অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের সাক্ষাৎকার


ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক ও  প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক।
ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক ও  প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক।

আহমদ রফিক ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক ও প্রাবন্ধিক । ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন। এছাড়া রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধি পেয়েছেন টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলকাতা থেকে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন। ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এহসান মাহমুদ।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এই বছর ভাষা অন্দোলনের ৭০ বছর হল। ১৯৫২-তে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছিল সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কি না?

আহমদ রফিক : ভাষা আন্দোলনের যে লক্ষ্য তা অর্জিত হয়নি। বাহান্নর যে চেতনা তা পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি ষাটের দশকের ছয়দফা ও একাত্তরে বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রামে। অনেকেই স্বীকার করেন ভাষা আন্দোলন সব আন্দোলনের সূতিকাগার। তাই বাহান্নকে সব আন্দোলন-সংগ্রাম ও দাবি আদায়ের প্রেরণা মনে করা হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সংবিধান প্রস্তুত করলেন। সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য একটি সেক্যুলার সংবিধান প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। কিন্তু, তার মৃত্যুর পরেই দুই জেনারেল এসে সেটি ছিন্নভিন্ন করলেন। সমাজতন্ত্রকে বাদ দিয়ে দেওয়া হলো। তাদের শাসনকে আমার কাছে মনে হয়েছে পাকিস্তানি শাসনের ধারাবাহিকতা। যে সংবিধান দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা পেয়েছিলাম সেটি বদলে ফেলা হলো। দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে দেশ ভাষা আন্দোলনের যে লক্ষ্য ছিল সেখান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা কতোটা মাতৃভাষা হিসেবে অনুসরণ করা হচ্ছে বলে মনে করেন?

আহমদ রফিক: দেশের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা সব জায়গায় মাধ্যম হিসেবে বাংলার কথা বলা হয়েছিল। উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে তা আর হলো কই! দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শেখ সাহেব পর্যন্ত বহুবার বলেছিলেন, কিন্তু তা আর হলো না। বরং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা বেসরকারি সব সেক্টরে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গাতেই ইংরেজি হয়ে উঠল শিক্ষার মাধ্যম। স্বাধীনতার পরে খুব অল্প সময়ে আমরা দেখলাম সমাজে ধনিক শ্রেণির ভার্টিক্যাল গ্রোথ হয়েছে। এই শ্রেণির লোকজনের হাতে প্রচুর টাকা। তাদের সন্তানরা চাইলেই অধিক টাকা দিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে পারছে। ভাষা আন্দোলনের সময়ে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল তিনটি সেগুলো হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, সর্বস্তরে বাংলা চালু করো।

বর্তমানে দেশে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা হওয়ায় আরও ক্ষতি হচ্ছে। কারণ উচ্চশিক্ষায় প্রায় সবই ইংরেজি মাধ্যমে হয়ে থাকে। যারা একটু পিছিয়ে পড়া বা গ্রামের অসচ্ছল পরিবারের সন্তান তারা এতে করে পিছিয়ে থাকে। তাই উচ্চশিক্ষায় এসে তাদের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এই সমস্যাটা হয়েছে অর্ধেক বাংলা মাধ্যমে করায়। যদি উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বাংলায় পড়াশোনার সুযোগ হতো তাহলে তারা আরও ভালো করত।

ভয়েস অফ আমেরিকা: ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা করার দাবি শোনা যায় বিভিন্ন সময়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হলেও ভাষাসংগ্রামীদের ক্ষেত্রে এখনও হয়নি। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

আহমদ রফিক: গত কয়েক বছর যাবৎ ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা করার চেষ্টা চলছে। হাইকোর্ট এটা নিয়ে নির্দেশনাও দিয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরে এই তালিকা কি সঠিকভাবে করা সম্ভব? ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে কতজন আর জীবিত আছেন? ভাষা আন্দোলন এর সত্যিকার ঘটনা এখন আর কোনোভাবেই কি নির্ণয় করা সম্ভব? যারা প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রতিবাদকারী তাদের সংখ্যা এখন কত? এই তালিকা প্রণয়নের আগে দরকার ছিল ভালো আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে সংরক্ষণ করা। সেসবে কারও আগ্রহ আছে বলে দেখা যায় না।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাংলাদেশকে নিয়ে কেমন স্বপ্ন দেখেন?

আহমদ রফিক : এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে সংখ্যায় নয় গুণগত উৎকর্ষের মানুষ বাড়বে। যারা স্বাধীন দেশকে এগিয়ে যেতে মেধা ও পরামর্শ দেবেন। গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে।

XS
SM
MD
LG