বাংলাদেশে জঙ্গি হামলাগুলোর বেশিরভাগই এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে একের পর এক ব্লগার, প্রকাশক ও লেখক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। সে সময় রাজধানীতে আটটি জঙ্গি হামলায় আট জন খুন হন। আলোচিত এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে তিনটি মামলার রায় হয়েছে। বাকি পাঁচটি মামলার বিচারকাজ চলছে।
ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর হামলার বাইরে ২০১৬ সালে ঢাকার কূটনীতিকপাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনাটি ঘটে। সেদিন জঙ্গিরা কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে, যাদের মধ্যে নয় জন ইতালীয়, সাত জন জাপানি, এক জন ভারতীয় ও তিন জন বাংলাদেশি ছিলেন। সেই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। পরে সেনা অভিযানে পাঁচ জঙ্গি মারা যায়।
ঘটনার তিন বছর পর ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর আলোচিত এ হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত। রায়ে সাত জঙ্গিকে ফাঁসি ও এক জনকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়।
হলি আর্টিজানের হামলার পর জোরদার করা হয় জঙ্গি বিরোধী অভিযান। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন সম্প্রতি জানিয়েছেন, হলি আর্টিজানে হামলার পর বিভিন্ন অভিযানে দেড় হাজারের মতো জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সময়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিভিন্ন অভিযানও গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হয়। এসব অভিযানে বেশ কয়েকজন জঙ্গি সদস্য মারা যায়। কোনো কোনো অভিযানে সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের ব্যবহার করতে দেখা যায়।
২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও বেশ কিছু জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় জঙ্গিরা ধর্মযাজক, পুরোহিত ও বিদেশি নাগরিকদের টার্গেট করে। ওইসব ঘটনার অনেক মামলা এখন পর্যন্ত ঝুলে আছে।
ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্টদের হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বা টুইটারে হত্যাকারীরা হত্যার দায় স্বীকার করে স্ট্যাটাসও দিয়েছে। এসব স্ট্যাটাসে প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে ধর্মকে নিয়ে কটূক্তি অথবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ দেখানো হয়। ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত যে কয়জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বেশিরভাগের সঙ্গে কোনো না কোনো জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া গেছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের অনেককেই গ্রেপ্তার করেছে র্যাব ও পুলিশ। আবার অনেকেই পলাতক আছে।
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে নাগরিকদের শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ শুরু হলে বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার খুন হতে থাকেন। ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে ছয় জন ব্লগার নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ খুনের শিকার হন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার নিলয় নীল। মুক্তমনা ব্লগার হওয়ায় একাধিকবার তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী আহমেদ রাজীব হায়দায় শোভনকে পল্লবীতে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় নিহতের বাবা আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামি ফয়সল বিন নাঈম, মাকসুদুল হাসান অনিক, এহসান রেজা রহমান, নাঈম শিকদার ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজ আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালত হত্যাকাণ্ডের মামলায় দুইজনের মৃত্যুদণ্ড ও একজনের যাবজ্জীবন দিয়েছেন।
২০১৫ সালের ১২ মে সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার রাতে নিহতের বড়ভাই রত্নেশ্বর দাশ অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করে থানায় একটি মামলা করেন। সিআইডির পরিদর্শক আরমান আলী তদন্ত করে ২০১৭ সালের ৯ মে সম্পূরক অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেন। এতে সন্দেহভাজন আটক ১০ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে ছয় জনকে অভিযুক্ত করা হয়। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।
২০১৫ সালের ৩০ মার্চ সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বেগুনবাড়ি দিপীকার ঢাল এলাকার বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে যাওয়ার পথে ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তদন্তে হাতেনাতে ধরা পড়া দুই জনসহ মোট পাঁচজনের সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশ। এরা সবাই আনসার আল ইসলামের সদস্য। তারা হলো: জিকরুল্লাহ ওরফে হাসান, আরিফুল ইসলাম ওরফে মুশফিক ওরফে এরফান, সাইফুল ইসলাম ওরফে মানসুর, মাওলানা জুনায়েদ আহম্মেদ ওরফে তাহের ও সাইফুল ইসলাম ওরফে আকরা। মামলাটি এখন ঢাকা মহানগর আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ব্লগার অভিজিৎ রায়কে টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ঢাকা মহানগর আদালত। তারা হলো: সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও আনসার আল ইসলাম জঙ্গি সংগঠনের সদস্য আকরাম হোসেন, আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হোসেন ও আরাফাত রহমান। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন আছে। আসামিদের দুই জন জিয়া ও আকরাম শুরু থেকে পলাতক। তাদের বিষয়ে তথ্য পেতে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ৫০ লাখ ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করেছে। জিয়া এবং আকরাম কোথায় আছে এটি স্পষ্ট নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, তারা পালিয়ে অন্য দেশে চলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বলছে, এই দুই আসামি বাংলাদেশেই আছে।
২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কবি নজরুল ইসলাম হলে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ব্লগার আরিফ রায়হান দ্বীপকে। এ ঘটনার মামলাটি আদালতে বিচারাধীন আছে।
২০১৫ সালের ৯ আগস্ট খিলগাঁওয়ের গোড়ানে বাসার মধ্যে ঢুকে ব্লগার নিলয় চ্যাটার্জিকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনার মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।
জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আটজন আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়া হয়েছে। এরা সবাই জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য বলে জানানো হয়। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর বরখাস্তকৃত মেজর জিয়াউল হক জিয়াও ছিলেন।
২০১৫ সালে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ফয়সাল আরেফিন দীপন খুন হওয়ার পর হত্যার দায় শিকার করে বিবৃতি দিয়েছিল আনসার আল ইসলাম নামের এই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গত ফেব্রুয়ারিতে এ রায় দেয়।
২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল রাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষে পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় মেসে ফেরার পথে লক্ষ্মীবাজারের একরামপুর মোড়ে জঙ্গিরা কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে ব্লগার নাজিম উদ্দিনকে। এ ঘটনায় পরদিন সূত্রাপুর থানার এসআই মো. নুরুল ইসলাম মামলা দায়ের করেন। গত বছরের ২০শে আগস্ট বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক জিয়াসহ ৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট।
চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলো—রশিদুন নবী ভূইয়া ওরফে টিপু ওরফে রাসেল ওরফে রফিক ওরফে রায়হান, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, মো, আরাফাত রহমান, মো. শেখ আব্দুল্লাহ, মো. ওয়ালিউল্লাহ ওরফে ওলি ওরফে তাহেব ওরফে তাহসিন, সাব্বিরুল হক চৌধুরী ওরফে আকাশ ওরফে কনিক, মাওলানা জুনেদ আহাম্মেদ ওরফে সাব্বির ওরফে জুনায়েদ ওরফে তাহের ও আকরাম হোসেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশন্যাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান জানান, জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে সিটিটিসি কাজ করছে। মামলার বিষয়টি আদালতের ওপর নির্ভর করে।