রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের জলসীমায় আটকে পড়া বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের পণ্যবাহী জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ -তে রকেট হামলায় জাহাজটির থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমান (২৯) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত হাদিসুরের বাড়ি বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলায়। বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটিতে ২৯ জন নাবিক অবস্থান করছিল। এর মধ্যে দুইজন নারী ক্যাডেট রয়েছে। বাকি ২৮ জন অক্ষত রয়েছে। বাংলাদেশের নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বুধবার রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত প্রায় ৯ টা ২৫ মিনিটের দিকে জাহাজের ব্রিজে রকেট হামলা হয়। রকেট হামলায় জাহাজে আগুন লেগে যায়। এ সময় নাবিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগুন নেভানো হলেও হাদিসুর রহমান নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমডোর সুমন মাহমুদ সাব্বির বুধবার রাতে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ওই জাহাজে একটা রকেট আঘাত করেছে। সেটা বিস্ফোরিত হয়। সেখানে কর্মরত থাকা অবস্থায় জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মৃত্যু হয়।
নতুন ঘর বানিয়ে বিয়ের কথা ছিল হাদিসুরের
ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে নিহত হাদিসুর রহমান মাস ছয়েক আগে বড়গুনার বাড়িতে এসেছিলেন। এবার বাড়ি ফিরে বিয়ে করার কথা ছিল তার। নিজেদের পুরোনো ঘরের জায়গায় নতুন ঘর বানানোর কথা বলেছিলেন মাকে। সবশেষ বুধবার গোলার আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার আগে বাড়িতে মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। হাদিসুরের ছোট ভাই গোলাম রহমান প্রিন্স ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানালেন, আটকে থাকা জাহাজ ছাড়া পেলে শিগগিরই বাড়ি ফিরবেন বলে হাদিসুর বলেছিল। কিন্তু তা আর হলো না।
বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের মো. আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে হাদিসুর। চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বেতাগী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফোরকানের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে হাদিসুর রহমান। মাকসুদুর রহমান বলেন, হাদিস ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিল। চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে পাস করার পর ওই জাহাজে ছিল।
ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স বলেন, "গোলার আঘাত হানার সময় বড় ভাই বাইরে এসে মুঠোফোনে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। তবে হঠাৎ একটি গোলা এসে পড়ে জাহাজটিতে। বিকট শব্দের কারণে কিছুই শুনতে পাইনি। আমার ভাই এবার বাড়ি ফিরে বিয়ে করার কথা ছিল। আমাদের সব শেষ। একমাত্র আয়ের মাধ্যম ছিল আমার ভাই। আমরা কীভাবে বাঁচবো।"
ছেলে নিহত হওয়ার খবর পেয়ে শোকে ভেঙে পড়েছেন হাদিসুরের মা-বাবা। তার বড় বোন সানজিদা আক্তার জানান, "বুধবার জাহাজ থেকে ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্সকে ফোন করেন হাদিসুর রহমান। মায়ের শরীরের খোঁজ নেন। ডাক্তার দেখিয়েছে কিনা জানতে চেয়েছে। এরপর সবশেষে গতকাল ভিডিও কলে কথা হয়। এরপর রাতেই তার মৃত্যুর খবর পাই। আমাদের সব শেষ হয়ে গেল।"
হাদিসুরের মরদেহ ফিরিয়ে আনার উপায় কী
নিহত হাদিসুরের মরদেহ বর্তমানে জাহাজের ফ্রিজে রাখা হয়েছে। সেইসাথে চেষ্টা করা হচ্ছে জীবিত অন্য নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে ও হাদিসুরের মররদেহ তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে।
বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ইউক্রেনে নিহত হাদিসুর রহমানের পরিবারের পাশে আমরা দাঁড়িয়েছি। ইতিমধ্যে বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিহতের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করে যাচ্ছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইউরোপে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সাথে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলছে। হাদিসুরের মরদেহ তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা অব্যাহত আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা এই পরিবারের পাশে থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার চেষ্টা করছি।”
হাদিসুরের জায়গায় আতিকুরের ছবি প্রকাশ
এদিকে ইউক্রেনে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের নিহত নাবিক মো. হাদিসুর রহমানের ছবি হিসেবে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে আতিকুর রহমান মুন্না নামের আরেকজনের ছবি। এতে করে আতিকুরের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা বিচলিত হয়ে পড়েন।
বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে অবস্থানরত নাবিকদের একজন আতিকুর রহমান মুন্না। আতিকুরের গ্রামের বাড়ি পাবনা। তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে এই প্রতিবেদক। তবে দুর্বল ইন্টারনেটের কারণে কথা শেষ করা যায়নি। জানান, তিনি অক্ষত আছেন। তবে ভয় পেয়েছেন এই ঘটনায়।
এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আতিকুর তার ফেইসবুকে লিখেছিলেন, “আমি ভালো আছি, আমার জাহাজ নিরাপদে আছে এখন পর্যন্ত এবং ২ মাস এর খাবার পানি আছে আমাদের! দোয়া করবেন সবাই আমাদের জন্য!”