অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত: যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণের প্রতিক্রিয়া


প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরাও হয়রানি ও নির্যাতনের ভয়ে সরকারের সমালোচনা থেকে নিজেদের অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্র এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের সদস্যদের স্বাধীনতার যে বিধান রয়েছে তা দেশটির সরকার প্রায়ই লঙ্ঘন করেছে বলে বলা হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো উচ্চকণ্ঠ হলেও তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে দেশটির সরকার। অনলাইন এবং অফলাইন উভয় মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। এছাড়া হয়রানি ও প্রতিশোধের ভয়ে গণমাধ্যমের সদস্যরা এবং স্বাধীন ব্লগাররা সরকারের বিরুদ্ধে তাদের সমালোচনাকে ‘স্ব-সেন্সর’ করে।


যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২০২১ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস প্রকাশ করেছে। ২০২১ সালের বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়নে তৈরি হয়েছে ‘২০২১: কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’। বিশ্বের ১৯০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে এ রিপোর্ট প্রকাশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ বিষয়ক মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ চলাকালে বাংলাদেশ সরকার মহামারী মোকাবেলায় সরকারের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলাসহ সরকারের সমালোচনাকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার করেছে। আইনটি দেশের বাইরে বসবাসকারী মন্তব্যকারীদেরসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ওয়েবসাইট এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পাওয়া বক্তব্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারী পরিচালনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতির অভাবের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদনের পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।

মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যম ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে ২,৪৫০টি বিচারাধীন মামলা রয়েছে। ওই সময় পর্যন্ত একটি মামলার রায় হয়েছে। গত বছরের ২ মার্চ, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বলেছিলেন, সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা করার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনও সংশোধন করা হয়নি বলেও উল্লেখ করা হয়নি।

একই বছরের ২৫ জুলাই, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর ২৪-পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে লেখক মুশতাক আহমেদ এবং কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের কথা বলা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে ২০১৮ সালে আইনটি প্রণীত হওয়ার পর থেকে ১,৩০০ জনেরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাগুলির মধ্যে ৮০ শতাংশ আইন প্রণেতা, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য বা আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের দ্বারা দায়ের করা হয়েছিল। সব ক্ষেত্রেই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদদের সমালোচনামূলক পোস্ট প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়েছে। রিপোর্টে বাংলাদেশ কারা অধিদফতরের বরাতে বলা হয়েছে, জুলাই মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৩৩ জনকে এই মামলায় বন্দী করা হয়েছে। অনলাইনে আপত্তিকর এবং মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করার অভিযোগে এই ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ১৮৫ জনকে আটক করা হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর, মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র রিপোর্ট করেছে যে অন্তত ২১০ জন সাংবাদিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে দায়ের করা মামলাসহ হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন, হামলা, হুমকি এবং মামলার সম্মুখীন হয়েছেন। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বছরে কমপক্ষে ১,১৩৪টি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা ছিল।

সরকার দেশের পাবলিক টেলিভিশন স্টেশনের উপর সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল বলে আমেরিকার মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে।

প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশে বাক স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত, সাংবাদিকদের ওপর চাপ ও ভীতি প্রয়োগসহ যেসব বিষয়ে আমেরিকার মানবাধিকার রিপোর্টে উঠে এসেছে তা নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে মতামত ও প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগ করা হয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সম্পাদক, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে।

মাহফুজ আনাম।
মাহফুজ আনাম।

মাহফুজ আনাম

সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বর্তমান অবস্থা এর চেহারার দিকে তাকালেই বুঝা যায়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা অধিকার এসব বিষয়ে আমরা প্রতিনিয়ত কথা বলি। তাই আলাদা করে বলার কিছু নেই। বিবেকবানরা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে চোখ রাখলেই বুঝতে পারবেন।

আর রাজী

সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আর রাজী।
আর রাজী।

কথা বলার অধিকার বা বাক স্বাধীনতা এটাতো সাধারণের অধিকার। বিষয়টা এমন নয় যে, সাংবাদিকদের আলাদা করে সুযোগ দিতে হবে। সাধারণ মানুষ হিসেবে যে অধিকার সেটুকু পাওয়া যায় কিনা, সেটা দেখতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে সংকুচিত হয়ে আসছে এটাতো আমরা আমাদের দৈনন্দিন বা প্রত্যহিক অভ্যাসে ও আচরণেই টের পাই। এখন এটার প্রভাব সাংবাদিতায় পড়েছে। পড়াটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিকতার কাছে আমাদের যে প্রত্যাশা সেটা আমরা বিবেচনা করি, সাংবাদিকতা গণতন্ত্রকে সহায়তা করে, গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু আমরা যখন দেখি আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা, নির্বাচন পদ্ধতি নিম্নগতি বা মান নিম্নমুখী তখন আমরা সাংবাদিকতাকে দেখি গণতন্ত্রের সুরক্ষা দিতে পারছে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাথে মানুষের বাকস্বাধীনতার, মানুষের মতপ্রকাশের বা ভোটাধিকারের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যখন ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হবে তখন মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও ক্ষয়িষ্ণু হবে। আর সাধারণের মতপ্রকাশের অধিকার যখন খর্ব হয়ে যায় সেখানে স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকতার ক্ষেত্রও কমে আসে।

ড. কাবেরী গায়েন

অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. কাবেরী গায়েন।
ড. কাবেরী গায়েন।

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে আসছে-এমন একটা আলোচনা যখন সামনে চলে আসে, তখন বিষয়টি সহজভাবে বলা কঠিন। আমাদের দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়টা আগে গণমাধ্যমগুলোকেই বুঝতে হবে। বাংলাদেশে ‘মুক্ত গণমাধ্যম’ বিষয়টি কোনো অর্থ বহন করে না। এখানে সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সর্ড। যে গুটিকয়েক সাংবাদিক এই পরিস্থিতির বাইরে থেকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে সাংবাদিকতা করতে চান, তারা নানা হয়রানির শিকার হন। তাদের নিয়ন্ত্রণের যে প্রক্রিয়া সেটি তাকে সাহসী হতে বাধা দেয়। সাংবাদিকতার বিনিময়ে কিছু প্রত্যাশা করলে সঠিক সাংবাদিকতা করা যায় না। সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্তরা যখন কোনো কিছু প্রত্যাশা করেন, নানা হিসাব-নিকাশের মধ্যে পড়ে যান, তখন তিনি মুক্ত সাংবাদিকতা করতে পারবেন না। এটাও বাংলাদেশে সাংবাদিকতার সমস্যা। তাই স্বাধীন সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়ছে যখন আলোচনা হয় তখন বিষয়টি নিয়ে আরও ভাবা দরকার। আবার নানা ধরনের আইন করেও গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়ে। ২০০৬ সালে যখন যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন করা হয়েছিল তখনই কিন্তু সবাই এটার প্রতিবাদ করেছিল। ২০১৩ সালে এটা সংশোধন করে শাস্তির মাত্রা আরো কঠোর করা হয়েছিল। আবার ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ হয়েছে। ২০১৮ সালে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া হয় তখন ওই ৫৭ ধারাই নানাভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হলো। তখন সম্পাদক পরিষদ, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বা টিভি মালিকদের সংগঠন এটার প্রতিবাদ করেছিল। দেশে মেইনস্ট্রিমের সাংবাদিকেরা অনেক ভালো কাজও যেমন করছেন আবার কিছু বিষয় আছে বলতেই হয়। যেমন- প্রধানমন্ত্রী যখন সাংবাদিক সম্মেলন করেন তখন সাংবাদিকেরা কী ধরনের প্রশ্ন করেন? তাদের প্রশ্ন করার ধরন দেখলেই বোঝা যায়, সাংবাদিকেরা তাদের জায়গা থেকে প্রশ্নটা করছেন না। এত নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও কেউ যদি একটু বিরুদ্ধ মতের কথা বলেন বা কেউ যদি ক্ষমতাসীনদের অপকর্মের কথা বলেন তাহলে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। মামলা দেওয়া হচ্ছে। হাইকোর্ট কিন্তু সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ও ৩১ ধারা কেন সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা হবে না। এই দুটি ধারায় যা বলা আছে, তা যদি কেউ মানে তাহলে তার পক্ষে আর কোন নিউজ করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের ইতিহাস যদি দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে যখনই কোন স্পেশাল আইন করা হয় সেটা মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করার জন্যই করা হয়। সেখানে সাংবাদিকতা পেশার জন্য আলাদা করে আর রুদ্ধ করার দরকার হয় না।

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান
সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে গেলে সবার আগে বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে হবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিরোনামের মূল কেন্দ্রবিন্দু। বঙ্গবন্ধু এবং গণমাধ্যম ছিল একে অপরের পরিপূরক। এখন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে যখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই বলে তখন তাদের স্মরণ করা উচিৎ বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। এখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ পরিচালনা করছেন। এখন এই সময়ে এসে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়ছে যারা বলছেন, তারা পঁচাত্তরের পরের সময়কার কথা মনে করলেই দেখতে পাবেন, তখন কী অবস্থা ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর কালো আইন করা হয়েছিল, খুনিদের রক্ষা করতে। সেই বাংলাদেশ এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। দেশে গণমাধ্যম অতীতের চেয়ে অধিক স্বাধীনতা ভোগ করছে। গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিলে সরকারেরই সুবিধা। তাই গণমাধ্যম এবং সরকারকে মুখোমুখি বিবেচনা করা উচিৎ হবে না।

XS
SM
MD
LG