অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নীতিমালার লক্ষ্যে জার্মানীর হামবার্গে জি-২০ সম্মেলন


শিল্পোন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর সম্মেলন হচ্ছে শুক্র ও শনিবার জার্মানীর হামবার্গে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নীতিমালা পরিচ্ছন্ন করাই এবারকার সম্মেলনের লক্ষ্য।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যোগ দিচ্ছেন সম্মেলনে। একই সঙ্গে বিশ্ব জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশের বসবাস যেসব দেশে সেইসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা যোগ দিচ্ছেন সম্মেলনে। বিশ্ব অর্থনীতির ৮০ শতাংশই তাদের নিয়ন্ত্রনে।

সম্মেলন শুরুর আগে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর নেতাদের প্রতি আইএমএফ আহবান জানিয়েছে যেনো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বানিজ্য ও অর্থনীতি খাতে যেসকল বৈপরিত্য ও মতানৈক্য রয়েছে তা তারা দূর করার মতো একটি নীতিমালা প্রনয়ণ করার চেষ্টা করেন।

আইএমএফ এক বিবৃতিতে বলেছে ধনী ও শিল্পোন্নত দেশের নেতাদের এই সম্মেলনে যদি অদূরদর্শী বা অষ্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয় তা বিশ্বের সকল দেশগুলোর জন্য ক্ষতির কারন হতে পারে। বৈশ্বিক বানিজ্যে মতানৈক্য যতদূর সম্ভব দূর করতে হবে।

তবে Australia’র RMIT University’র অধ্যাপক ইউরোপ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ Bruce Wilson বলেন জি-২০ সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ব্যাহত হতে পারে বৈশ্বিক কিছু চলমান সংকটের কারনে।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশের নেতৃবৃন্দ এবং সম্মেলনের বাইরে অনুষ্ঠিত সাইড মিটিংগুলোয় কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যেকার ওয়ান-টু-ওয়ান বৈঠকের মূল ইসু হয়ে উঠতে পারে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা, পারমানবিক কর্মসূচী কিংবা অপরাপর বৈশ্বিক সংকটের বিষয়গুলো।

“আগের অনেক জি-২০ সম্মেলন শহর এলাকার বাইরে করা হয়। জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঙ্গেলা মার্কেল হামবার্গের ডাউনটাউনকে ঠিক করেছেন এবারকার সম্মেলন ভেনু হিসাবে”।

ইতিমধ্যেই হাজার হাজার মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়েছেন। হামবার্গের সম্মেলনস্থলের বাইরে বিক্ষোভকারীরা ক্যাম্প করেছে। প্রতিবাদ বিক্ষোভ থামাতে অতিরিক্ত নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বুধবারই রওনা দিয়েছেন জি-২০ সম্মেলনের উদ্দেশ্যে। তবে সম্মেলনের আগেই তিনি কয়েকটি ইউরোপীয়ন দেশ সফর করছেন। শুরু করেছেন পোল্যান্ড সফর দিয়ে।

তবে জি-২০ সম্মেলনের আয়োজক দেশ জার্মানীর চ্যান্সেলর এ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সঙ্গে জলবায়ু বানিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যে মতানৈক্য রয়েছে তা নিয়ে অনেকে শংশয় প্রকাশ করছেন। তবে কাউন্টার টেরোরিজম বা সন্ত্রাস প্রতিরোধ এবং চীন ইসূ্তে ট্রাম্প এ্যাঙ্গেলা ঐকমত্যে আসতে পারেন বলে অনেকের ধারনা। এ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতের আমিল থাকলেও বিভিন্ন বিষয়ে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।

“আমি মনে করি অন্যান্য বহু বিষয়ে আমাদের মতের মিল রয়েছে। অমিলও রয়েছে অনেক বিষয়ে। ঐসব আমিল বা মতনৈক্য সরিয়ে রেখে যেসব বিষয়ে সমঝোতা সম্ভব তার চেষ্টা করা হবে। আন্তর্জাতিক কুটনীতি নিয়ে আমরা আলোচনা করবো”।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন তিনি স্টিল আমদানীতে শুল্ক কমানো এবং কোটা বসানোর চিন্তা করছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প খাতের জন্য মারাত্মক একটি হুমকী হতে পারে। তার এ্যামেরিকা ফার্ষ্ট নীতিমালারও পরিপন্থী। এসব কথায় যুক্তরাষ্ট্রেরর জি-২০ অংশীদারেরাও শংকিত। TIM EVANS, POLITICAL ECONOMIST, MIDDLESEX UNIVERSITY যেমনটি বলেন।

“তিনি যা করছেন তা হচ্ছে সব ধরনের কার্ড তিনি চেলে দিচ্ছেন। নাফটা, জলবায়ু পরিবর্তনের সমালোচনা, এর সবই হচ্ছে তার জিরো-ভিত্তিক পলিসির কারনে। আমার ধারণা সবশেষে তিনি সম্ভবত মুক্তি বানিজ্যের কথাই বলবেন- একটি উইন উইন অবস্থা ঠিক রেখে। তবে এখন যেসব কথা বলছেন তাতে চীনের মতো দেশগুলোকে খানিকটা চাপে রাখতে চান। সম্মেলনে নানা বিষয়ে মতানৈক্য হবে”।

ট্রাম্পের নানা সময়কার নানা মন্তব্যে অনেকে চিন্তিত। নেটোর পক্ষে না থাকার তার এক সময়কার ঘোষণা এভাবে নেটোভুক্তদেরকে চিন্তায় ফেলেছিল। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত করেন নি। অংশীদারদেরকে উপযুক্ত পরিমান নেটোর জন্য খরচ করার পরামর্শ দিয়েছেন। North American Free Trade Agreement তিনি না রাখার কথা বললেও এখন মেক্সিকোর সঙ্গে চিনি রপ্তানী চুক্তি করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার টার্গেট হচ্ছে চীন। চীনের সস্তায় ষ্টিল রপ্তানীকে যুক্তরাষ্ট্র ভালোমত নিতে পারছে না। বলা হচ্ছে এর মধ্যে দিয়ে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয় জার্মানী বৃটেনসহ জি-২০ রাষ্ট্রের বহু দেশের কর্মসংস্থান কমছে।

জলবায়ু এবারকার সম্মেলনের বড় ইসু। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন চীনের ষ্টিল রপ্তানীর আলোচনায় জলবায়ু বিষয়টি মিইয়ে যেতে পারে। SHANKER SINGHAM, LEGATUM INSTITUTE যেমন বলেন।

“যুক্তরাষ্ট্রের মতো জি-২০ ভুক্ত অনেক দেশই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। উদাহরনস্বরূপ বৃটেন। সেখানকার Port Talbot and Redcar এর স্টিল কারখানাগুলো বন্ধ। কম খরচে ষ্টিলের চীনের রপ্তানী এ্যাতো বেশি যে স্থাণীয় উৎপাদনের স্টিল পড়ে থাকে, কেউ কেনে না। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও ও পেনসেলভেনিয়ার স্টিল কারখানায়ও একই অবস্থা। সকলেই চীনের কাছ থেকে সস্তা স্টিল কেনে। ফলে চীনের ষ্টিল কারখানা এবারকার সম্মেলনের বড় টার্গেট হতে পারে”।

নেতৃবৃন্দ যদি কমন গ্রাউন্ড বের করতে পারে তবে এই সম্মেলনটি সফল হবে বলে অনেকে মনে করছেন।

আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের জি-২০ সম্মেলনে যোগদানের বাড়তি পাওনা ইউরোপিয়ন দেশগুলোর বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেকার বৈঠক। শুক্রবার বৈঠকটি হওয়ার কথা।

যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বৈরী সম্পর্ক ঠিক করতে এ বৈঠক বড় অবদান রাখতে পারে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ সন্দেহে ঐ সম্পর্ক আরো খারাপ হয়। এখনো ঐ বিষয়টি তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা।

ট্রাম্প-পুতিন প্রথম সামনাসামনি বৈঠক হচ্ছে জি-০২০ সম্মেলনের সাইডলাইন বৈঠক হিসাবে হামবার্গে। বলা হচ্ছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ হবে আলোচনার মুখ্য ইসু। সিরিয়া ইউক্রেন প্রসঙ্গ আসবে আলোচনায়।

হোয়াইট হাউজ বলছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাৎক্ষনিকভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন কি বিষয়ে আলোচনা করবেন তিনি। নরম্যাল বাইল্যাটারাল মিটিং বা স্বাভাবিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক বলা হচ্ছে একে। বিশ্লেষকরা বলছেন ট্রাম্প বহু প্রসঙ্গ আনবেন আলোচনায়। STEPHEN SESTANOVICH, COUNCIL ON FOREIGN RELATIONS যেমনটি বলেন:

“প্রেসিডেন্টের নিজস্ব কিছু বিষয় আছে। তিনি নিজেই নিজের মতো ঠিক করেন কি নিয়ে কথা বলবেন। আমাদেরকে হঠাৎ কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এটা তার নিজস্ব স্টাইল”।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে যেসব ঘটনা চলছে দুই দেশের সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে তা নিয়ে বৈঠকে ওই আলোচনা আসতে পারে এবং আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে। HANNAH THOBURN, HUDSON INSTITUTE বলেন:

“পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যে কি আলোচনা হয়, তা না হওয়া পর্যন্ত আন্দাজ করা কঠিন। ট্রাম্প কি পুতিনের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করলেন? রাশিয়া নিয়ে যারা ট্রাম্পের সমালোচনা করে সেই কারনে বৈঠকের সময় ট্রাম্পের মনোভাব কেমন? এসব নানা প্রশ্ন মানুষের মনে। বৈঠকের পর এসবের উত্তর জানা যাবে”।

রাশিয়ানরা আশা করছেন দুই নেতার বৈঠকের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক ভালো হবে। KONSTANTIN, MUSCOVITE বলেন:

“এ রকম সম্পর্ক দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে পারে না। কেউ না কেউকে বুঝতে হবে যে সমঝোতা না করলে অগ্রগতি হবে না”।

ফলাফল যাই হোক দ্বিপাক্ষিক ওই বৈঠকে ক্রেমলিনের পক্ষেরই লাভ বেশী হবে। ফলাফল খারাপ হলে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযোগ করবে। আর ফলাফল ভালো হলে পুতিন ক্রেডিট নেবেন।

তবে ট্রাম্প পুতিন আলোচনার ফলাফল যাই হোকনা কেনো জি-২০ সম্মেলনে বৈশ্বিক সংকট নিরসনে জলবায়ু, সন্ত্রাস, বানিজ্যসহ নানা বিষয় সুস্পষ্ট নীতিমালা গৃহীত হবে।

XS
SM
MD
LG