সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জিং পেশা। নারীদের এই পেশায় কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। সাংবাদিকতায় নারীরা এই সমাজে পদে পদে অবহেলিত। তবে বর্তমানে অনেক নারী এই পেশা বেছে নিয়েছেন। এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের কাতারে।
পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাজ করছে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষতার সাথে কাজ করছে, এরপরও আছে প্রতিবন্ধকতা। নারী সাংবাদিক বাইরে যেমন দক্ষতার পরিচয় দেয় তেমনি ঘরের কাজকর্ম সামলাতে হয়।
পুরুষ আধিপত্যের পেশা হচ্ছে সাংবাদিকতা। এই পেশায় ছেলেরা বেশি ভালো করে থাকেন কারণ কাজ শেষে ছেলেরা আড্ডা বা কানেক্টিভিটি গড়ে তোলে। যা মেয়েদের পক্ষে অনেক সময় সম্ভব হয়না। কারণ কাজের পর তাদের বাড়ি গিয়ে পরিবারের দেখাশোনা করতে হয়।
নারী পেশায় সাংবাদিকতা করতে গিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা কয়েকজন নারী সাংবাদিক ভয়েস অব আমেরিকার কাছে তুলে ধরেন।
"অনেক সময় বস বা সিনিয়র কারো দ্বারা হেরেজমেন্টের শিকার হতে হয়।"
সাফিয়াজ রাসনা
ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে চাকরি করে এমন একজন সাংবাদিক সাফিয়াজ রাসনা। রিপোর্টিং করার জন্য অনেক সময় অনেক ছেলে সাংবাদিকের মত সমানভাবে সুযোগ পাননা। বেশীরভাগ সময়ই দেখা যায় কোন অ্যাসাইনমেন্টে ২/১ জন নারী সাংবাদিক থাকে তখন পুরুষরাই বেশি সুযোগ নিয়ে থাকে। এছাড়া নিউজরুমেও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অনেক সময় বস বা সিনিয়র কারো দ্বারা হেরেজমেন্টের শিকার হতে হয়। এরপরও চাকরি ছাড়তে পারে না কারণ চাকরির টাকার উপরই নির্ভরশীল থাকতে হয় তাকে। এছাড়া ভালো নিউজ করলেও নারী সাংবাদিকদের তেমন মূল্যায়ন করা হয়না। এ ধরনের নানা প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে নারীদের সাংবাদিকতা করতে হয়।
"মনে করে নারী সাংবাদিক সে কি ঠিক মত নিউজ করতে পারবে।"
সুমাইয়া জিসান
বরিশালে প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ করে সুমাইয়া জিসান। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, বরিশালে নারী সাংবাদিক ২/৩ জন আছে। নারীদের সাংবাদিকতায় অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে না বললেই চলে। যদিও রিপোর্টিংএ অফিস থেকে পাঠানো হয়। বিশেষ বিশেষ ইভেন্টগুলোতে পুরুষ সাংবাদিকরা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। অনেক সময় রিপোর্টিংএ গেলে ইন্টারভিউ দিতে ইতস্ততাবোধ করে। মনে করে নারী সাংবাদিক সে কি ঠিক মত নিউজ করতে পারবে। অনেক সময় কাজ করতে করতে রাত হয়ে গেলে তখন আশেপাশের মানুষ তাকে নেতিবাচক চোখে দেখে। বিয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় জটিলতারও সৃষ্টি হয়।
"টপ লেভেলে এ পেশায় কোন নারী সাংবাদিক নেই।"
সানজিদা ইসলাম পারুল
ঢাকার প্রথম সারির পত্রিকায় কাজ করেন সানজিদা ইসলাম পারুল। তার প্রতিষ্ঠানে একমাত্র নারী সাংবাদিক তিনি । সাধারণত স্বাস্থ্যের ওপর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে যাদের উপর রিপোর্ট করা হয় সেই রিপোর্টটি প্রকাশ না করার জন্য চাপ আসে। তিনি বলছেন বর্তমানে হলুদ সাংবাদিকতা বেশি দেখা দিয়েছে তাই সমস্যা হচ্ছে।
অফিস যাতায়াতের জন্য গণপরিবহনে চলাচলের সময় সমস্যা হয়। তিনি বলেন, আমাদের অফিসের পরিবেশটা নারীবান্ধব। একটা পজেটিভ দিক হলো আগের চেয়ে অনেক বেশী নারীরা এ পেশায় এগিয়ে আসছে। তারপরও যে সম্মানী দেয়া হয় তা সন্তোষজনক নয়। ১১ জনের পরিবারে নিজের জন্য কিছু রেখে পুরো টাকাটাই পরিবারকে দিয়ে দেন। নারীরা এ পেশায় এগিয়ে আসলেও যুদ্ধ করে কাজ করতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, টপ লেভেলে এ পেশায় কোন নারী সাংবাদিক নেই। এটা একটা নেতিবাচক দিক।
"এমনিতে তো আর বেতন বাড়িয়ে দেয় নাই নিশ্চয়ই কোন কিন্তু আছে।"
অন্তরা বিশ্বাস
অন্তরা বিশ্বাসের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাংবাদিকতায় প্রায় ১১ বছরের পথচলা। তিনি বলেন, ঝামেলাপূর্ণ জায়গায় রিপোর্ট করতে গেলে অফিস মেয়েদের না পাঠিয়ে ছেলেদের পাঠায়। আবার বিভিন্ন উৎসবে নিউজ করতে গেলে মেয়েদের দিয়ে করায়। যেমন পহেলা বৈশাখ, পূজা পার্বণের অনুষ্ঠান। 'মেয়ে' বলেই সফট নিউজ করতে হবে এটা অন্তরা বিশ্বাসের পছন্দ না। চ্যালেঞ্জিং নিউজ করার মধ্যে একটা প্রফেশনালিজম আছে। তাই তিনি চ্যালেঞ্জিং নিউজ করতে বেশি পছন্দ করেন। তিনি বলেন, সেজন্য আমাকে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়েছে। যেটা পুরুষদের ক্ষেত্রে হয় না।
অফিসের বাইরের অভিজ্ঞতা অনেক অনুকূল। যেখানে রিপোর্ট করতে গেছি সেখানে বাইরের লোকজন অনেক সহযোগিতা করেছে। নারী সাংবাদিকদের বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অনেক নেতিবাচক কথা শুনতে হয়। অফিসে অনেক সময় বলাবলি শোনা যায়, "এমনিতে তো আর বেতন বাড়িয়ে দেয় নাই নিশ্চয়ই কোন কিন্তু আছে।" আর সেক্ষেত্রে সুন্দরী নারী সাংবাদিক হলে তো কথাই নেই। নারী সাংবাদিকরা যে তাদের দক্ষতা দিয়ে কাজ ভাল করতে পারে সেটা অনেক সময় পুরুষ সহকর্মীরা মানতে চায় না। "শুধুমাত্র যোগ্যতা দিয়ে এতদূর আসেনি," সে কথা শুনতে হয়।
"নারী সাংবাদিকরা সামান্য ভুল করলে মনে করেন অযোগ্য যেটা পুরুষের সাথে হয়না।"
রাবেয়া বেবী
প্রিন্ট মিডিয়ার সিনিয়র রিপোর্টার রাবেয়া বেবী। সাংবাদিকতায় আছেন ১৬ বছর ধরে। কখনও কোন কাজকে তিনি 'না' বলেননি। সব কাজ তিনি উৎসাহের সাথে করেছেন।
ভালো কাজের জন্য তিনি যে পত্রিকায় কাজ করেন সেখানে মহিলা পাতার সম্পাদনার কাজ পান।
তিনি বলেন কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও সততার জন্য তিনি নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে নানা হুমকির সম্মুখীনও হতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন নারী সাংবাদিকরা সামান্য ভুল করলে মনে করেন অযোগ্য যেটা পুরুষের সাথে হয়না।
"সাংবাদিক হিসেবে না দেখে নারী হিসেবে দেখছে।"
সুলতানা জাহান মিতু
সুলতানা জাহান মিতুর কাজের অভিজ্ঞতা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখনও নারী সাংবাদিকতা-বান্ধব হয়নি। নারী-পুরুষ সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে ভিন্নতা লক্ষ্য করা হয়। আমাকে অনেক সময় মসজিদ বা ধর্মীয় রিপোর্টিংএর ক্ষেত্রে অনেক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে না দেখে নারী হিসেবে দেখছে। যেখানে একজন পুরুষ সহকর্মী ভিড়ের মধ্যে চলে গেছে কিন্তু একজন নারী হওয়াতে আমার শরীর আমাকে বাধা দিচ্ছে। উন্নত দেশে হলে কি এরকম বাঁধার মধ্যে পড়তে হতো? নারীদের কিছু প্রাকৃতিক ব্যাপার থাকে তখন পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে তাল মেলানো যায়না। সেক্ষেত্রে পুরুষ সাংবাদিকরা বাঁকা চোখে দেখে। শক্তির দিক থেকে পুরুষ সহকর্মীরা নারীদের চেয়ে অনেক আগানো। গণমাধ্যমে খুব কম নারীরাই উচ্চ পদে আছে। এই পেশাটা নারীদের জন্য খুব একটা ইতিবাচক না।
নারী সাংবাদিকদের পুরুষ সহকর্মীদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। যোগ্যতার প্রমাণ দেখাতে হয়। সাধারণত কাজের ক্ষেত্রে নারীরা নিষ্ঠা ও সততার পরিচয় দিয়ে থাকে। সেই সাথে নিজের নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয় তাদের। নারীদের এ পেশায় টিকে থাকতে হলে সবার আগে যেমন পরিবারের সহযোগিতা প্রয়োজন তেমনি পারিপার্শিক পরিবেশ হতে হবে ইতিবাচক। তাহলেই একজন নারী সাংবাদিক সমাজে সম্মানের সাথে টিকে থাকতে পারবে বলছেন নারী সাংবাদিকরা।