অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

মুজিব লোকান্তরে, মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে- কামাল চৌধুরী


কামাল চৌধুরী
কামাল চৌধুরী

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সাথে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পুরো জাতিকে স্তব্ধ করে দেয়া এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করাটা সেসময় ছিল নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া। তারপরও প্রতিবাদ হয়েছে। এই হত্যার প্রতিবাদে যারা কলম তুলে ধরেছিলেন তাদের মধ্যে সেদিনের ২০ বছর বয়সের তরুণ কামাল চৌধুরীও ছিলেন। কামাল চৌধুরী লিখেছিলেন এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রকাশিত প্রথম কবিতাটি। বর্তমানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক, ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন সেই সময়টার কথা। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন শতরূপা বড়ুয়া। ​

১০ জানুয়ারি ২০২০ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হাতে মুজিবশতবর্ষের লোগো তুলে দেওয়া হচ্ছে ।
১০ জানুয়ারি ২০২০ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হাতে মুজিবশতবর্ষের লোগো তুলে দেওয়া হচ্ছে ।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর, ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ছাপা হওয়া প্রথম কবিতাটি আপনার লেখা বলে আমরা জানি। এটি কবে, কোথায় ছাপা হয়েছিল? এই কবিতাটি ছাপা হওয়ার প্রেক্ষাপটটা জানতে চাই।

কামাল চৌধুরীঃ ধন্যবাদ। আপনারা জানেন যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। সে কারণে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালির কাছে তিনি কিংবদন্তীর মহানায়ক, শ্রেষ্ঠতম বীর; কিন্তু ১৯৭৫ সালের ভোররাতে তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড তাঁকে বাঙালির চিরন্তন শোকের প্রতীকেও রূপান্তরিত করেছে। এখন তিনি আমাদের প্রাত্যহিকতায়, আমাদের আবেগের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছেন যে তাঁকে জাতির অন্তর থেকে আলাদ করা যায়না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার পর সেই কঠিন সময়ে, প্রকাশ্যে শোক প্রকাশ করা ছিল মৃত্যুর সামিল। তারপরও প্রতিবাদ হয়েছে।কবিরা এই প্রতিবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

১৯৭৭ সালের কথা। আমি তখন , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। বিশ বছর বয়েস- এখন যখন পেছনে ফিরি , সেই দিনগুলির কথা মনে করি, গৌরববোধ করি এ জন্য যে সেই কঠিন সময়ে সাহস দেখাতে পেরেছিলাম।

সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন প্রকাশ করতো জয়ধ্বনি পত্রিকা। জয়ধ্বনি’র ১৯৭৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রকাশি) ‘জাতীয়তাময় জন্মমৃত্যু’ নামে আমার একটি কবিতাপ্র কাশিত হয়। লাইনগুলো ছিল এরকম:

রক্ত দেখে পালিয়ে গেলে

বক্ষপুরে ভয়

ভাবলে না কার রক্ত এটা

স্মৃতিগন্ধময়

দেখলে না কার জন্মমৃত্যু

জাতীয়তাময়।

এই কবিতার লাইন দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের দেওয়ালে পোস্টার সাঁটা হয়েছিলো তখন।

বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা সমকাল প্রকাশিত হতো, ৭, ডি আই টি এভেন্যু, মতিঝিল, ঢাকা-২ থেকে। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত মাসিক সমকাল পত্রিকার বিজয় দিবস সংখ্যা ১৩৮৫ তে কবিতাটিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথম প্রকাশিত কবিতা বলে উল্লেখ করা হয়। তাতে আমাকে পচাঁত্তর পরবর্তী বাংলা কবিতার সোচ্চার উচ্চারণের ভোরের পাখি আখ্যা দেওয়া হয়।

পরের মাসে , ১৯৭৭ সালের ২৬শে মার্চ আদমজী জুট মিলের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতা পড়ি।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর সেই সময়ে তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখা তা প্রকাশ করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো, সেই সময়টার কথাযদি একটু বলতেন...

কামাল চৌধুরীঃ তখনকার অবস্থা এখন ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না । দুঃসময় বললেও সবকিছু বলা হয় না। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোররাতে ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়তায় সেনাবাহিনীর একটি অংশ বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়িতে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান। পরদিন ১৬ আগস্ট তড়িঘড়ি করে তাঁকে দাফন করা হয় টুঙ্গিপাডায়। এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা জাতি। শুরু হয় দেশের উল্টো যাত্রা। চারিদিকে ষড়যন্ত্রকারী, একাত্তরের পরাজিত শক্তি ঘাতকদের আস্ফালন । ঘাতক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি কখন জেঁকে বসেছে জাতির ঘাড়ে। হত্যা, নির্যাতন, গুম খুনে আতঙ্কিত জনপদ। চলছে সামরিক শাসন। সে একশ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধুর সমর্থক, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের উপর নেমে এসেছে অত্যাচার নির্যাতনের খড়গ। বন্দুকের নলের নিচে স্তব্ধ শোক প্রকাশের ভাষা! কেউ কথা বলতে পারছে না! একবার ভাবুন কী প্রতিকূল সময় -যে দেশকে তিনি সৃষ্টি করেছেন বঙ্গবন্ধু সে দেশেই নির্বাসিত নাম, তিনি নিষিদ্ধ, তাঁর নাম উচ্চারণ করা যায়না!

কিন্ত আমরা সাহস করে ঝুঁকি নিয়েছিলাম। ফলাফল কী হবে ভাবিনি। আন্দোলন সংগ্রামেও যোগ দিয়েছলাম। এ জন্য আমার পিতাকেও চাকুরিতে হয়রানি, ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনার লেখা দুটো লাইন, মুজিব লোকান্তরে /মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে, সে সময় স্লোগান হিসেবে খুব জনপ্রিয় হয়, সম্পর্কে যদি বলেন...

কামাল চৌধুরীঃ ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ১৯৭৬ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সে সময়ের বাংলাদেশ ছিল এক আতংকিত জনপদ। বঙ্গবন্ধুর এই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জমা হয়েছিলো হৃদয়ে। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না এই হত্যাকাণ্ড। বুকের ভেতর তীব্র প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিলো, প্রতিবাদী হয়ে উঠছিলো মন। কিন্তু সময় প্রতিকূল-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘাতকরা তৎপর, ছাত্রদের মধ্যেও তারা পেটোয়া বাহিনী তৈরি করেছে প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে।

১৯৭৭ সালের শেষদিকের ঘটনা। তারিখটা আজ আর মনে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাশে তখন কয়েকটি চায়ের দোকান ছিলো।শরিফ মিয়ার স্টলে ষাটের দশকের কবিরা আড্ডা দিতেন। তার পাশেই ছিলো গফুর মিয়ার দোকান। আমরা সত্তরের দশকের তরুণ কবি-লেখকেরা গফুর মিয়ার দোকানে আড্ডা দিতে শুরু করলাম। এখানে বসেই আমি -

“মুজিব লোকান্তরে/মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে” শ্লোগানটি লিখলাম ।

ছাত্রলীগের একজন নেতা ছিলেন, আমার এক বছরের সিনিয়র, নাম মোহাম্মদ হায়দার আলী। থাকতেন হাজী মোহাম্মদ মহসিন হলে। হায়দার ভাই ছিলেন দেয়াল লিখনে ওস্তাদ। সে দিনই লেখাটি হায়দার ভাইয়ের হাতে দিলাম। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে হায়দার ভাইয়ের ঝকঝকে হাতের লেখায় ফুটে উঠলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী শ্লোগান

“মুজিব লোকান্তরে

মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে”

পরবর্তীতে শ্লোগানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৭৯ সালের ছাত্রলীগের সংকলনের নাম করা হয় ‘মুজিব লোকান্তরে মুজিববাংলার ঘরে ঘরে’। তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন জনাব ওবায়দুল কাদের, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জনাব বাহলুল মজনুন চুন্নু।

আজ যখন ভাবি, সেই দুঃসময়ের সাহসী এ কাজের কথা, তখন আবেগে উদ্বেলিত হই। কবিতার আবেগ আমাকে প্রবলভাবে সাহসী করে তুলেছিলে। হত্যার বিরুদ্ধে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস জুগিয়েছিলে। ১৯৭৭ সালে ঘাতক কবলিত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানাবার এই দুঃসাহস আজও আমার অহংকার।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে আপনি আরও বেশকিছু কবিতা লিখেছেন, এই কবিতাগুলো নিয়ে আপনার আলাদা কোনো বই আছে কি? বইটি কবে প্রকাশিত হয়েছে? কবিতাগুলোর রচনাকাল কোন সময়?

টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সমাধিসৌধে কামাল চৌধুরীর লেখা গানের চরণ।
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সমাধিসৌধে কামাল চৌধুরীর লেখা গানের চরণ।

কামাল চৌধুরীঃ হ্যা. আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকগুলো কবিতা লিখেছি। বিভিন্ন গ্রন্থে কবিতাগুলো আছে। পরে কবিতাগুলি নিয়ে ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা ও কলকাতা থেকে বইটি যৌথভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের শেষে কবিতা লেখার সময়কাল প্রেক্ষাপটের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে, যা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। আরো কিছু কবিতা লিখেছি পরে, যা এখনো গ্রন্থভুক্ত হয়নি। একটি গদ্য গ্রন্থ আছে, ‘বাঙালির বঙ্গবন্ধু’ নামে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নিবেদিত কবিতার একটি সংকলনও আমি সম্পাদনা করছি। আশা করি দ্রুত বের হবে।

ভয়েস অফ আমেরিকাঃ এই কবিতাগুলোর মধ্যে আপনার সবচেয়ে প্রিয় কবিতা কোনটি? কেন?

কামাল চৌধুরীঃ আমার প্রিয়, বিশেষ প্রিয় ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে’ কবিতাটি। এটি ১৯৭৮ সালে লেখা। আমার সেই সময়ের শোক, বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা আবেগ, প্রতিবাদ, ঘাতকদের প্রতি ঘৃণা কবিতাটির পঙক্তিতে পঙক্তিতে মিশে আছে। এ কবিতাটি তখন আমি অনেক সমাবেশে পড়েছি। আমার ধারণা এটি সে সময়ে প্রতিবাদী বহু তরুণদের উদ্দীপ্ত করেছে। টুঙ্গিপাড়া তখন গ্রাম; জাতির পিতা ঘুমিয়ে আছেন সেখানে। প্রতীকীভাবে সেটিই আমাদের সবার গ্রাম। সেখান থেকে আমি সাহস, শক্তি খুঁজেছি।কবিতার শেষ ক'টি লাইন এরকম:

যেখানে ঘুমিয়ে আছো, শুয়ে থাকো

বাঙালির মহান জনক

তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয় কন্ঠ

শৌর্য আর অমিত সাহস

টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো

তোমার সাহস নেবে

নেবে ফের বিপ্লবের মহান প্রেরণা।

কামাল চৌধুরীর কণ্ঠে "টুঙ্গিপাড়ায় ঘুমাও বাংলাদেশ"
please wait

No media source currently available

0:00 0:02:40 0:00

XS
SM
MD
LG