অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

নারী দিবস: বাংলাদেশের শোবিজের নারীরা যা ভাবছেন


বাংলাদেশের শোবিজ অঙ্গনের কয়েকজন তারকা।
বাংলাদেশের শোবিজ অঙ্গনের কয়েকজন তারকা।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবসকে ঘিরে সারাবিশ্বের নারীরা ক্ষমতায়ন ও সমতা নিয়ে কথা বলছেন, ভাবছেন বাংলাদেশের শোবিজ অঙ্গনের তারকারাও। নারী দিবসে নারীদের নিয়ে ভাবনার কথা বলেছেন তারা।

বিদ্যা সিনহা মিম

বিদ্যা সিনহা মিম লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০০৭ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন। একই বছরে হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত 'আমার আছে জল' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের শীর্ষ অভিনেত্রীদের একজন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়াতেও মিম তুমুল জনপ্রিয়। মিমকে ফেসবুকে অনুসরণ করে ৬৬ লাখ ব্যবহারকারী। ইনস্টাগ্রামে তার ভক্ত ৩২ লাখ।

বিদ্যা সিনহা মিম।
বিদ্যা সিনহা মিম।

নারীদের নানা বিষয় নিয়ে সোচ্চার তিনি। চলচ্চিত্রে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বললেন, "বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বলেন, নাটক বলেন আর ওয়েব সিরিজই বলেন- এখানে নারীকেন্দ্রিক গল্প খুবই কম হয়। এটা আসলে কেন হয় আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আমাদের আশেপাশের দেশগুলোতে নারীকেন্দ্রিক গল্পের কাজ হতে দেখি। কিন্তু আমাদের দেশেই এটা খুবই সীমিত। হয়তো বাণিজ্যিক কারণে ঝুঁকি আছে, কিংবা দর্শকেরা নেবে না এমন গল্প, এটা মনে করেন নির্মাতারা। নারীদের নিয়ে কথা বলতে গেলে বিশেষ করে মিডিয়ার নারীদের নিয়ে কথা বলতে গেলে এই বিষয়টা আমার মাথায় কাজ করে।"

তিনি আরও বলেন, "নারীদের কাজের জন্য আমাদের দেশের মিডিয়া এখন বেটার। অনেক পরিচ্ছন্ন। অন্তত আমি যেটা দেখেছি। তবে শোবিজে কাজ করা নিয়ে পারিবারিক একটা চাপ বা বিধি নিষেধ থাকে। যার ফলে অনেক মেধাবী (মানুষ) এখানে আসতে পারেন না। এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কিছু করা যায় কি না, সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। আমার পরিবার থেকে আমি অনেক সাপোর্ট পেয়েছি। আমি চাই আমার মতো মেয়েরা আসুক এখানে, পরিবারের সমর্থন পাক।"

শবনম ইয়াসমিন বুবলী

শবনম ইয়াসমিন বুবলী বাংলাদেশের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা। ২০১৬ সালে 'বসগিরি' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পে তার অভিষেক ঘটে। চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে তিনি শ্রেষ্ঠ নবীনশিল্পী বিভাগে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেন। সংবাদ পাঠিকা হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও এখন নায়িকা হিসেবে বাংলাদেশে তার বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। সমানতালে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়াতেও। বুবলীকে ফেসবুকে ৪০ লাখ ব্যবহারকারী অনুসরণ করেন আর ইনস্টাগ্রামে৩০ হাজার।

শবনম ইয়াসমিন বুবলী।
শবনম ইয়াসমিন বুবলী।

নারী দিবস নিয়ে বুবলী নিবিড়ভাবে চিন্তা করেন। ভয়েস অফ আমেরিকাকে বললেন, "আমি মনে করি এই ২০২২ সালে এসেও নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর সমতা হয়নি। নাহলে এখনো পত্রিকা খুললে আমরা কেন নিত্য দেখতে পাই ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, কন্যা শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনা? কেন এখনো ধর্ষণ নিয়মিত ঘটনা হয়েই রয়েছে? যতদিন পর্যন্ত ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে না, ততদিন পর্যন্ত এমন ঘটনা ঘটবেই। নারী দিবসের মতো একটা দিন যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রতিটি দিন হতে হবে সমান, নারীর প্রতি প্রতিদিনই যেন সম্মান থাকে।"

তিনি বলেন, "কর্মক্ষেত্রেও নারীরা নিপীড়িত হয় এখনো। হয়তো আমি মিডিয়ায় কাজ করি, আমি আমার বিষয়টাকে হ্যান্ডেল করতে পারি যার ফলে আমাকে হয়তো সেরকম ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি। আমি যখন সংবাদ পাঠক ছিলাম সেখানেও আমার কাজ মসৃণ ছিল। কিন্তু অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে নারীরা কি নিজেদের সবক্ষেত্রে হ্যান্ডেল করতে পারে? তবে আমি বিশ্বাস করি একদিন নারী পুরুষের সমতা আসবে। পুরুষদের সহযোগিতাও এক্ষেত্রে প্রয়োজন।"

আজমেরি হক বাঁধন
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অন্যতম আলোচিত অভিনেত্রী বাঁধন। কান চলচ্চিত্র উৎসবে তার অভিনীত 'রেহানা মরিয়ম নূর' চলচ্চিত্রটি অংশ নেয় এবং অভিনয়শিল্পী হিসেবে তিনি প্রশংসিত হন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের গণমাধ্যমেও তার অভিনয়ের প্রশংসা করা হয়। ২০০৬ সালে লাক্স চ্যানেল আই সুপার স্টার প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় রানার আপ হয়ে বাঁধন আলোচনায় আসেন। পেশাগত জীবনে তিনি একজন দন্ত চিকিৎসক। বাঁধন সোশ্যাল বেশ জনপ্রিয়। ফেসবুকে তাকে অনুসরণ করেন প্রায় ৪ লাখ ভক্ত ও ইনস্টাগ্রামে ১২ লাখ।
আজমেরি হক বাঁধন।
আজমেরি হক বাঁধন।
নারীর অধিকার বিষয়ে খুবই সচেতন এই অভিনেত্রী। বিভিন্ন সময়ে নারী অধিকার বিষয়ে বক্তব্যের কারণে তিনি আলোচনায় এসেছেন। নারী দিবসে ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হয়। বাঁধন বলেন, "নারীদের অধিকার বিষয়ে আমার খুব অল্পকিছুদিন আগে দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। ৩৪ বছর বয়স পর্যন্ত যা জেনে এসেছি, যা বুঝে এসেছি, আমাকে যা বোঝানো হয়েছে- কিন্তু আমি দেখলাম দৃশ্যপট অন্য। সমাজে নারীরা সবক্ষেত্রে বঞ্চিত। তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধর্মীয় কাঠামো সবখানেই নারীরা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত- এটা কেন? একটা মেয়ে যখন লড়াই করে তার অধিকার আদায় করতে সক্ষম তখন সমাজের অনেকেই তাকে বাহবা জানায়। আমি বলবো এই বাধা বা প্রতিবন্ধকতা কেন থাকবে? নারী দিবসের যে প্রেক্ষাপট সে ঘটনা অনুযায়ী নারী দিবসের প্রয়োজনীয়তা আছে। নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলা দরকার।"
বাঁধন আরও বলেন, "শুধু মিডিয়া কেন নারীরা পরিবারে হয়রানির শিকার হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছে। সর্বক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমি যখন ২০০৬ সালে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ৩ লাখ টাকা পাই সেটা আমার জীবনে বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। আমি বুঝতে পারছি যে নারী মুক্তির জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দরকার।"

জান্নাতুল পিয়া

জান্নাতুল পিয়া ২০০৭ সালে মিস বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় আসেন। জান্নাতুল একাধারে মডেল, র‍্যাম্প মডেল ও অভিনয়শিল্পী ও একজন আইনজীবী। অভিনয়ের চেয়ে মডেল হিসেবেই বেশি পরিচিত তিনি। সোজাসাপটা কথা বলার জন্য যেমন সমালোচনার শিকার হন, তেমনই নারীদের অনেকের কাছেই তিনি আইকন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও বেশ সরব তিনি। ফেসবুকে তাকে ১২ লাখ মানুষ অনুসরণ করেন আর ইনস্টাগ্রাম ১০ লাখ অনুসারী রয়েছে পিয়ার।

জান্নাতুল পিয়া।
জান্নাতুল পিয়া।

নারী দিবস নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকার কাছে নিজের মত ব্যক্ত করলেন এই বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই মডেল। তিনি বলেন, "নারী দিবসের প্রয়োজন আছে। নারীদের এখনো অনেক কথা বলতে হবে। কেননা এখনো নারীদের সমতা আসেনি। দেশের বড় বড় জায়গায় এখনো পুরুষেরাই বসে রয়েছে। তার মানে এই নয় যে সেখানে নারীরা বসতে পারবে না। আসলে নারীরা ফোকাস হয় না। নারীরা কোথায় পিছিয়ে পড়ে?"

জান্নাতুল পিয়া বলেন, "৩০ এর কোঠায় যখন সন্তান নেওয়া হয় তখন সন্তান লালনের ক্ষেত্রে একজন মাকে অনেক সময় দিতে হয়। এই সময়টাতেই একজন নারী পিছিয়ে যায়। আমি একটা কথা বলতে চাই- সেটা হলো নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করে। কেননা বাচ্চা সামলানো, পরিবার সামলানো একই সঙ্গে নিজের পেশাগত জায়গা সামলানো এটা কম কথা নয়। আমি বিশ্বাস করি, হয়তো এমন একটা সময় চলে আসবে, তখন ছেলেরা নারীদের সমকক্ষ স্থানে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে।"

দিলারা হানিফ পূর্ণিমা

পূর্ণিমা বাংলাদেশের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা। আসল নাম দিলারা হানিফ পূর্ণিমা। এই প্রজন্মের কাছে তিনি জনপ্রিয়। নবম শ্রেণিতে অধ্যনকালীন 'এ জীবন তোমার আমার' নামের একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ১৯৯৭ সালে তিনি ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখেন। ২০১০ সালে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও দারুণ জনপ্রিয় পূর্ণিমা। ফেসবুকে এক কোটির কাছাকাছি, মানে ৯৭ লাখ অনুসারী তাকে অনুসরণ করেন। ইনস্টাগ্রামে ২৮ লাখ ভক্ত রয়েছে তার।

দিলারা হানিফ পূর্ণিমা।
দিলারা হানিফ পূর্ণিমা।

নারী দিবসে ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে আলাপকালে বললেন, "আমরা যখন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে আসি তখন পথটা এতোটা মসৃণ ছিল না। পথে পথে বাধা ছিল। এক জায়গায় ফিক্সড থাকা যেত না। অনেকেই আসছে কিন্তু টিকে থাকতে পারছে না। নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে- এভাবে চলে যাচ্ছে। আমি লেগে ছিলাম। হয়তো লেগে ছিলাম বলেই আমি একটা সময় টিকে গিয়েছি। হয়তো অনেক ক্ষেত্রে ভাগ্যের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আসে। আমরা যে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমাদের সময়ে মানে আমাদের ক্যারিয়ার শুরুর সময়ে- সেই বিষয়টি এখন অনেকটাই নেই। বলতে গেলে এখন শোবিজের পথ অনেকটা মসৃণ।"

তিনি আরও বলেন, "আর তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের জীবনমান অনেক বেড়েছে বলে আমি মনে করি। এখন আর একজন নারীকে আটকে রাখার সুযোগ নেই। ফেসবুক বা বিভিন্ন লাইভ স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নারীদের অনেক এগিয়ে দিয়েছে। অনেকেই নারী উদ্যোক্তা হচ্ছে, কেউ আচার বানিয়ে ভিডিওতে দেখাচ্ছে, কেউ সালোয়ার কামিজ ডিজাইন করে ভিডিওতে দেখাচ্ছে সেসব অনেকেই কিনে নিচ্ছে। কেউ ভ্লগ বানিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়ে যাচ্ছে।"

পূর্ণিমা বলেন, "একটা মজার বিষয় বলি, এটা শুধু মজারই নয়, আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি। ৪ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার দীপ্ত টেলিভিশনের একটা অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে গিয়েছি। সেখানে অ্যাওয়ার্ড পেলেন শ্রেষ্ঠ মৎস চাষী, শ্রেষ্ঠ ফুলচাষী- আমি নিজেও জানতাম না নারীরা কৃষিক্ষত্রেও এগিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের নারীদের কাজকে এখন স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারী ক্রিকেটার, নারী পুলিশ, চিকিৎসক এরইকম প্রায় প্রতিটি সেক্টরের নারীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। এটা ইতিবাচক, আমি পেয়েছি- আমি অনুধাবন করতে পারি।"

XS
SM
MD
LG