বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠি বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে বৈষম্যের শিকার হন বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশটিআইবি এই গবেষণাটি পরিচালনা করে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিতে বাধা, বৈষম্য ও জবাবদিহিতার ঘাটতি সংবিধানের সমতাভিত্তিক বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের অঙ্গীকারকে পদদলিত করছে। সংস্থাটি বলছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক সেবা নিশ্চিত করতে জবাবদিহি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা না হলে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ‘কাউকে পেছনে না রাখা’ লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে।
‘সরকারি সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা: জবাবদিহি ব্যবস্থার বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন পেশের পাশাপাশি সংকট উত্তরণে ১০ দফা সুপারিশও দিয়েছে সংস্থাটি।
টিআইবি জানায়, ২০২০ সনের অক্টোবর থেকে ২০২১ সনের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালে গুণবাচক এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরিমাণবাচক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণাটি করা হয়। আদিবাসী, অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার, দলিত, চা বাগান শ্রমিক, হিজড়া জনগোষ্ঠীদের এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উপাত্তের অনুপস্থিতি তাদের প্রতি উদাসীনতা ও অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ, এবং তাদের মূলধারায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকারি সেবা ও জবাবদিহি ব্যবস্থা সর্ম্পকে প্রচারে ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের নেতিবাচক মানসিকতা ও চর্চা, অভিযোগ দাখিলে প্রত্যাশিত ফলাফল না পাওয়ার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী জবাবদিহি কাঠামো ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হন।
গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশ সংবিধানে নাগরিকের বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যের কারণে অধিকার ও সেবা প্রাপ্তিতে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না উল্লেখ করা হলেও, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ‘খসড়া বৈষম্য বিলোপ আইন’ এখনো পাস হয়নি। আবার খসড়া আইনে অভিযোগ অনুসন্ধানকারী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে জবাবদিহি করার বিষয়টি উল্লেখ নেই।
অন্যদিকে, তদন্তের স্বার্থে ‘সময় বর্ধিত’ করা এবং ‘যুক্তিসঙ্গত’ কারণে মামলা মুলতবির সুযোগ আইনে দেয়া আছে, যার পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা খসড়া আইনে অনুপস্থিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনগতভাবে সকল আদিবাসীর পরিচয় ও তাদের ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন থাকলেও সমতলে বসবাসরত বৃহৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের ভূমি সমস্যা সমাধানে ভূমি কমিশন নেই। গবেষণা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এবং নীতিমালা, ২০১৫- এ অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার ভুক্তভোগীদের প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে সরাসরি নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়নি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০১০এ আদিবাসী ভাষার বই বিতরণ, এর পাঠদান নিশ্চিত, শিক্ষক চাহিদা নিরূপণ ও তাদের প্রশিক্ষণ তদারকির বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় তদারককারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায় না।
সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্তের ঘাটতি ও অস্পষ্টতা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্তিকরণে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সেবা প্রদানের জন্য এবং অভিযোগ দায়েরের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে যেটি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ায় সেবা প্রাপ্তি থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হন। বঞ্চিত হওয়ার পর যদি অভিযোগ দায়ের করেন, তখন তারা বাধাগ্রস্ত হন কিংবা প্রতিকার পান না। বরং অনেক সময় অভিযোগ উত্থাপন করলে হুমকির সম্মুখীন হন।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষয়ে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতার জন্যই সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটছে। এছাড়া আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বিচার না হওয়াও এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তির অন্যতম কারণ।
এসব সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে টিআইবি’র পক্ষ থেকে। এর মধ্যে বিভিন্ন সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিতে বাধা দূর করা এবং বৈষম্যহীন ও জবাবদিহিমূলক সেবা নিশ্চিত করতে বৈষম্য বিলোপ আইন দ্রুত প্রণয়ন করার তাগিদ দেয়া হয়েছে।