অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ঢাকার আর্মেনীয়রা, একটি হারিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠী


ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চ। (ছবি- মাহতাব হোসেন)
ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চ। (ছবি- মাহতাব হোসেন)

২০১৮ সালের মার্চে “দিস ইজ ক্রিশ্চিয়ান আর্মেনিয়া” নামের ফেসবুক পেজে একটি ছবি পোস্ট করা হয়েছিল। ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছিল ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চের প্রধান ফটক। ছবির নিচে ক্যাপশন দেওয়া-“আর্মেনিয়ান চার্চ ইন ঢাকা”। ক্রিস গারবিজ কিলিয়ান নামের ইওরোপে বসবাসকারী একজন আর্মেনীয় বিস্ময় প্রকাশ করে ইংরেজিতে মন্তব্য করেছেন, “বাংলাদেশ? আশ্চর্জনক, এটা অপ্রত্যাশিত!”

ঢাকায় আর্মেনীয়দের চার্চ দেখে শুধু আর্মেনিয়ায় বসবাসকারীই নন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী আর্মেনীয়রা বিস্মিত হন।

তাদের বিস্মিত হওয়ার হয়তো কারণ রয়েছে। কিন্তু তারা যদি আরেকটু বিষদভাবে জানতেন যে, শুধু একটি চার্চই নয়, একটি এলাকার নাম আরমানিটোলা, আর ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলে আর্মেনীয়রা বসবাস করে গেছে-তাহলে হয়তো তাদের বিস্ময়ের মাত্রাটা আরও প্রসারিত হতো নিশ্চই। সর্বশেষ আর্মেনীয় বংশধর ঢাকা ত্যাগ করেছেন ২০১৪ সালে।

ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চের ভেতরের একটি ভাস্কর্য। (ছবি- মাহতাব হোসেন)
ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চের ভেতরের একটি ভাস্কর্য। (ছবি- মাহতাব হোসেন)

বাংলাপিডিয়ায় আর্মেনীয়দের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “…ষোলো শতকে পারস্যের সাফাভি শাসকগণ মধ্য এশিয়ায় তাদের আবাসভূমি আর্মেনিয়া জয় করে নিলে আর্মেনীয়রা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে শাহ আববাস ইস্পাহান ও নিউজালফায় আন্তএশীয় বাণিজ্যে দক্ষ প্রায় চল্লিশ হাজার বণিককে পুনর্বাসিত করেন। এ দুটি বাণিজ্য-নগরী থেকেই আর্মেনীয়রা পারস্যদেশীয় ভাগ্যান্বেষীদের অনুসরণ করে প্রথম বাংলায় আসেন। প্রথমদিকে তারা তাদের পারস্যদেশীয় মনিবদের পক্ষে বাংলায় ব্যবসা করতেন এবং কালক্রমে তারা বাংলায় তাদের নিজস্ব সম্প্রদায় গড়ে তোলেন।…

আর্মেনীয়গণ হুগলি, চুঁচুড়া, সায়দাবাদ [মুর্শিদাবাদের উপকণ্ঠে একটি শহরতলি], মুর্শিদাবাদ ও কাসিমবাজার এবং বাংলার আরও কিছু বাণিজ্যকেন্দ্রে তাদের বসতি প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু তাদের মূল বসতি ছিল ঢাকায়। তারা তাদের ঢাকার বসতির নামকরণ করেছিল আর্মানিটোলা। এ স্থান তাদের ঘটনাবহুল উপস্থিতির স্মারক হিসেবে এখনও ওই নামে বর্তমান রয়েছে। তারা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নিকোলাস পোগোজ ঢাকায় পোগোজ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।”

ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে ঠিক সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের পেছনে আর্মেনিয়ান চার্চের অবস্থান। এটি নির্মাণ করা হয়েছে ১৭৮১ সালে। তবে ঢাকায় আর্মেনিয়ানীয়দের বসবাস আরও আগে থেকে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আর্মেনীয়রা ঢাকায় আসেন ষোড়শ শতকে। আর্মেনিয়ান চার্চ চত্ত্বরে গেলে দেখা মেলে পরতে পরতে ইতিহাসের ছোঁয়া। পুরো চার্চকে ঘিরে রয়েছে সিমেট্রি (গোরস্থান)। ভেতরে পার্থনার ঘরটি এখনও তেমনই রয়েছে। সিমেট্রির সবচেয়ে পুরনো যে কবরটি সেটি ১৭১৪ সালের।

ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চের ভেতরের অংশ। (ছবি- মাহতাব হোসেন)
ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চের ভেতরের অংশ। (ছবি- মাহতাব হোসেন)

আরমানিটোলার এই চার্চে সংরক্ষিত একটি লিফলেটে বলা হয়েছে, আর্মেনীয়দের নিজস্ব চার্চ ও সিমেট্রি তৈরি হওয়ার আগে তারা ঢাকার তেজগাঁওয়ে ১৬৭৭ সালে নির্মিত চার্চ অফ দ্য হোলি রোজারিওতে প্রার্থনা করতেন এবং সেখানে তাদের সমাধিস্থ করা হতো। এখানেই একজন আর্মেনীয়র সবচেয়ে পুরনো সমাধি খুঁজে পাওয়া গেছে। ১৭১৪ সালে লেজার অফ এরিভানের পুত্র খোজাহ এভিয়েটেস লেজার মারা গেলে তেজগাঁওয়ের এই সিমেট্রিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। যার এপিটাফে আর্মেনীয় ভাষায় লেখা রয়েছে বিস্তারিত। এই সমাধি থেকে স্পষ্ট হয়, ঢাকায় আর্মেনীয়দের বসবাস ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে।

১৭৮১ সালে আরমানিটোলায় আর্মেনিয়ান চার্চ বা আর্মেনিয়ান চার্চ অফ হোলি রিসারেকশন নির্মিত হলেও সেখানে গিয়ে খোঁজ মেলে আরও পুরনো সমাধির। যেটার এপিটাফে মৃত্যুর তারিখ লেখা রয়েছে ১৭৬২ সাল। ইংরেজিতে এই সাল ছাড়া বাকিটুকু লেখা রয়েছে আর্মেনীয় ভাষায়। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ করতেই জানা গেল চার্চ নির্মাণের বহু আগে থেকেই এখানে একটি চ্যাপেল ছিল। আর্মানিটোলা ছিল আর্মেনীয়দের কলোনি। চার্চের স্থানে প্রথমে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি চ্যাপেল। সেখানেই প্রার্থনা ও সমাধিস্থ করার কাজ শুরু হয়। পরে ১৭৮১ সালে বর্তমান চার্চটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। ১৩ বছর লেগে যায় এই চার্চ নির্মাণে। এই ১৩ বছর আর্মেনীয়রা প্রার্থনার জন্য যেত তেজগাঁওয়ের চার্চে। ১৭৯৪ সাল থেকে আর্মেনীয়দের নিজস্ব প্রার্থনা শুরু হয় আরমানিটোলার এই চার্চে।

আর্মেনিয়ান চার্চের ভেতরের অংশ। (ছবি- মাহতাব হোসেন)
আর্মেনিয়ান চার্চের ভেতরের অংশ। (ছবি- মাহতাব হোসেন)

বাংলাপিডিয়ায় আরমানিটোলার আর্মেনীয় চার্চের ব্যাপারে বলা হয়েছে, “১৭৮১ সালে তারা [আর্মেনীয়রা] আর্মানিটোলায় “চার্চ অব হলি রিজারেকশন” (Church of Holy Resurection) নির্মাণ করে। এ গির্জা নির্মাণের পূর্বে তারা আর্মানিটোলার এক ক্ষুদ্র খ্রিস্টীয় গির্জায় (চ্যাপেল) উপাসনা করত। ১৮৩৭ সালে তারা গির্জার পশ্চিম পার্শ্বে একটি ক্লক টাওয়ার নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে টাওয়ারটি ভেঙে পড়ে। চার্চের ভেতরে ও বাইরে বেশ কিছু আর্মেনীয়দের সমাধি রয়েছে। এ গির্জা নির্মাণের পূর্বে তেজগাঁয়ে অবস্থিত রোমান ক্যাথলিক চার্চের পার্শ্বে আর্মেনীয়দের সমাধিস্থ করা হতো। এসব সমাধির কিছু কিছু শিলালিপি ঢাকায় আর্মেনীয়দের উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করছে। পগোজ, আগাসি, মাইকেল, স্টিফেনস, জোয়াকিমস, সারকিয়েস মানুকস প্রভৃতি ছিল কয়েকটি নেতৃস্থানীয় আর্মেনীয় পরিবার। পি আরাথন, মার্গার ডেভিড, ম্যাকার্টিচ আব্রাহাম জর্জ, মাইকেল সারকিয়েস, আব্রাহাম লুকাস, এম হাইকাজোনি, এ এস ম্যাকার্টিচ, টিগ্রন নাহাপিত, ছাদিউস নাহাপিত, এম জে কাছাতুর, যোসেফ ল্যাজারাস প্রমুখ ছিলেন সুপরিচিত আর্মেনীয় ব্যক্তিত্ব।

ধর্মবিশ্বাসে আর্মেনীয়রা ছিলেন গ্রিক বা অর্থডক্স চার্চের অনুসারী খ্রিস্টান। যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আর্মেনীয় বসতি স্থাপন করেছেন, সেখানেই তারা গির্জা নির্মাণ করেছেন।”

ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন শেষ হয়ে গেলে আর্মেনীয়রা ব্রিটিশদের পথ ধরে ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চে প্রার্থনা সভা হতো। এরপরে আর কোনো আর্মেনীয় ফাদার বা যাজক ঢাকায় না থাকার কারণে পুরোপুরি নিয়মিত প্রার্থনা বন্ধ হয়ে যায়।

চার্চটির বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক আরমেন আর্সালিয়ান। তিনি দেশের বাইরে থেকে ঢাকার এই আর্মেনিয়ান চার্চের ওয়ার্ডেন বা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। চার্চের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন আল মামুন এম রাসেল। এ ছাড়াও ব্যবস্থাপক হাসনাত ও একজন স্থানীয় তদারককারী কর্মী রয়েছেন।

আর্মেনিয়ান চার্চের একাংশ। (ছবি- মাহতাব হোসেন)
আর্মেনিয়ান চার্চের একাংশ। (ছবি- মাহতাব হোসেন)

আল মামুন এম রাসেল বলেন, “ঢাকায় বসবাসরত কোনো ফাদার না থাকায় ১৯৮৬ সালে আর্মেনিয়ান চার্চের প্রার্থনা সভা থেমে যায়। তবে সে সময় একটি আর্মেনিয়ান পরিবার এটির দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। মাইকেল জোসেফ মার্টিন, তার স্ত্রী ভেরোনিকা মার্টিন। তাদের দুই মেয়ে শেরিল ও ক্রিস্টিন। তারা বাংলাদেশ থেকে স্থায়ীভাবে চলে যান। স্বামী–স্ত্রী মিলেই চার্চের দেখাশোনা করতেন। ২০০৫ সালে ভেরোনিকা মার্টিন মারা গেলে তাকে চার্চের সমানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। এটিই ঢাকায় শেষ আর্মেনীয়র কবর।

আল মামুন জানান, স্ত্রীর মৃত্যুর পর মাইকেল মার্টিন একা হয়ে যান। নয় বছর একাকী এই চার্চ দেখাশোনা করার পর তিনিও ২০১৪ সালে কানাডায় মেয়েদের কাছে চলে যান। আর এর মধ্য দিয়ে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ৩০০ বছরের বেশি সময়ের বসবাসের ইতি ঘটে।

আল মামুন রাসেলের তথ্য অনুযায়ী, এ চার্চের জন্য একটি ট্রাস্টি গঠন হয়। বহির্বিশ্ব থেকে চার্চের ওয়ার্ডেন বা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করছেন আরমেন আর্সালিয়ান। ২০১৪ সাল থেকে আল মামুন এম রাসেল নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

২০২০ সালের ১১ এপ্রিল সর্বশেষ বাংলাদেশি আর্মেনীয় মাইকেল জোসেফ মার্টিন বার্ধক্যজনিত কারণে ৮৯ বছর বয়সে মারা যান। আর মার্টিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আর্মেনীয়দের যবনিকা ঘটে।

আর্মেনীয়রা বুড়িগঙ্গার তীর ধরে তাদের কলোনি গড়ে তুলেছিল। যা পৌঁছেছিল নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া মোড়ের প্রাতিষ্ঠানিক নাম এ সার্কিস মোড়।

আল মামুন এম রাসেল বলেন, “আর্মেনীয়রা এ দেশে সিল্ক রুট দিয়ে এসেছিল ব্যবসা করতে। [ঢাকায়] তারা মূলত বুড়িগঙ্গার ধার দিয়ে কলোনি গড়ে তোলে। পুরাতন ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত তাদের নানারকম ব্যবসা বাণিজ্য ছিল। লবণ থেকে চামড়া সব ব্যবসার সঙ্গেই যুক্ত ছিল তারা। পাটের ব্যবসায় বেশ ভালো করেছিল আর্মেনীয়রা। মেসার্স সার্কিস অ্যান্ড সন্স, মেসার্স ডেভিড অ্যান্ড কোম্পানি, থ্যাডিয়াস অ্যান্ড নাহাপিয়েট, লেজারাস অ্যান্ড কোম্পানি—এসব ছিল তাদের প্রতিষ্ঠান। চাষাড়া মোড়ের নামকরণ করা হয় পাট ব্যবসায়ী সার্কিস সাহেবের নামানুসারে।”

আরমানিটোলায় বসবাসকারী ৭১ বছর বয়সী জুম্মনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানালেন, তার জন্ম পাশের কসাইটুলিতে। বললেন, “এক সময় দেখতাম এখানে আর্মেনীয়রা আসত প্রার্থনা করতে। আশেপাশেও অনেকে বসবাস করত। এখন আর তেমন কাউকে চোখে পড়ে না।”

বর্তমানে এই আর্মেনিয়ান চার্চে মাঝেমধ্যে প্রার্থনা হয়। ঢাকায় বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত আর্মেনীয়রা বিশেষ দিনগুলোতে এসে নিজেদের মতো প্রার্থনা করেন বলে জানালেন আল মামুন। এ ছাড়াও চার্চের একটি ফান্ড রয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে মাইকেল মার্টিন ফুড অ্যাসিসট্যান্ট প্রোগ্রাম। যেখান থেকে প্রতি সপ্তাহে দুঃস্থ শিশু ও নারীদের খাবার বিতরণ করা হয়।

XS
SM
MD
LG