অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

৫ মাস ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় কাশ্মীরের ব্যাবসা বানিজ্যে ব্যাপক লোকসান


ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু কাশ্মীরের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাকে অনেকেই বলছেন গনতন্ত্রের ওপর আক্রমণ। ইন্টারনেট বন্ধ করার নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়ছে রাজ্যের অর্থনীতিতে। হাজার হাজার মানুষ চাকরী হারাচ্ছেন এই কারনে।

ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু কাশ্মীরের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাকে অনেকেই বলছেন গনতন্ত্রের ওপর আক্রমণ। ইন্টারনেট বন্ধ করার নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়ছে রাজ্যের অর্থনীতিতে। হাজার হাজার মানুষ চাকরী হারাচ্ছেন এই কারনে।

এ্যাক্সেস নাও নামের একটি অধিকার গ্রুপ কাশ্মীরের অবস্থা পর্যবেক্ষন করছে। তারা বলছে এখানে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় স্থানীয় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে।


এ্যাক্সেস নাও এর সিনিয়র কাউন্সেল এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নীতি বিষয়ক পরিচালক রামান জিত সিং চিমা ভয়েস অব আমেরিকাকে জানান ভারতের কোনো গনাতান্ত্রিক রাজ্যে কাশ্মীরের মতো এ্যাতো লম্বা সময় ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়নি।

কাশ্মীর চেম্বার অব কর্মার্স বলছে ইন্টারনেট বন্ধে সারা অঞ্চলের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। চিমা বলেন ইউনিয়ন সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে গোটা অঞ্চলের সমন্বিত উন্নয়ন করা হবে, কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধে তা সম্ভব হচ্ছে না।

গত আগষ্ট নয়া দিল্লি কাশ্মীরের সেমি-অটোনোমাস হিসাবে বিশেষ মর্যাদা তুলে নিয়ে কার্ফিউ জারি করার সময় থেকে থেকে এই অঞ্চলে ইন্টারনেট বন্ধ।

সরকার তার সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলছেন সন্ত্রাসী ঘটনা বন্ধের লক্ষ্যে এটি সাময়িক ব্যবস্থা।


গত আগষ্টে টেলিভিশনে প্রচারিত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রে মোদী বলেন, “কাশ্মীর সিদ্ধান্ত স্থানীয়দের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। এর অর্থ ভারতীয় আইনের রক্ষা, শিল্পায়ন, পর্যটনের উন্নয়ন এবং বেশি বেশী কর্মসংস্থান”।

তবে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছেন, ঘটছে তার বিপরীত।

সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্কিত আইন পাশ হওয়ার পর কাশ্মীরের অবস্থা নিয়ে ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে করা টুইটার বার্তায় বলা হচ্ছে, “স্বাভাবিক শব্দের অর্থ আপনারা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন; জম্মু কাশ্মীরকে নরমাল বলা হচ্ছে;- সারা দেশের অবস্থাও জম্মু কামীরের মতোই। এই সরকার জনগনের তোয়াক্কা করে না”।

ভারতে হিন্দু খ্রীষ্টান ও অপরাপর ধর্মীয় সংখ্যালঘূদের নাগরিক হবার অধিকার দিয়ে ভারতীয় সংসদে সম্প্রতি একটি বিল পাশ হযেছে। বলা হয়েছে ভারতের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘূদের প্রমান করতে হবে যে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারনে বিচার এড়াতে তারা ভারতে এসেছেন।

কিন্তু এই আইন মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সমালোচকরা বলছেন, এটি স্পষ্টভাবেই বৈষম্য।

সন্ত্রাস নাকি প্রতিবাদ?

ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি সরকার, কাশ্মীরের ইন্টারনেট বন্ধের পক্ষে বলতে গিয়ে বারবরই বলছেন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঠেকাতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।


আইনপ্রনেতাদের এক বৈঠকে নভেম্বরে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যখন বলছে অবস্থা স্বাভাবিক হবে, তখনই কাশ্মীরের ইন্টারনেট চালু করা হবে।

তিনি বলেন, “এই অঞ্চলে আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চলছে; আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে; যখনই স্থাণীয় কর্তৃপক্ষ মনে করবে পরিস্থিত শান্ত; তখনই ইন্টারনেট খুলে দেয়া হবে কাশ্মীরে”।

কাশ্মীরের অস্থিতিশীল পরিবেশ জিইয়ে রাখার জন্যে পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের দায়ী করছেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। বলা হচ্ছে পাকিসম্তান কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থাণীয় জঙ্গী গোষ্ঠিকে উস্কানী দিচ্ছে। ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, মূলত সংগঠিত রাজনৈতিক প্রতিবাদ বন্ধের লক্ষ্যেই কাশ্মীরের ইন্টারনেট বন্ধ রেখেছে।

ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুমিত গাঙ্গগুলি বলেন, “কারন হিসাবে ভারতীয় সরকার বলছেন সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার আশংকায় এ সিদ্ধান্ত। আমার মতে সংগঠিত রাজনৈতিক প্রতিবাদ এড়াতেই এটা করা হয়েছে”।

সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটির শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের অধ্যাপক অশোক সোয়াইনের মতো অনেক বিশ্লেষক বলছেন কাশ্মীরের ইন্টারেনেট বন্ধে ভারতীয় সরকারের সিদ্ধানের নানা কারন রয়েছে।

“আমার মতে মূল কারন কাশ্মীরের সাথে যোগাযোগ বন্ধ নয়; বরং কাশ্মীর যেনো বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে সেজন্যেই করা। কারন ভারত সরকার গনতান্ত্রিক সরকার হিসাবে বাইরের বিশ্বে যে ইমেজ আছে তা ধরে রাখতে চায়”।

“ইন্টারনেট বন্ধ করার আরেক উদ্দেশ্য হচ্ছে স্থানীয় গনমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রন করা; কারন গনমাধ্যম এবং সাংবাদিকেরা ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল”।

স্থাণীয় অর্থনীতিতে প্রভাব?

কাশ্মীর চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট শেখ আশিক ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন কাশ্মীর জুড়ে বেকারত্ব বাড়ছে এবং ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হচ্ছে।

“আমাদের কুটিরশিল্প বলতে গেলে পুরোটাই ইন্টারনেট নির্ভর; এখন একেবারেই বন্ধ। ফলে ৫০ হাজার কর্মী বেকার। কুটির ও হস্তশিল্পের রপ্তানী ৬২ শতাংশ কমে গেছে”।


বিশ্লেষকরা বলছেন কাশ্মীরের ইন্টারনেট বন্ধের প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছে পর্যটনের ওপর, স্বাস্থ্য খাতে, শিক্ষায় এবং যোগাযোগ শিল্পের ওপর।

অধ্যাপক সোয়াইনের মতে, “ইন্টারনেট বন্ধের কারনে কাশ্মীরের অর্থনীতে ১.৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। বেশকিছু কোম্পানী বন্ধ হয়ে গেছে”।

শিক্ষা স্বাস্থ্যখাতে তো সংকট হয়েছেই, মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরাতেই প্রভাব পড়েছে। মানবিক সংকট বেড়েছে। ব্যবসা বানিজ্য, বিশেষ করে ফলের ব্যবসা ও পর্যটন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

স্থাণীয়দের মতামত

মুহিত মেহরাজের মতো কাশ্মীরের তরুন উদ্যোক্তারা মনে করেন ইন্টারনেট না থাকায় কাশ্মীরের সামনে বড় দু;র্দিন অপেক্ষা করছে। এখানকার বেকারত্বের হার যেভাবে বাড়ছে তা আশংকাজনক।

Pakistan India Kashmir
Pakistan India Kashmir


মুহিত মেহরাজ বলেন, “ইন্টারনেট সহসা খুলে না দিলে আমি জানি না আমার নিজেই ভবিষ্যৎ কি হবে”।

অনেকেই বলেন, তাদেরকে কাশ্মীর ছাড়তে হয়েছে। সাইদ মুজতবা তাদের একজন। কাশ্মীর আর্ট কোয়েস্টের মালিক সাইদ দিল্লিতে তার ব্যবসা সরিয়ে এনেছেন কাশ্মিরে ইন্টারনেট না থাকায়।

“আমরা কাশ্মীর ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। এখন দিল্লিতে নতুনভাবে চেষ্টা করছি সুযোগ সুবিধা খুজছি; সংগ্রাম করছি কিন্তু আমাদের মন পড়ে আছে কাশ্মীরে।

সরকার বলেই চলেছে কাশ্মীরের অবস্থা স্বাভাবিক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন, কাশ্মীর স্বাভিবিক; কিন্তু কাশ্মীর চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আশিক আবারো বলেন, “আমাদেরকে একভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে; অথচ আমরা কাশ্মীরে উন্নয়নের কোনো চিহ্ণই দেখছি না”।

আমাদের ভয়েস অব আমেরিকার সহকর্মী নায়লা মোহাম্মাদ ও ইউসুফ জামিল, শ্রীনগর থেকে জুবাইর দারের পাঠানো তথ্য নিয়ে এই প্রতিবেদনটি করেছেন।

XS
SM
MD
LG