সম্প্রতি বাংলাদেশের সরকার বোতলজাত ও খোলা সয়াবিনের মূল্য নতুনভাবে নির্ধারণ করেছে। নতুন নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকা ও খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। পাশাপাশি ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮৫ টাকা। প্রতি লিটার পাম তেল ১৭২ টাকা নির্ধারিত হয়েছে।
পরিবর্তিত এই নতুন দাম অনুযায়ী, বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতে লিটারপ্রতি ৩৮ টাকা এবং খোলা তেল লিটারপ্রতি ৪৪ টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে। রমজানের আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা এবং খোলা তেল ১৩৬ টাকা নির্ধারণ করেছিল। পাশাপাশি ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৭৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় আরেক দফা দাম বাড়ানো হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
তবে এই নতুন দাম নির্ধারিত হওয়ার বেশকিছুদিন আগে থেকেই বাজারে সয়াবিন তেলসহ ভোজ্যতেলের সংকট দেখা গিয়েছে। এখন এই পরিবর্তিত নতুন দাম নির্ধারণের পরেও বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। আবার দোকানিদেরও নতুন দামে তেল বিক্রিতে অনীহা দেখা যাচ্ছে। বাজারে তেলের সরবরাহ, বাজারদর জানতে ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে রাজধানী ঢাকার বেশ কয়েকটি বাজারে যাই। সেখানে তেল সরবরাহকারী, বিক্রেতা ও ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে ভোজ্যতেলের বর্তমান অবস্থা জানতে চেষ্টা করি। মিরপুর, কারওয়ানবাজার, হাতিরপুল বাজার ঘুরে দেখা যায় এলাকা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দাম। যে যেভাবে পারছেন অতিরিক্ত দামে তেল বিক্রি করছেন। আবার অনেক দোকানিকে দেখা গেল তেল বিক্রিতে অনীহা।
মিরপুরের বাজার
মঙ্গলবার সকালে প্রথমে যাই মিরপুরের ছয় নম্বর বাজারে। সেখানে বেশ কয়েকটি দোকান ঘুরে বোতলজাত সয়াবিন তেল দেখা গেল না। আনোয়ার নামের নামের এক ব্যবসায়ীর দোকানে দেখা এক গ্যালনে অল্প পরিমাণ সয়াবিন। পাশেই আরেকটি গ্যালনে সরিষার তেল। সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে প্রথমে কথা বলতে চাইলেন না। পরে বললেন, “সাংবাদিকরা তো আসল কথা কইতে পারে না। বাজারে কারা তেল নাই কইরা দিল, তাদের নাম তো আপনারা ল্যাখেন না।” কারা বাজারে তেল নাই করে দিল, এবার জানতে চাই তার কাছে। তিনি প্রথমে হাসলেন। পরে বললেন, “আমরা তো ব্যবসায়ী। আমরা ছোট দোকানদার। আমরা তো তেল আমদানী করি না। কারখানাও নাই আমাদের। কারখানার মালিকরা আর ডিলাররা যদি তেল না ছাড়ে, তাইলে আমরা তেল পামু কই?” বোতলজাত তেল তার দোকানে নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখন সরকার যেই নতুন দাম ঠিক করছে, ওইদাম বোতলে এখন লাগানো অয় নাই। বোতলে নতুন দাম লাগাাইতে সময় লাগবে। দুই একদিনের মধ্যেই চলে আইবো।”
এখানেই কথা হয় বাজার করতে আসা রেজাউল করিমের (৫৬) সঙ্গে। বেসরকারি চাকরিজীবী রেজাউল জানালেন, ঈদের ছুটির পর বাজার করতে এসেছেন। মাছ ও সবজি কিনতে পারলেও তেল কিনতে পারেননি এখনও। তিনি বলেন, “আগে রূপচাঁদার ৫ লিটারের বোতল কিনতাম। এখন আজকে বাজারে তা পাচ্ছি না। গতকালও পাইনি। কিন্তু আজকে তেল না নিয়ে বাসায় যাওয়া যাবে না। বোতল না পেলে এখন খোলা তেল কিনেই নিতে হবে। কিন্তু খোলা কিনে বাসায় নিতে হলেও তো একটি বোতল লাগবে। দেখি কী করা যায়।” বলেই তিনি সামনে চলে গেলেন।
মিরপুর ৬ নম্বর বাজার থেকে যাই রূপনগর বাজারে। রূপনগর বাজারেই কথা হয় সারোয়ার আলম (৪২) এর সাথে। একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি। বললেন, মাসের প্রথম দিকে পুরো মাসের বাজার করেন তিনি। এবার ঈদ থাকায় চলতি মাসের শুরুতে মাসের বাজার করেননি। বললেন, “ঈদের ছুটির মধ্যেই যখন প্রথমে সয়াবিন তেল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না শুনলাম তখন ভেবেছিলাম গুজব হবে। ঈদের পরে দেখলাম দোকানে আর তেলই পাওয়া যায় না।”
হাতিরপুল বাজারের চিত্র
হাতিরপুল বাজারে যখন আসি তখন বেলা প্রায় বারোটা। মঙ্গলবার এই অঞ্চলের সাপ্তাহিক ছুটি হওয়ায় লোকজনের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। সবজি ও মাছের বাজারের দিকে ভিড় থাকলেও মুদি দোকানে তেমন ভিড় দেখা গেল না। এখানেই কথা হয় কানিজ ফাতেমা (৩৫) নামের একজনের সাথে। এই গৃহিণী জানালেন, স্বামী গাউছিয়া মার্কেটে ব্যবসা করেন। তাকেই বাজার করতে হয়। তেলের দাম নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি দিলেন ভিন্ন তথ্য। বললেন, “আমরা সবসময়ই সরিষার তেল ব্যবহার করি রান্নায়। তাই বাজারে তেলের উপস্থিতি নিয়ে আমাদের ভাবতে হয় না। ” কোথা থেকে তেল সংগ্রহ করেন জানতে চাইলে বললেন, “এ্যলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যাল মোড় থেকে ঘানিতে ভাঙানো তেল কিনি। সবসময় ওখান থেকেই তেল কিনি। তেলের কোয়ালিটি এবং দাম নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। তবে গত কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি তেল কিনতে মানুষের লাইন পড়ে যাচ্ছে বাটা সিগন্যালে।”
এই গৃহবধূর সঙ্গে যখন আলাপ করছিলাম তখন পাশে এসে দাঁড়ান এক তরুণ। পরিচয় দিয়ে আলাপ করতে চাইলে তিনি বললেন, সিটি গ্রুপে চাকরি করেন। বাজারে বাজারে গিয়ে অর্ডার সংগ্রহ করেন। সেই মোতাবেক দোকানিদের মালামাল সরবরাহ করা হয়। তেলের সরবরাহ কেমন জানতে চাইলে নিজের নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে বললেন, “এখন পর্যন্ত নতুন দামের তেল সরবরাহ শুরু হয়নি। একদিন/ দুইদিনের মধ্যেই শুরু হবে। প্রথমে ৫ লিটার ছাড়া হবে। পরে ধীরে ধীরে এক লিটার বা দুই লিটার। নতুন দামের বোতল প্রস্তুত করতে সময় লাগায় বাজারজাত করতে দেরি হচ্ছে। তেলের কোনো কমতি নাই।”
একটু সামনে এগিয়ে কথা হয় দোকানি লিটনের (৪৬) সঙ্গে। দোকানে তেল নেই কেন প্রশ্ন করতেই কিছুটা রাগ হয়ে বললেন, “তেল নেই ক্যান, এই কথা আমাদের কেন জিগাইতেছেন? সরকারের কাছে গিয়া জিগান। তেল আনে কারা? বন্ধ করে কারা? আবার নতুন নাটক হইছে ভ্রাম্যমাণ আদালত আসে। ভ্রাম্যমাণ আদালত আমাদের এখানে আসে কেন? যাবে কারখানায়। সেখানে তারা তেল মজুত করে রাখলে আমরা তেল পাব কই? কারখানায় না গিয়া আমাগো মতো ছোট ছোট ব্যবসায়ীগো লগে খুব পারে!” বলেই ক্ষোভ ঝারলেন তিনি। কিছুটা সময় দিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম, তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে কবে? এইবার তিনি বেশ সময় নিয়ে ধীরে বললেন, “ধরেন, বাজার থেকে পলিথিন কাগজ সরকার তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিছে। তারপরেও দেখবেন কয়দিন পরপর ভ্রাম্যমাণ আদালত মার্কেটে মার্কেটে গিয়ে পলিথিন উদ্ধার করে। এখন কথা হইছে, এইভাবে মার্কেটে গিয়ে অভিযান করে পলিথিনের কারখানাগুলো সিলগালা করে দিলেই তো ভালো হয়। এইটা কিন্তু করে না। কেন করে না? করে না, কারণ, কারাখানা বন্ধ করার ক্ষমতা নাই। এখন তেলের ব্যাপারেও একই কারবার চলতেছে। মিল মালিকদের কিছু করতে পারে না। আসছে খুচরা ব্যবসায়ীদের ধরতে!”
কারওয়ান বাজার
কারওয়ান বাজার ঢাকার অন্যতম বড় পাইকারী বাজার। মঙ্গলবার যখন এখানকার পাইকারী বাজারে প্রবেশ করি তখন বিকেল হয়ে এসেছে। বৃষ্টির পানি ও কাদায় মাখামাখি অবস্থা। দোকানগুলোতে ভিড় কম। কথা হয় ব্যবসায়ী মিজানের সঙ্গে। এখানে প্রায় ১৫ বছর যাবৎ ব্যবসা করেন। দোকানে সয়াবিন তেলের দেখা মিলল না। তার কাছে জানতে চাই, দোকানে কোনো তেলের মজুত আছে কিনা? মিজান বলেন, তেল পাবো কই! ঈদের আগেই সব শেষ। এই ব্যবসায়ীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পরেও তেল সংকট কেন? তিনি বলেন, “সব সিন্ডিকেট। এর বেশি বলা যাবে না।” কীসের সিন্ডিকেট জানতে চাইলে হাসলেন। তারপর বললেন, “এই দামে অইবো না। দাম আরও বাড়বো। দেইখেন।”
এখানেই কথা হয় শাহ আলম নামে দোকানির সঙ্গে। অল্প কয়েকটি বোতল তেল দেখা গেল। পরিচয় গোপণ করে তার কাছে তেলের দাম জানতে চাই। বললেন, বোতলের গায়ে যা লেখা আছে তার চেয়ে ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে। দাম কমানোর অনুরোধ জানালে ১০ টাকা কমাতে রাজি হলেন। তখন তাকে বললাম, বোতলের গায়ের দামেই বিক্রি করেন। তিনি বললেন, “এই কথা ভুলে যান। এই দামে আর তেল চোখে দেখা লাগবে না।”
কারওয়ান বাজারের দ্বিতীয় তলায় কথা হয় আরেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। নিজের নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে তিনি বললেন, “এখানে অনেকদিন ব্যবসা করি। ব্যবসা করে পরিবার নিয়ে চলতে অয়। তাই ঝামেলায় পড়তে চাই না। তয় আপনারে কই হোনেন (শোনেন), এখন বাজারে বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত না গিয়ে কারখানায় যাইতে কন। আপনারা পেপারে ওইখানে যাওয়ার খবর ল্যাখেন। ওইখানে দেখেন, তেলের কোনো কমতি নাই। সব দাম বাড়ার আশায় সাপ্লাই বন্ধ রাখছে। ধরেন, একজনের কাছে ৫০ হাজার লিটার মজুদ আছে। যেগুলো আগের দামে কেনা। এখন যদি সেগুলো সব বিক্রি করে বাড়তি দামে তাইলে কতো লাভ অইবো? লিটারে ৪০টাকার বেশি দাম বাড়ছে প্রায়। এইভাবে বড়লোক ব্যবসায়ীরা আরও বড়লোক অইতেছে। আর কিছু কইতে চাই না। বাণিজ্যমন্ত্রীরে গিয়া জিগান, আসল জবাব তার কাছে।”