দু সপ্তাহ আগে, দক্ষিণ ফ্রান্সের বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যান আসিয়া সাইদি। তিনি তাঁর ফেইসবুক পেইজে কারণ হিসেবে বলেছেন, তিনি সিরিয়া যাচ্ছেন জিহাদে যোগ দিতে। তাঁর পরিবারের সদস্য ও তদন্তকারীরা ব্যাপক অনুসন্ধান ততপরতা শুরু করে। গত শনিবার জানা গেল, ১৫ বছরের আসিয়া মারসেই-এর একটি বারে কাজ করছে।
ফরাসী রেডিওকে আসিয়া বলেছেন, ওয়েবের মাধ্যমে সে জিহাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু মারসেই-এর মানুষ তাকে বলেছে, যারা তাকে জিহাদে যোগ দিতে উতসাহ যোগাচ্ছে, তারা আসলে সন্ত্রাসী।
অবশ্য এই ধরনের গল্পের শেষটা খুব কম ক্ষেত্রেই সুখের হয়েছে। শত শত তরুণী পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য উগ্রপন্থী দলে যোগ দেবার জন্যে মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে। সঠিক সংখ্যাটা বলা কঠিন, অবশ্য ফ্রান্স থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তরূণী জিহাদে যোগ দিয়েছে। এ অঞ্চল থেকে প্রতি ১ হাজার জনে ৬০জন নারী জিহাদে যোগ দিয়েছে।
লন্ডনের কিং কলেজের, নিরাপত্তা বিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক ক্যাথরিন ব্রাউন জিহাদ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা নিয়ে কাজ করছেন।
তিনি বলছিলেন, এই মুহুর্তে উগ্রপন্থী হয়ে ওঠার প্রবণতা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অবশ্য এ বিষয় আমাদের ধ্যান ধারণ খুব কম। কারণ, এ বিষয়টা খুব স্পষ্ট প্রত্যেকের জিহাদে যোগ দেবার কারণ ভিন্ন।
মিজ ব্রাউন বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম বিশ্লেষণ করে দেখতে চেষ্টা করেছেন, কেন পশ্চিমা দেশের তরুণীরা জিহাদে যোগ দিচ্ছে।
তিনি বলছিলেন, নারীরা ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে, উগ্রবাদী দলে যোগ দেয় বা ইসলামী দেশগুলো সফর করে। এর সঙ্গে অনুভূতি জড়িত, এই ধারণার আমি প্রতিবাদ করি। সেইসঙ্গে আমি মনে করিনা, তারা স্বামি পাবার জন্যে এগুলো করছে। এগুলো অযৌক্তিক এবং করা হচ্ছে, অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করে।
তিনি বলছেন, অনেকে যায় জিহাদী ব্রাইড বা জিহাদী কনে হতে। কিন্তু অন্যরা একটি ইউটোপিয়ান ইসলামিক রাষ্ট্রের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আর এই ধারণাটাই তারা প্রচার করতে চেষ্টা করছে, তাদের নিষ্ঠুর আচরণ সত্ত্বেও।
ফরাসী নৃবিজ্ঞানী, দুনিয়া বুজার উগ্ররবাদ প্রতিরোধের জন্যে যে নতুন প্যারিস সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তার প্রধান। তিনি বলছেন, পুরুষরা অন্যায় অবিচারের মোকাবিলায় সনাতনী ধারার মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আর অন্যদিকে, মেয়েদের আকৃষ্ট করার জন্যে তারা মানবিক দিকটি তুলে ধরে।
বুজার বলছেন, নারীদের এই পথে নেওয়ার জন্যে তারা প্রথম যে পদ্ধতি অবলম্বন করে, তা হলো তারা মেয়েদের বোঝানোর চেষ্টা করে, তাদের প্রিয়জনদের রক্ষ্যা করতে হলে তাদেরকে পবিত্র ভূমিতে মারা যেতে হবে। এর বাইরে তারা বলে, সেখানে মানবিক সাহায্যের প্রয়োজন। যেমন, চিকিতসা ও সেবা দেওয়া, সমাজ-কল্যাণকর কাজ, মূলত এই ধরনের পরহিতকর কাজ।
অবশ্য ইসলামিক স্টেট আরো সক্রিয় বার্তাও পাঠাচ্ছে। বললেন, ইসলাম বিশেষজ্ঞ এবং প্রাক্তন উর্ধ্বতন সন্ত্রাস-বিরোধী কর্মকর্তা লুইয়ি কাপ্রীওলি।
তিনি বলছেন, শুধু সেবামূলক কর্মকান্ড নয়, মেয়েরা সক্রিয়ভাবে জিহাদে অংশ নিক, এই ধারণা ইসলামিক স্টেট সমর্থন করে। তিনি বলছেন, ভিডিওতে দেখা গেছে, মেয়েরা কঠিন ভাষা ব্যবহার করছে, এবং বলছে, তারা মানুষ হত্যা করবে। তাদের হাতে কালাসনিখভ বা এ-কে-47 রাইফেল দেখা গেছে।
ব্রাউন বলছেন, এই ছবিগুলোর মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। যদিও খুবই স্বল্প সংখ্যক নারী সরাসরি যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই এর গুরুত্ব অনেক। কারণ, মেয়েরা সহিংস কাজে লিপ্ত হচ্ছে এই ধরনের ছবি খুব শক্তিশালী। এটা এক ধরনের প্রপাগ্যান্ডার কৌশল।
যারা জিহাদে যোগ দিচ্ছে তাদের অনেকেই মুসলমান। যারা মনে করে তারা ইউরোপীয় সমাজে প্রত্যাখ্যাত। ১৭ বছরের হেলেন বড় হয়েছে প্যারিসের উপকন্ঠে একটি নাস্তিক পরিবারে। দুবছর আগে সে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। ফ্রান্সের লো মনদ সংবাদপত্র জানিয়েছে, সে কিভাবে একজন কুয়েতী ধর্মপ্রচারকারীর ভিডিও দেখত এবং তার একজন মিশরীয় ছেলেবন্ধু ছিল। সেই ছেলেবন্ধুটি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে তাকে এমন দেশে নিয়ে যাবে যেখানে শরিয়া আইন প্রচলিত।
বুজার বলছেন, এই মেয়েদের ইসলামের বিশ্বাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই।
তিনি বলছিলেন, এই তরুণী জনগোষ্ঠীর তিন চতুর্থাংশ কোনদিন মসজিদে পা রাখেনি। হয়তো মঙ্গলবার তারা শুকরের মাংস খাচ্ছে, আর বুধবার তারা সিরিয়ায় চলে যাচ্ছে। ধর্মীয় বিষয়গুলো কখনই সেভাবে শুরুতে বলা হয় না, সেগুলো নিয়ে ভাবতে হয় শেষদিকে এসে।
বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্রিওলি আরো বলেছেন, তরুণ ক্যাথলিক ধর্মানুসারীরা জঙ্গী ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
তারা দেখে ক্যাথলিক ধর্মে যেসব কঠোর নিয়মকানুন আছে ইসলামে তা নেই। তার আবিষ্কার করে, ইসলামে নারীর প্রতি বিশেষ সম্মান দেখানো হয়েছে। যে পশ্চিমা সমাজে তারা বসবাস করে সেখানে, মেয়েরা প্রতিনিয়ত নির্যাতন বা বলাতকারের শিকার হচ্ছে। তারা তখন মনে করে, ইসলামে নারীদের অবস্থান ভিন্ন এবং তাদের ঐ ধরণের সহিংসতার শিকার হতে হয় না।
অবশ্য বাস্তব চিত্র ভিন্ন। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে ইরাকের মহিলাদের বিরুদ্ধে ইসলামিক স্টেটের নৃশংসতার চিত্র বেরিয়ে এসেছে। যেখানে হত্যা এবং যৌনদাসত্বের কথা উল্লেখ আছে। গবেষক ব্রাউন বলছেন, এর ফলে, এই পশ্চিমা জিহাদীরা আরেকটি অন্য চেহারা দেখতে পায়।
তিনি বলছেন, আমরা দেখছি, তারা যা কল্পনা করেছিল তার তুলনায় পরিস্থিতি অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। এরকম টুইটও চোখে পড়ে, আমরা কোথায় হেয়ার ড্রাইয়ার পেতে পারি? অথবা, সবার জন্যে টয়লেট একটাই। যখন তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে তখন তারা এ বিষয়গুলো চিন্তা করে না।
ফ্রান্সের আভিনিয়ন শহরের, মেয়ে ১৬ বছরের নুরা এল-বাথি এখন আটকা পড়ে গেছে। মে মাসে, তার ভাই ফুয়াদ সিরিয়ায় গিয়ে তাকে দেখে আসে। স্থানীয় মিডিয়াকে সে বলেছে, তার বোনকে ফিরিয়ে আনতে সে ব্যর্থ হয়েছে। নুরা তাকে জানিয়েছে, সেই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।