে বার বার অপশক্তির কাছে। ভক্তিও আনত প্রায় অপশক্তির উপদ্রবেই ।
মানবতাবোধের প্রতি অকষ্মাৎ এই চ্যালেঞ্জ কেন , এর স্বরূপ কি , কী ভাবেই বা এ থেকে বেরিয়ে আসা যায় , এ সব কিছুর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ নিয়ে আমাদের এই রবিবারিক আয়োজনে আপনাদের সম্ভাষণ জানাচ্ছি , আনিস আহমেদ ।
যেমনটি এই অনুষ্ঠানে আমরা এর আগেও বলেছি যে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর এবং বিশেষত এই শতকের শুরুতে এক প্রচন্ড আশাবাদ প্রকাশিত হয়েছিল । পশ্চিমি গণতন্ত্রের পরিমাপে বিশ্বকে একত্রিত করার যে প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করেছি এই শতাব্দির শুরুতে তাতে প্রথম প্রচন্ড আঘাত আসে যুক্তরাষ্ট্রের উপর ১১ই সেপ্টম্বরের সন্ত্রাসী হামলায়। তার আগে পর্যন্ত এ রকম একটা আশা ছিল যে পশ্চিমে লিবারেল ডেমক্র্যাসি যাকে বলা হয় , তার প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। বিশিষ্ট রাষ্ট্র বিজ্ঞানি ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা ১৯৯২ সালে প্রকাশিত , The End of History and the Last Man বইয়ে মুক্ত গণতন্ত্রের বাহ্য বিজয়ের মাধ্যমে যে ইতিহাস সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন , সেটি দ্রুতই ভুল প্রমাণিত হলো। আর নতুন শতকে যে আশাবাদের কথা আমরা প্রায়শই বলে থাকি সে সম্পর্কে ও দ্বিমত প্রকাশ করছেন ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির পলিটিক্স এন্ড গভর্ণমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড আলী রীয়াজ ।
আদর্শের যে সংঘাতের কথা অধ্যাপক রীয়াজ বলছেন , সেই আদর্শ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আদর্শ শব্দটি ক্রমশই আপেক্ষিক হয়ে উঠছে কারণ বিশ্বে যে অভিন্ন আদর্শের কথা বলা হয় কিংবা অন্তত প্রত্যাশা করা গিয়েছিল অথবা সে রকম আদর্শ বিশ্ববাসী মেনে নিয়েছে বলে ফুকুইয়ামা মনে করেছিলেন, তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আদর্শ কিংবা যাকে আমরা মতাদর্শ ও বলতে পারি , সেটিও যে স্থান কাল পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত হতে পারে, সে কথা মানতেই হবে। কিন্তু আদর্শ বলে যাকে মানছি তা স্থাপনের জন্য কতখানি এগিয়ে যাবো , সেটা একটু ভাববার বিষয় । কারণ কথিত আদর্শকে মানিয়ে নিতেই আমরা দেখি জোর জবরদস্তিমূলক ঘটনা সহিংস উগ্রবাদ যার ফলে দেখা দেয় এক ধরণের সন্ত্রাসবাদ । সন্ত্রাসবাদের স্বরূপ তা হলে আসলে কি ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড নাঈমা হক বলেন
সন্ত্রাসবাদ শব্দটির মধ্যে যে ত্রাসের বিষয়টি রয়েছে , সেটিই সব চেয়ে মুখ্য। আদর্শ স্থাপনের জন্যই হোক কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্যই হোক ভয় দেখিয়ে কোন কিছু আদায় করার প্রয়াসই হচ্ছে সন্ত্রাস ।
আর এই সন্ত্রাস যখন সন্ত্রাসবাদে পরিণত হয় এটিকে এক ধরণের তাত্বিক যৌক্তিকতা দেবার চেষ্টা করা হয় , সেটা ধর্মীয় কারণেই হোক , কিংবা জাতীয় বা জাতিগোষ্ঠিগত কারণে । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি পর্যায়কে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বলে অভিহিত করা হতো , যেমন চট্টগ্রাম অস্ত্রগার লুন্ঠন । এই সব আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন মাস্টার দা সূর্য সেন কিংবা ক্ষুদিরাম । যদিও বা কোন রকমের সন্ত্রাস বা হত্যা সমর্থন যোগ্য নয় কিন্তু ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে এই ধরণের সন্ত্রাসবাদ ছিল বিচ্ছিন্ন এবং এর লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট, সীমিত ছিল কিছু অঞ্চলের মধ্যে। বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ এতটাই ব্যাপ্ত এবং বৈশ্বিক রূপ নিয়েছে যে তাকে কোন ভাবেই , কোন আদর্শিক শ্লোগানেই সমর্থন করা যায় না। তবু অনুসন্ধান করা যেতে পারে এই সহিংস উগ্রবাদের কারণ । অধ্যাপক আলী রীয়াজ আবার স্মরণ করিয়ে দেন যে পশ্চিমের লিবারেল ডেমক্র্যাসির বাহ্য বিজয় , সার্বিক নয় , বৈশ্বিক তো নয়ই । যদিও পঁচিশ বছর আগে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা যখন ইতিহাস সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন, তখন তাঁর যুক্তি ছিল গণতন্ত্রই সব রকমের সরকার পদ্ধতির ঊর্ধ্বে স্থান পাবে কারণ শান্তি ও প্রগতির জন্য মানুষের যে প্রকৃতিক ইচ্ছে সেটা থেকে মানুষ বিচ্যূত হবে না। এমনকী তিনি এ কথা ও বলেন যে কমিউনিস্ট দেশ ও যদি সমৃদ্ধি চায় , তা হলে তাদেরও খানিকটা পুঁজিবাদ মেনে নিতে হবে। কিন্তু যেমনটি একটু আগেই অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলছিলেন , ঠিক গণতন্ত্র নয় কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা ও যখন বহাল থাকে বিশ্বে কোন কোন অঞ্চলে , তখন এ কথা আর দাবি করা চলে না যে ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমেই ইতিহাস তার গন্তব্যে পৌঁছেছে।
কাজেই এ রকম পরিস্থিতিতে অনাকাঙ্খিত ভাবেই সহিংস উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । ব্যক্তি বা সমষ্টির জন্য এই সন্ত্রাসের কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে অধ্যাপক নাইমা হক পরিচিতি সংকটের কথা বলেছেন । এই পরিচিতি সংকট জাতিগোষ্ঠিগত হতে পারে , ধর্মীয় পরিচিতির বিষয়টিও আসতে পারে। তবে অধ্যাপক নাঈমা হক মূলত ব্যক্তির পরিচিতির কথাটি বলেছেন। পরিহাসের ব্যাপার হচ্ছে এই যে একুশ শতকের সার্বিক উন্নয়নের মধ্যেই যেন এই পরিচিতি সংকটের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। ব্যাপক এই উন্নয়নের মধ্যেই যেন হারিয়ে যাচ্ছে , ব্যক্তি সত্বা। আসলে কারণ যাই হোক না কেন , সন্ত্রাসবাদ বা সহিংস উগ্রবাদ নামের এই ব্যাধির নিরাময় প্রয়োজন।