অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনের মান নিয়ে প্রশ্ন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের


বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন

"ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মিডিয়া রিপোর্ট এবং কিছু এনজিও থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, বাংলাদেশের মানবাধিকারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করা হয়েছে," এ কথা উল্লেখ করে, প্রতিবেদনের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, "এনজিওগুলো সব সময়ই সব জায়গায় নেতিবাচক জিনিস দেখে এবং অন্য একটি দল আছে যারা শুধু বিদেশে আশ্রয় চায় এবং সুবিধা পাওয়ার জন্য দেশের নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরে।"

বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন “ বাংলাদেশ সরকার মনে করে যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের নামে অন্যান্য দেশের মূল্যবোধ যেমন- এলজিবিটি অধিকার, সমকামী বিবাহ ইত্যাদি চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা ‘দুঃখজনক এবং অযাচিত।" বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাম্প্রতিক ‘২০২১ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস’-এর কথা উল্লেখ করে বলেন, “কিছু মতামত এসেছে... তারা মানবাধিকারের নামে আমাদের ধর্মকে আঘাত করতে চায় এবং আমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছি”।

তিনি বলেন, “মতামত মানবাধিকার নয়; বাংলাদেশের মানবাধিকারের অগ্রাধিকার হচ্ছে খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, আশ্রয়ের অধিকার, সঠিক বাসস্থান এবং স্বাস্থ্যসেবা। ‘এগুলো মানবাধিকার’।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ওয়াশিংটনে খুব ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে এবং দুই পক্ষই আগামী বছরগুলোতে সম্পর্ক উন্নত করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেছে বলেও জানান তিনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "বাংলাদেশের একটি ‘খুব শক্ত ও স্বাধীন’ নির্বাচন কমিশন রয়েছে এবং এর গণতন্ত্র অত্যন্ত স্বচ্ছ।"

“বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। এটি (নির্বাচন) বাংলাদেশে একটি উৎসব। আমরা নির্বাচনে সব দল চাই,” বলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে তার বৈঠকের কথা উল্লেখ করে মোমেন বলেন, “তারা আমার পুরো প্রতিনিধিদলকে অনেক সম্মান দিয়েছে।”

যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাপান, পালাউ ও সিঙ্গাপুর সফর করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, "আমার পুরো ট্রিপটি খুব ইতিবাচক ছিল।"

কী আছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে

১২ এপ্রিল প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধান দেশটিতে একটি সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে, যাতে অধিকাংশ ক্ষমতাই প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কুক্ষিগত। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে, শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ দলটি পরপর তৃতীয় বারের মত পাঁচ বছর মেয়াদে জয়লাভ করে, যার ফলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে বহাল থাকেন। অনিয়মের অভিযোগে পর্যবেক্ষরা নির্বাচনটিকে স্বাধীন ও সুষ্ঠু হিসেবে বিবেচনা করেননি। এসব অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়া ‍এবং বিরোধীদলীয় পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের হয়রানি।

প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে পুলিশ, বর্ডার গার্ডস অফ বাংলাদেশ, এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মত সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমতার অপব্যবহারের ব্যাপারে এই প্রতিবেদনে বিভিন্ন অভিযোগের কথা বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমস্যাগুলোর মধ্যে নিচের বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে:

বেআইনী বা বিধিবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, যার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অন্তর্ভূক্ত; জোরপূর্বক গুম; সরকার বা তার নিযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা সরকারের তরফে নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক, বা অপমানজনক আচরণ বা শাস্তির ঘটনা; কারাগারের কঠোর বা জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ পরিবেশ; বিধিবহির্ভূত গ্রেফতার বা আটক; রাজনৈতিক বন্দী; বিদেশে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিশোধ গ্রহণ; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ে গুরুতর সমস্যা; গোপণীয়তায় বিধিবহির্ভূত বা বেআইনী হস্তক্ষেপ; কোন অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের শাস্তিপ্রদান; মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে গুরুতর বিধিনিষেধ, যার মধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি, সাংবাদিকদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার বা বিচার করা, এবং সেন্সর এবং মানহানি ও অপবাদ বিষয়ক ফৌজদারি আইনের অস্তিত্ব; ইন্টারনেটে স্বাধীনতা বিষয়ে গুরুতর বিধিনিষেধ আরোপ; শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা ও জোটের স্বাধীনতা বিষয়ে উল্লেখযোগ্য হস্তক্ষেপ, যার মধ্যে রয়েছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠানের সংগঠন, অর্থায়ন, বা পরিচালনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক আইন; শরণার্থীদের চলাচলের স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ আরোপ; শরণার্থীদের প্রতি দুর্ব্যবহার; রাজনৈতিক অংশগ্রহণে গুরুতর ও অযৌক্তিক বাধাপ্রদান; সরকারী পর্যায়ে গুরুতর দূর্নীতি; পারিবারিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে সরকারী বিধিনিষেধ বা হয়রানি; লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রে তদন্ত ও জবাবদিহিতার অভাব, এগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে যার মধ্যে রয়েছে, পারিবারিক ও অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতা, যৌন সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, বাল্য ও জোরপূর্বক বিয়ে, এবং অন্যান্য ক্ষতিকর চর্চা; জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা আদিবাসী মানুষজনকে লক্ষ্য করে সহিংস অপরাধ বা সহিংসতার হুমকি; সমকামী, উভকামী, লিঙ্গ পরিবর্তনকারী, কুয়্যার, বা উভলিঙ্গ ব্যক্তির বিরুদ্ধে সহিংস অপরাধ বা সহিংসতার হুমকি; সমলিঙ্গের পূর্ণবয়স্ক মানুষের মধ্যে সম্মতিক্রমে যৌনমিলনকে ফৌজদারি অপরাধ সাব্যস্তকারী আইনের অস্তিত্ব বা ব্যবহার; স্বাধীন শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমিকদের জোট গঠনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিধিনিষেধ; এবং জঘন্যতম রূপে শিশুশ্রমের অস্তিত্ব।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর অন্যায় ও দূর্নীতির বিষয়ে ব্যাপকভাবে দায়মুক্তির চর্চার অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ করা হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর দূর্নীতি ও অন্যায় এবং হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচারের বিষয়ে সরকার সামান্যই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও র‍্যাব

উল্লেখ্য, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজিপি বেনজীর আহমেদও রয়েছেন। এ ছাড়া র‍্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র‍্যাব ৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত। এতে বলা হয়েছে যে, তারা আইনের শাসন, মানবাধিকারের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ক্ষুণ্ন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‍্যাব হচ্ছে ২০০৪ সালে গঠিত একটি সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের নির্দেশে তদন্ত পরিচালনা করা।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওদের অভিযোগ হচ্ছে যে, র‍্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং ২০১৮ সাল থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই সব ঘটনার শিকার হচ্ছে বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।

XS
SM
MD
LG