সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে অনশনরত শিক্ষার্থীরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) রাত ৯টায় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান অনশনে থাকা তিন শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আবেদীন, জাহেদুল ইসলাম ও সাবরিনা মমতা।
প্রেস ব্রিফিংয়ে আন্দোলন কর্মসূচিতে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অভিযোগে শাবিপ্রবির প্রাক্তন পাঁচ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে নিন্দা এবং অবিলম্বে তাদের নিঃর্শত মুক্তির দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া হলের ডাইনিং বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অনশনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, যে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেকে নিরাপদ মনে করেন না, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। এ জন্য তার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
এর আগে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অনশনকারী ২৮ শিক্ষার্থীর শারীরিক দিক বিবেচনা করে অনশন থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। রাত ৯টায় অনশনের ১৫০ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়।
শাবিপ্রবির প্রাক্তন পাঁচ শিক্ষার্থী আটক
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ছাত্র আন্দোলনে টাকা পাঠানোর অভিযোগে পাঁচজন প্রাক্তন শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। আটক পাঁচ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) রাতে সিলেটের জালালাবাদ থানায় ওই মামলা করা হয়।
জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হুদা খান মামলা দায়েরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
মামলার অভিযুক্তরা হলেন-টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর দারিপাকা গ্রামের মতিয়ার রহমান খানের ছেলে হাবিবুর রহমান খান (২৬), বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানার লক্ষ্মীকোলা গ্রামের মুইন উদ্দিনের ছেলে রেজা নুর মুইন (৩১), খুলনা জেলার সোনাডাঙ্গার মিজানুর রহমানের ছেলে এ এফ এম নাজমুল সাকিব (৩২), ঢাকার মিরপুরের মাজার রোডের জব্বার হাউসিং বি-ব্লকের ১৭/৩ বাসার এ কে এম মোশাররফের ছেলে এ কে এম মারুফ হোসেন (২৭) এবং কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার নিয়ামতপুর গ্রামের সাদিকুল ইসলামের ছেলে ফয়সল আহমেদ (২৭)।
তাদের মধ্যে হাবিবুর শাবির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে ২০১২ সালে পাস করেছেন। একই বছর আর্কিটেকচার বিভাগ থেকে পাস করেছেন রেজা নূর মঈন দীপ ও নাজমুস সাকিব দ্বীপ।
এর আগে রাজধানী ঢাকা থেকে শাবিপ্রবির সাবেক এই পাঁচ শিক্ষার্থীকে আটকের পর সিলেটে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দল তাদের সিলেটে নিয়ে যায়। সোমবার ও মঙ্গলবার ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে সিআইডি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ তাদের আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে লংমার্চের ঘোষণা
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ ও শিক্ষার্থীদের নায্য দাবির সমর্থনে ঢাকা থেকে সিলেটে লংমার্চের ডাক দেওয়া হয়েছে।
‘বিবেকবান নাগরিক সমাজ’-এর ব্যানারে বুধবার (২৬ জানুয়ারি) সকাল ১০টায় রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে এ কর্মসূচি শুরু হবে।
মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) বিবেকবান নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শাবিপ্রবির উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন চলছে। দীর্ঘ অনশনে অনেকেই অসুস্থ হতে শুরু করেছেন। হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত তাদের কেউ অনশন ভাঙেননি। সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট কেউ শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙাতে এগিয়ে আসেননি। তাদের দাবি পূরণে আশ্বাসও দিতে দেখা যায়নি। এভাবে টানা অনশনে ছাত্র-ছাত্রীরা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন। এভাবে চলতে পারে না। শিক্ষার্থীরা জীবন বিপন্ন করে অনশন কর্মসূচি পালন করছেন, আমাদের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা।
এমন পরিস্থিতিতে আজকের মধ্যে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ না করলে আগামীকাল বুধবার ঢাকা থেকে সিলেট অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি পালন করা হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে দেশের সব বিবেকবান মানুষকে লংমার্চ কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ছাত্র-শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড় এবং শ্রমজীবীসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে লংমার্চ সফল করা হবে।
বিবেকবান নাগরিক সমাজের পক্ষে বিজ্ঞপ্তিতে সই করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহীদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, কবি ও লেখক রাখাল রাহা এবং সাংবাদিক এহসান মাহমুদ।
লংমার্চ কর্মসূচি উপলক্ষে বুধবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে রাবি শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি
শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের ওপর ‘পুলিশি হামলা’র প্রতিবাদে এবং শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষকেরা।
মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বরে তারা এ কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় তারা সরকারকে শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।
কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলা নতুন না। এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও পুলিশের হামলার শিকার হয়েছেন। ২০১৪ সালের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা হয়েছিল। ২০০৩ সালে রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা হয়েছিল। এখনো হামলার ঘটনা ঘটছে। কেন শাবিপ্রবিতে এ ঘটনা ঘটলা? কারণ তারা শুধু স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।”
একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী মামুন হায়দার বলেন, “গত ১০ থেকে ২০ বছর ধরে আমি ছাত্র আন্দোলন দেখছি। শাবিপ্রবিতে তারা প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা করতে চেয়েছিল। ১৪০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে শিক্ষার্থীরা অনশনে আছে। তারপরও সেদিকে নজর নেই সরকারের। আমরা শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের সমর্থনে আন্দোলন শুরু করেছি এবং আমাদের কর্মসূচি চলবে।”
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌভিক রেজা ও ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মো. আলী রেজা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আবদুল মজিদ অন্তর, রাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শাকিলা খাতুন, রাবি ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মহব্বত হোসেন মিলনসহ অন্যান্য বাম ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা এ অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন।
এর আগে শাবিপ্রবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে গত রবিবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে ‘নীরব বিক্ষোভ’ করেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ খান।
উল্লেখ্য, শাহাজালাল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূত্রপাত গত ১৩ জানুয়ারি। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ছাত্রীদের আন্দোলনে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ১৬ জানুয়ারি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। তখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।