সেলিম হোসেন
মুষ্টিযুদ্ধের জগতে কিংবদন্তী ব্যক্তি মোহাম্মদ আলী ৩২ বছর ধরে পার্কিন্সস রোগের সঙ্গে লড়াই করে মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
সাবেক হেভিওয়েট চ্যাম্পীয়ন শ্বাস কষ্টে ভুগছিলেন যা পার্কিন্সন্স রোগের কারণে আরো জটিল হয়ে ওঠে। ১৯৮০ ‘র দশকের গোড়ার দিকে তিনি পার্কিন্সন্স রোগে আক্রান্ত হন।
আলী যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি ছিলেন বিতর্কিতও। তিনি বক্সিং পেশায় এতোটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে Sports Illustrated পত্রিকা তাঁকে বিশ শতকের স্পোর্টসম্যান বলে অভিহিত করে। নিজেকে গর্বের সঙ্গে প্রকাশ করা, আবেগ এবং শব্দের খেলার জন্য প্রখ্যাত মোহাম্মদ আলী বলতে পেরেছিলেন যে তিনি প্রজাপতির মতো ওড়েন আবার মৌমাছির মতো কামড় দেন।
মুহাম্মাদ আলী ও ইসলাম
১৯৬৪ সালে তদনীন্তন ক্যাসিয়াস ক্লে, জনপ্রিয় বক্সার সনি লিস্টনকে হারিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। সেই প্রতিযোগিতার পর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মোহাম্মদ আলী নামেই পরিচতি লাভ করেন।
মুসলমান ধর্মবিশ্বাসে প্রভাবিত হয়ে ১৯৬৪ সালে ক্যাসিয়াস মার্সলাস ক্লে জুনিয়র নাম পরিবর্তন করে হয়ে যান মুহাম্মাদ আলী। সেই সময়ে আলী ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী উচ্চ পদস্থ আমেরিকানদের একজন যিনি খ্রীষ্টান ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন; যা নিয়ে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সময়ের ব্যাবধানে তাঁর ধর্মবিশ্বাসের নাটকীয় পরিবর্তন হয়।
মুহাম্মাদ আলী বলেন তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন কারন এই ধর্ম তাঁকে মুক্ত স্বাধীন হবার সুযোগ করে দিয়েছে; দিয়েছে বর্ণ বিষয়ক গৌরব যা খ্রীষ্টান থাকা অবস্থায় তিনি অনুভব করতে পারেন নি।
একদা তিনি বলেছেন, “ক্যাসিয়াস ক্লে একটি দাসত্ব বোধক নাম. আমি তা ঠিক করি নি এবং রাখতে চাই না। আমি মুহাম্মাদ আলী; একটি স্বাধীন নাম- এর অর্থ সৃষ্টিকর্তার প্রিয়; এবং আমি চাই মানুষ যখন আমার সঙ্গে বা আমার সম্পর্কে কথা বলবেন, সবাই তা ব্যাবহার করুন।”
"আমি ইসলাম গ্রহন করেছি, কারন অন্য কোনো ধর্মে আমি দেখিনি মানুষের মধ্যে এ্যাতো প্রেম ভালবাসা। একে অন্যকে কোলাকুলি করা, সালাম বিনিময়, এক সঙ্গে প্রার্থনা করা। ভাই বোন বাবা মা, পারিবারিক শিক্ষা মূল্যবোধ ইসলামেই সবেচেয়ে শক্ত। তাই ইসলাম ধর্ম নিয়েছি।“
মুষ্টিযোদ্ধা হিসাবে আলী দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরতে ঘুরতে এক সময় পরিচয় হয় নেশন অব ইসলাম নামে ইসলাম ধর্মীয় ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের নের্তৃবৃন্দের সঙ্গে। তাঁর বন্ধুত্ব হয় ম্যালকম এক্স এর সঙ্গে যিনি ঐ সময়ে নেশন অব ইসলামের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সংগঠনটির আদর্শে উজ্জীবিত হন তিনি।
নেশন অব ইসলামে অন্তর্ভুক্তির কারনে তাঁর সঙ্গে তাঁর স্বেতাঙ্গ এবং প্রগতিশীল কৃষ্ণাঙ্গ শুভাকাংখীদের সম্পর্কে চিড় ধরে। তারা মনে করতেন নেশন অব ইসলাম একটি বিদ্বেষপূর্ন ধর্ম। বেশিরভাগ সাংবাদিকই তখন আলীর নতুন নামে ডাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং তাঁর সাবেক প্রতিপক্ষ ফ্লয়েড প্যাটারসন, আলী সম্পর্কে বলেছিলেন, “তিনি কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের প্রতিচ্ছবি যা ক্রীড়াঙ্গন এবং জাতির জন্যে অপমানকর”।
এ্যাতো সমালোচনা ও বিতর্কের পরও আলী তাঁর ধর্মবিশ্বাসে অটল ছিলেন।
ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন “শুধুমাত্র আলো দেখলেই মোরগ বাক দ্যায়। তাকে অন্ধকারে রাখলে কখনোই সে ডাকবে না। আমি আলো দেখেছি এবং এখন ডাকতে শুরু করেছি”।
এইসব বিতর্ক সমালোচনার তিন বছর পর ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধ করার নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি তাঁর নতুন ধর্মবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে। সেনাবাহিনীতে চাকরী নিতে অস্বীকৃতি জানানো এবং নৈতিক অবস্থান থেকে যুদ্ধে যেতে আপত্তি করায় টেক্সাসের হিউস্টনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
মুহাম্মাদ আলী বলেন, “যুদ্ধ হচ্ছে পবিত্র কোরানের শিক্ষার বিরোধী। আমি ছল চাতুরী করতে চাই না। আল্লাহ বা তাঁর বার্তাবাহকের আদেশ ছাড়া আমরা কোনো প্রকার যুদ্ধ করতে পারি না। আমরা খ্রীষ্টানদের বা কোনো অবিশ্বাসীদের যুদ্ধে অংশ নেবো না”।
তার মাস খানেক পর সেনাবাহিনীতে যোগদানে অস্বীকৃতি জানানোর কারনে আলীকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়, শাস্তি দেয়া হয়। সেই মামলা নিয়ে কয়েক বছর আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় তাঁকে। সবশেষে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটির নিষ্পত্তি হয়।
প্রায় এক দশক পর ১৯৭৫ সালে আলী নেশন অব ইসলাম ত্যাগ করেন এবং সেখান থেকে যে শিক্ষা পেয়েছিলেন তারও সমালোচনা করতে শুরু করেন। তিনি প্রভাবিত হন মূলধারার সুন্নী মুসলমান বিশ্বাসে।
২০০৪ সালে লেখা আম্মজীবনীতে আলী লিখেছেন, “দা নেশন অব ইসলাম শিক্ষা দেয় যে শ্বেতাঙ্গরা হচ্ছে শয়তান। আমি এখন তা বিশ্বাস করি না। আসলে কখনোই আমি তা বিশ্বাস করতাম না। তবে আমি যখন তরুণ ছিলাম আমি শ্বেতাঙ্গদের সম্পর্কে বাজে বাজে কথা শুনতাম আর সেই কারনেই ওদের কথা শুনতাম না”।
পরবর্তীতে হযরত ইনায়েত খানের বই পড়ে তিনি সুফি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তা গ্রহণ করেন। ২০০৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে আলীর কন্যা হানা ইয়াসমিন আলী বলেন তার বাবার জীবনের শেষদিকে ধর্মনিষ্ঠা কমিয়ে আধ্যাত্মিকতার চর্চা শুরু করেন।
হানা বলেন, “তাঁর শরীর ও আধ্যাত্মিকতা পরিবর্তিত হয় যা ধর্মকে ঘিরে নয়। তিনি বাইরে যেতেন, মানুষজনকে খুশী করার চেষ্টা করতেন, দাতব্য কাজকর্ম করতেন, মানবিক সাহায্য করতেন”।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডন্ট প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান অভিবাসি বন্ধ করার কথা বলার পর গত ডিসেম্বরে মুহাম্মাদ আলী বলেন ট্রাম্প সম্পর্কে বলেন, তিনি ইসলাম ধর্মের জন্যে হুমকী।
নাম উল্লেখ না করে “Presidential Candidates Proposing to Ban Muslim Immigration to the United States” শিরোনামে মুহাম্মাদ আলী এক বিবৃতিতে বলেন যারা নিজেদের ব্যাক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্যে ইসলামকে ব্যাবহার করে তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে প্রতিবাদী হওয়া দরকার।
মুহাম্মাদ আলী এক বার্তায় বলেন, “ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা নেয়ার পথ থেকে বহু মানুষকে সরিয়েছে তারা। সত্যিকারের মুসলমান জানেন অথবা জানা উচিৎ যে কাউকে জোর করে ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত করা ইসলাম ধর্মের আদর্শ বিরোধী”।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শোক
কিংবদন্তী মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মাদ আলী শুক্রবার আরিজোনার ফিনিক্স হাসপাতালে মৃত্যুবরণের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, বাংলাদেশের প্রধানমনস্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ বিভিন্ন পেশাজীবি ও সংগঠনসমূহ শোক প্রকাশ করছেন।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক শোক বার্তায় বলেছেন তাঁর মৃত্যুতে গোটা বিশ্ব শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, “সত্য ও ন্যায়ের পক্ষের লড়াইয়ে আলী ছিলেন মার্টিন লুথার কিং ও নেলসন ম্যান্ডেলার সহযোদ্ধা”। প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর টুইটার বার্তায় আলীর সঙ্গে তাঁর ছবি ছাপান এবং তাঁ আত্মার শান্তি কামনা করেন।
শোক জানান যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট মনোনয়োন প্রত্যাশী ডনাল্ড ট্রাম্পসহ অনেকেই।
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এর শোক
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এক শোক বার্তায় বলেন, “শান্তির জন্যে লড়ে যাওয়া এক মহান ব্যাক্তিত্ব মুহাম্মদ আলীর কর্ম ও জীবন থেকে জাতিসংঘ অনেক প্রেরণা পেয়েছে”।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোক
বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব পাওয়া ক্রীড়া কিংবদন্তী মুহাম্মাদ আলীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে প্রেরিত এক শোক বার্তায় বলেন, “ক্রীড়াঙ্গনের জন্যে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মুহাম্মদ আলীর নাম সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, ; সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তাঁর কর্মকান্ড ও তাঁর মানবিক গুনাবলীর জন্যে”।
ফুটবল কিংবদন্তী পেলের শোক
সর্বকালের সেরা ফুটবল কিংবদন্তী ব্রাজিলের পেলে টুইটার ও ইনষ্টাগ্রাম বার্তায় বলেন, “তাঁর মৃত্যুতে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন বিশাল ক্ষতির মধ্যে পড়ল”।
ফুটবল বিস্ময় ম্যারাদোনার শোক
আর্জেন্টিনার ফুটবল বিস্ময় ম্যারাদোনা তাঁর ফেসবুক ওয়ালে বলেন, “সর্বকালের সর্বসেরা, আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এই ক্ষতি সকলের মনকে নাড়া দিয়েছে। আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাই”।