অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

দুর্দশার চরমসীমায় গিয়ে পৌঁছেছেন ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকেরা


করোনা অতিমারী যখন বিদেশের সীমানা ছাপিয়ে এসে ভারতে থাবা মেরেছে, ঠিক সেই সময় গত ২২শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একদিনের জন্য জনতা কারফিউ ঘোষণা করলেন। বললেন, এটা একটা রিহার্সাল। আমাদের তৈরি থাকতে হবে যাতে সংক্রমণ এড়াতে বাড়ির বাইরে না বেরিয়ে আমরা কিছুদিন থাকতে পারি। এর দু'দিন পরেই ২৪শে মার্চ মাত্র ৩ ঘন্টার নোটিসে তিনি সারাদেশে লকডাউন জারি করলেন ২১ দিনের জন্য। তারপর থেকে সেই লকডাউনের মেয়াদ বাড়তে বাড়তে চার মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। কোনও কোনও রাজ্যে লকডাউন খুলেছে, কোনও কোনও রাজ্যে এখনও চলছে আংশিকভাবে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে কেরালায় বা মহারাষ্ট্রে। আকস্মিকভাবে লকডাউন ঘোষণা করার পরেই সারাদেশে যে কয়েক কোটি পরিযায়ী শ্রমিক নিজের রাজ্য নিজের গ্রাম নিজের বাড়ি ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে, কাজের সন্ধানে অন্যান্য রাজ্যে গিয়ে আস্তানা গেড়েছিলেন তাঁরা ভয় পেয়ে, খাবার না পেয়ে, ভাড়া দিতে না পারায় বাসস্থান থেকে উৎখাত হয়ে, টাকা পয়সা জোগাড় করতে না পেরে দলে দলে কেউ একা, কেউ সপরিবার নিজের নিজের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিলেন। সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য, ধূসর প্রান্তর পার হয়ে রাস্তায় চলতে চলতে ক্ষতবিক্ষত পায়ের সেই ছবি আমরা সকলেই দেখেছি আর বেদনার্ত হয়েছি। সেই যাত্রাপথে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। কখনও বিশ্রাম নিতে গিয়ে ট্রেনের চাকার তলায় কাটা পড়ে, কখনও বা ক্লান্তিতে, কখনও কোনও দুর্ঘটনায়। এভাবে নিজের গ্রামে পৌঁছানোর পর তাঁরা ভেবেছিলেন আশ্রয় ও খাদ্য জুটবে। তখন ধারণা ছিল লকডাউন চলবে কিছুদিন। কিন্তু পরে যত দিন গিয়েছে ততো তাঁদের সেই আশা তিরোহিত হয়েছে এবং এখন তাঁরা দুর্দশার চরমসীমায় গিয়ে পৌঁছেছেন। বলাবাহুল্য এইসব পরিযায়ী শ্রমিক শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয় সারা ভারতের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গিয়ে কাজ করেছেন। এঁরা প্রত্যেকেই শ্রমিক। কেউ নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন, কেউ হস্তশিল্পে, কেউ সোনা বা জরির কাজে, কেউ ফুল বাগিচায়। কাশ্মীর ও হিমাচল প্রদেশের ফল বাগিচায় কর্মীদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেকে ছিলেন। কাশ্মীরে জঙ্গিদের লক্ষ্য হয়েছেন এঁরাই। একের পর এক জঙ্গিদের গুলিতে মারা যাওয়ার পর সেখান থেকে সকলে পালিয়ে চলে আসেন নিজের নিজের জায়গায়, আর কোনওদিন ফিরে যাবেন না প্রতিজ্ঞা করে। হিমাচল প্রদেশে অবশ্য অন্যত্র কাজে যাওয়া হিমাচলীরা ফিরে গিয়ে নিজের নিজের জায়গায় বাগিচায় কাজ করা শুরু করেছেন এবং মোটামুটি ভালোই আছেন। সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি হয়েছে তাঁদের যাঁরা কেরালায় মহারাষ্ট্রে উত্তরপ্রদেশে গুজরাতে তামিলনাড়ুতে নানান রকমের কাজ করছিলেন। আমি মূলত বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের কথাই বলছি। যেমন ধরা যাক হাওড়া জেলার শ্যামপুরের বাসিন্দা দুই তরুণ শ্রীমন্ত সামন্ত আর বিজয় পাত্র। তাঁরা কেরালার ত্রিশূর শহরে সোনার দোকানে কাজ করতেন। একবার ট্রেনেই তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। হাসিখুশি, ভালো কাজ করেন এবং ভালোভাবে আছেন। লকডাউনের সময় আরও লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের মতো তাঁরাও পালিয়ে এসেছিলেন কেরালা থেকে হাওড়ায় নিজেদের গ্রামের বাড়িতে। এখন তাঁদের খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে, কী করবেন বুঝতে পারছেন না। এরকম আরও বহু বহু জন ভুগছেন। এই বিষয়ে আমরা কথা বলেছিলাম আনন্দবাজার পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক অনমিত্র চ্যাটার্জির সঙ্গে। তিনি এই ধরনের বেশ কিছু খবর করেছেন, বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করেছেন।

সাংবাদিক অনমিত্র চ্যাটার্জির কাছ থেকে আমরা মোটামুটি একটা ছবি পেলাম, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা ও জীবন সংগ্রামের কাহিনির। কবে তাঁদের এই দুরবস্থা ঘুচবে কেউ জানে না। তবে এমন একদিন নিশ্চিত আসবে যখন আবার সারাদেশে আটকে থাকা নির্মাণকাজ বা অন্যান্য শিল্প ও ব্যবসা চালু হবে। সেই সময়ের আশায় সকলেই দিন গুনছেন। ভারতের মতো একটা গরিব দেশে যেখানে জনসংখ্যা এতো বেশি, সেখানে এই কোটি কোটি শ্রমিকরাই কিন্তু শিল্পের চাকা চালু রেখেছেন। যদি অবিলম্বে তাঁদের আবার কাজে লাগানো শুরু না হয় তাহলে তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অর্থনীতিও ধ্বংস হয়ে যাবে।

সরাসরি লিংক


XS
SM
MD
LG