৩০শে আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম দিবস। নিখোঁজ স্বজনের ছবি নিয়ে তারা এসেছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবে। কেউ খুঁজছেন সন্তানকে, কেউ বাবাকে, কেউ ভাইকে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার বলছে, ২০০৯ থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ৬০৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৫৩জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন, ৮১ জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং ৩৬৯ জন নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন থেকে কয়েক মাসের ভেতর ফিরে এসেছেন।
আনিসা ইসলাম প্রেস ক্লাবে এসেছিলেন ঢাকার মিরপুর থেকে। তার বাবা ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বাতেন ২০১৯ সনে নিখোঁজ হন। তার কথা, বাবাকে ফিরে পেতে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে জানি না। কুষ্টিয়ার জান্নাতুল ফেরদৌসি জিনিয়া ৬ বছর আগে তার নিখোঁজ স্বামী সাজ্জাদ হোসেনকে এখনও খুঁজে বেড়ান। কিন্তু কেউ খোঁজ দিতে পারে না।
বিরোধী কর্মী সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহানা বানু মুন্নি বলেন, আমার ভাইয়ের কোনো শত্রু ছিল না। সে শুধু রাজনীতি করতো। এ কারণে তাকে গুম হতে হয়েছে। আট বছর ধরে আমরা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার ভাইয়ের জন্য আমার মা শয্যাশায়ী। তিনি বলেন, রাজনীতি করতো, এটা যদি অন্যায় হয় তাহলে এখন যারা ক্ষমতাসীন তারাও রাজনীতি করছেন। তারা তাহলে রাজনীতি ছেড়ে দিক। মুন্নি যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন তার হাতে তার ভাই পিন্টুর একটি ছবি ছিল।
গুম হওয়া খালেদ হাসান সোহেল এর স্ত্রী শারমিন সুলতানা বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে সোহেলকে তুলে নেয়া হয়। আট বছর ধরে তাকে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু কোনো সন্ধান পাননি। সোহেল গুম হওয়ার সময় তার সন্তানের বয়স ছিল ৫ বছর। এখন তার তের বছর বয়স। এখন সে তার বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। সোহেলের বাবা তার সন্তানের চিন্তায় স্ট্রোক করেছেন। আমাদের একটাই দাবি সোহেলকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিন।
ছাত্রদল নেতা সোহেলের ছোট্ট মেয়ে সাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, সবাই বাবার হাত ধরে স্কুলে যায়। আমি যেতে পারি না। আপনারা আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন।
গুম হওয়া আনোয়ার হোসেনের মেয়ে রাইসা বলে, ১৬ সালে তার বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে কারাগারে তার মৃত্যু হয়। রাইসা বলে, রাজনীতি করার কারণে আমার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি আমার বাবা হত্যার বিচার চাই।
এভাবেই বর্ণনা করছিলেন গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা। সবারই এক কথা- এভাবে আর কতকাল অপেক্ষা করে থাকতে হবে। বাংলাদেশ সরকার বরাবরই অস্বীকার করছে। বলছে, এসব গুমের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ধারাবাহিকভাবে এই গুমের ঘটনাগুলোর তদন্ত দাবি করছে। মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বলপূর্বক গুম বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে টার্গেট করার বিরুদ্ধে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, মানবাধিকার রক্ষা ও মানবাধিকারকে উন্নত করতে আন্তর্জাতিক যেসব বাধ্যবাধকতা রয়েছে তার প্রতি সম্মান দেখাতে এবং তা অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস সেন্টার এক যৌথ বিবৃতে এসব গুমের সঙ্গে সরাসরি সরকারের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ করেছে। বলেছে, সরকার এসব অভিযোগ আমলেই নিচ্ছে না, তদন্ত করে দেখছে না। যেখানে সরকারের সমালোচক ও বিরোধীকর্মী দিনের পর দিন নিখোঁজ রয়েছেন। এসব পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডি পর্যন্ত করতে পারছেন না। তাদের নানাভাবে হয়রানি ও হুমকি দেয়া হচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, তারা আগামী ৩১শে আগস্ট মার্কিন কংগ্রেশনাল টম ল্যান্টস হিউম্যান রাইটস কমিশনকে এসব গুমের ঘটনা তুলে ধরবে। এই ব্রিফিংয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে গুমের ঘটনাগুলো অবহিত করা, যাতে তারা বাংলাদেশকে বলতে পারে- এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রতিটি অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বলেছে, গুমের শিকার সব ব্যক্তিকে অবিলম্বে খুঁজে বের করে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া এসব গুমের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার কথা বলেছে সংস্থাটি। গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করা, গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোকে অস্বীকার না করে এ ধরনের ঘটনার বিচার নিশ্চিতে বিদ্যমান আইন কাঠামোতে পরিবর্তন আনা এবং অপহরণ হিসেবে নয়, গুমকে সুনির্দিষ্ট অপরাধ হিসেবে আইনে অন্তর্ভুক্তির কথাও বলেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার সমূহের উত্থাপিত অভিযোগ নিয়ে একটি জাতীয় শুনানির আয়োজন করার প্রস্তাব দিয়েছে।
ওদিকে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, কোনো ব্যক্তি যদি গুম বা নিখোঁজ হয় তাহলে তার পরিবার নিয়ম অনুযায়ি থানায় মামলা দায়ের বা অভিযোগ দেবে। তারপর পুলিশ তদন্ত করবে। তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি উৎঘাটিত হবে।