অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা : যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া


চলতি বছরের ১২ এপ্রিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত তথ্যে বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষকরে, সরকারদলীয় আওয়ামী লীগ বলছে এই প্রতিবেদন ‘ভিত্তিহীন’। আবার বিএনপি বা অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ বলছে এই প্রতিবেদন বর্তমান সরকারের ‘অপকর্মের দলিল’। এর বাইরে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবীরা ভিন্নভিন্ন ভাবে এই প্রতিবেদনের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করেছেন।


যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্ট কী

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২০২১ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস প্রকাশ করেছে। ২০২১ সালের বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়নে তৈরি হয়েছে ‘২০২১: কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’। বিশ্বের ১৯০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টে এ রিপোর্ট প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এই বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে মানবাধিকারকে রেখেছেন বলে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি বিশ্বের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যেখানে মানবাধিকার সুরক্ষিত হয়।


আমেরিকার প্রতিবেদনে বিচারবহির্ভূত হত্যা

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। বেশকিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরে তাতে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী এসব বিচারবহির্ভূত হত্যার সাথে জড়িত। প্রাথমিকভাবে বলা হতো- সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, মাদক, এবং অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য অভিযান পরিচালনা করা হতো। এইসব অভিযানের সময় সন্দেহজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। নিরাপত্তা বাহিনী প্রায়ই এই ধরনের মৃত্যুতে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করেছে: তারা দাবি করেছে যে যখন তারা অস্ত্র উদ্ধার বা সহ-ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একজন সন্দেহভাজনকে হেফাজতে নিয়ে যায়, তখন সহযোগীরা পুলিশের উপর গুলি চালায়; পুলিশ পাল্টা গুলি চালায় এবং পরবর্তী বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজন নিহত হয়। এইসব মৃত্যুকে ‘ক্রসফায়ার হত্যা’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার হত্যা’ হিসাবে বর্ণনা করা হতো। বাংলাদেশের গণমাধ্যম বাহিনীগুলোর এইসব শব্দ ব্যবহার করে বর্ণনা করত। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো দাবি করেছে যে, এই ক্রসফায়ারের অনেক ঘটনাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) রিপোর্ট করেছে যে, বছরে অন্তত ৮০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে মারা গেছে। যার মধ্যে ৫১ জন তথাকথিত গুলি বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে ক্রসফায়ারে মারা গেছে। মে ২০১৮ থেকে জুনের মধ্যে, কথিত বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ডের মোট ৬০৬টি ঘটনা রিপোর্ট করেছে। অন্য একটি মানবাধিকার সংস্থা, অধিকারের মতে, জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কথিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ৭১টি ঘটনার মধ্যে ৩৫ জন মারা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের ফলে, ৩০ জন আইন প্রয়োগকারীর দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। হেফাজতে থাকা অবস্থায় ছয়জন কথিত নির্যাতনে মারা গেছেন। ২০২০ সালে অধিকার মোট ২২৫টি অভিযুক্ত বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ডের রিপোর্ট করেছে। ২০১৯ সালের ৩৯১টি ঘটনার থেকে কম।

জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে, স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছে যে, ১০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি, গণমাধ্যমে খবর হয়েছে কক্সবাজারে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এর সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জাকির বাহিনী গ্যাং এর প্রধান সহ তিন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিহত হয়েছে। ১৬ জুলাই, লুফতার রহমান এবং হাশেম উল্লাহ র‌্যাব এবং বর্ডার গার্ডস অফ বাংলাদেশের (বিজিবি) সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। ১৯ জুলাই কক্সবাজারে র‌্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কলিমুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা শরণার্থী নিহত হয়েছে। তবে ঘটনার পর নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার পর, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে যে নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে পুলিশ তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে এবং পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের পর ২৬-২৮ শে মার্চ বিক্ষোভ চলাকালীন কমপক্ষে ১৯ জন নিহত এবং ১০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। গত ১৬ মে ব্যবসায়ী শাহিন উদ্দিন হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে দুই আসামি গ্রেপ্তারের কয়েকদিন পর নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দুইজনের বিরুদ্ধে ছেলের সামনেই উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।

আমেরিকার মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়, আগস্টে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবসরপ্রাপ্ত সেনা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার তদন্তের জন্য একটি সিনিয়র তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্তের ফলস্বরূপ, কর্তৃপক্ষ ২১ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে এবং নয়জন কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করেছে। ২০২০ সালে কক্সবাজারে পুলিশ একটি চেকপয়েন্টে মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই মামলার রায় হয়েছে সম্প্রতি। সিনহার হত্যাকাণ্ড পুলিশ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং আইন প্রয়োগকারীর বাড়াবাড়ি নিয়ে দেশব্যাপী তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে 'মৌলিক ত্রুটি' রয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে। ১৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করার সময় তিনি বলেন, "বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে আলোচনার বিষয় রয়েছে। তাই সরকার মার্কিন সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে।" র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‍্যাব) ‘ব্র্যান্ড নেম ফর পিস’ উল্লেখ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, "এই প্রতিষ্ঠানের বদনাম করা উচিত নয় যা দেশকে জঙ্গিবাদ দমনে সহায়তা করেছে।" তিনি বলেন, "প্লিজ ডু নট ট্রাই মেলাইন দিস ইনস্টিটিউশন দ্যাট উই রিলাই আপঅন হেভিলি।" প্রতিমন্ত্রী বলেন, "গ্রামে-গঞ্জে যাবেন, র‌্যাব ইজ আ ব্র্যান্ড নেম ফর পিস। র‌্যাব ইজ আ ব্র্যান্ড নেম হোয়্যার ইউ গেট জাস্টিস। র‌্যাব ইজ আ ব্র্যান্ড নেম ফর অ্যান্টি টেরোরিজম অ্যাক্টিভিটিস।"


প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, বিরোধীদল, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মীসহ বেশ কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া জানতে ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। তাদের কথায় বিচারবহির্ভূত হত্যা বিষয়ে এই রিপোর্ট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানা গেছে।

আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ

আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে। এই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে আওয়ামী লীগের শাসনামলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। আবার পদ্মাসেতু এবং মেট্টোরেলের মতো অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। দেশের জিডিপি বৃৃদ্ধি পেয়েছে, জনগণের মাথাপিছু আয় এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। যখন এতোসব ইতিবাচক ফলাফলে বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিষ্ময় প্রকাশ করেছে, সেখানে আমেরিকার এই মানবাধিকার রিপোর্ট দিয়ে মূলত আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক উপায়ে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করতে না পেরে বিদেশী সাহায্য নিয়ে, মিথ্যা তথ্য প্রচার করে বিদেশীদের প্রভাবিত করার কাজ করছে একটি পক্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় আমেরিকার এই মানবাধিকার রিপোর্ট আমরা দেখতে পেয়েছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ সরকার দেশের জনগণকে সাথে নিয়েই এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করবে।

রুহুল কবির রিজভী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি
রুহুল কবির রিজভী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি

রুহুল কবির রিজভী

জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি

গুম-খুন-অপহরণের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এরইমধ্যে নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানি রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এক যুগের বেশি সময় ধরে বিনা ভোটের অবৈধ সরকার গুম, খুন, অপহরণকে তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার রক্ষাকবচে পরিণত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপে পিছু হটায় গুম-খুনের আতঙ্কে থাকা পরিবারগুলোয় কিছুটা হলেও স্বস্তি নেমে এসেছিল। কিন্তু ইদানীং আবারও পুরোনো পৈশাচিক চেহারায় ফিরে এসেছে সরকার। আবার ক্রসফায়ারের নামে বিনাবিচারে মানুষ হত্যা শুরু করেছে। আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তা এই সরকারের হত্যা-জুলুম ও নির্যাতনের আন্তর্জাতিক দলিল। যা এই আওয়ামী সরকারের অপকর্মের দলিল হিসেবে পরিগণিত হবে।

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন

উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগ
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এখন আমি একটা কথা বলতে চাই, প্রতিটি দেশের নিজস্ব কিছু বিচার-ব্যবস্থা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। তারা নিজের দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে কাজ করে। আমেরিকা বাংলাদেশের বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে যে তথ্য হাজির করেছে, তা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাখচ করে দিয়েছে। এই রিপোর্টগুলো বাংলাদেশের ভেতর থেকেই কেউ তৈরি করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। তারা এখন এই রিপোর্ট প্রকাশ করছে। আমেরিকায় বছরে কতোজন নিহত হন, সেই তথ্য নিয়ে তারা কী পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন, এটাও আমরা জানতে পারি। এখন শেষ কথা হচ্ছে- আমেরিকা বাংলাদেশ বিষয়ে যে রিপোর্ট দিয়েছে তা রাজনৈতিক। একজন আইনজীবী হিসেবে আমার কাছে এটাই মনে হয়েছে।

নূর খান লিটন, মানবাধিকারকর্মী
নূর খান লিটন, মানবাধিকারকর্মী

নূর খান লিটন

মানবাধিকারকর্মী

বাংলাদেশে যে বিচারবহির্ভূত হত্যা হয় তা সবাই জানে। এখন সবাই জানা এবং তথ্য আকারে সামনে হাজির হওয়া এক নয়। আমেরিকা যে রিপোর্ট হাজির করেছে বিস্তারিত তা না দেখলে অনেকেই বিশ্বাস করতেন না। ওই রিপোর্টে প্রতিটি ঘটনার উল্লেখ আছে। তাই এখন এই পরিস্থিতি থেকে উন্নতি করতে হলে অন্ধ বিরোধীতা না করে এই রিপোর্ট আমলে নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা উচিৎ। যারা এসব ঘটনার সাথে জড়িত তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। একইসাথে ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে বিরোধী দল, মত দমনে এভাবে ব্যবহৃত না হয় সেজন্য কঠোর বিধান করতে হবে।

ড. আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক
ড. আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক

ড. আসিফ নজরুল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক

বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার একটি সংস্কৃতি চালু হয়েছে বলা যায়। আমরা প্রায়ই দেখি মামলার আসামী ধরতে গিয়ে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ধরনের বহু স্ক্রিপ্ট আমরা দেখেছি। এসবই কিন্তু বিনা বিচারে হত্যা। বিনা বিচারে হত্যা বন্ধ করতে না পারলে দেশের কোনো কিছুই কাজে আসবে না। আপনি মানুষের জীবন-যাত্রার মানের উন্নয়নের কথা বলছেন। কিন্তু যদি বিনা বিচারে মানুষকে হত্যা করা হয়, এসব যদি বন্ধ করা না যায় তাহলে কোনো উন্নয়নই তো কাজে আসবে না। আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট লিপিবদ্ধ করা থাকে, সেখান থেকে এমন একটি মানবাধিকার রিপোর্ট বাংলাদেশ সরকার কেন গুরুত্ব দিয়ে আমলে নিচ্ছে না, বুঝতে পারছি না। এখন এই রিপোর্ট মিথ্যা বলার মতো তথ্যও তো নেই। এখানে প্রতিটি ঘটনার উল্লেখ আছে। তারা যেভাবে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই, বিশ্লেষণ করেছে তার একটা বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। টিআইবি এই রিপোর্টকে সমর্থন করেছে। টিআইবির একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। তাই আমি মনে করি, এই রিপোর্টকে দ্রুত আমলে নিয়ে সরকারের উচিৎ কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও বিচারবহির্ভূত হত্যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। গণতন্ত্র এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা একসাথে থাকতে পারে না।

শাহদীন মালিক, সুপ্রীম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী
শাহদীন মালিক, সুপ্রীম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী

শাহদীন মালিক

সুপ্রীম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী

এটা নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। বিষয় হচ্ছে- আমেরিকার মানবাধিকার রিপোর্ট থেকে জানা গেছে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে। এবং যে সংখ্যার কথা বলা হচ্ছে তা কমও নয়। এই তথ্যটি তারা নিয়েছে আবার বাংলাদেশের আসক থেকে। এখন বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা যে হয়ে আসছে, তা সবাই জানে। র‌্যাবের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আসায় কিছুদিন এটি বন্ধ ছিল। আবার একটি হতে দেখা গেল। এটি কেন ঘটে! যখন বিচারবিভাগের প্রতি আস্থা কমে আসে, কোনো দেশের সরকার নিজের ইচ্ছাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তখন এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে। এখন আমেরিকার রিপোর্টের বিরোধীতা না করে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে উদ্যোগ নিলেই বেশি ভালো।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও র‍্যাব

উল্লেখ্য, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজিপি বেনজীর আহমেদও রয়েছেন। এ ছাড়া র‍্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র‍্যাব ৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত। এতে বলা হয়েছে যে, তারা আইনের শাসন, মানবাধিকারের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ক্ষুণ্ন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‍্যাব হচ্ছে ২০০৪ সালে গঠিত একটি সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের নির্দেশে তদন্ত পরিচালনা করা।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওদের অভিযোগ হচ্ছে যে, র‍্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং ২০১৮ সাল থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই সব ঘটনার শিকার হচ্ছে বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।

(এই প্রতিবেদনের কিছু তথ্য ইউএনবি থেকে নেওয়া হয়েছে।)

XS
SM
MD
LG