২০১৮ সাল ছিল বাংলাদেশের জন্য ঘটনা বহুল একটি বছর যার মুল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একাদশ জাতিয় সংসদ নির্বাচন ।
৩০ শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লিগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে পর পর তিন দফা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। নির্বাচনকে ঘিরে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী এবং বর্ষীয়ান রাজনিতিক ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নির্বাচনের মাত্র আড়াই মাস আগে গঠিত হয় বিএনপি, গণফোরামসহ ৫ দলের জোট জাতিয় ঐক্য ফ্রন্ট । তবে নির্বাচনের স্বল্প সময় আগে গঠিত এই সরকার বিরোধী জোট শুধু দেশেই নয় বিশ্ব ব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করলেও নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরন করে । ঐক্য ফ্রন্ট অবশ্য নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষে সরকারের অধীনে পুনঃ নির্বাচনের দাবি জানায়। (Actuality)। তবে নির্বাচন কমিশন ঐক্য ফ্রন্টের এ দাবি নাকচ করে দিয়েছে ।
২০১৮ সালে বাংলাদেশে অন্য যে সকল গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে অন্যতম ছিল সরকারি চাকুরীতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন। দেশব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সরকার প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী চাকুরীতে কোটা পদ্ধতির অবসান ঘটায়। বছরটিতে আরেকটি গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনা ছিল একটি সড়ক দুর্ঘটনায় রাজধানী ঢাকায় দুইজন স্কুল শিক্ষার্থীর নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে দেশ ব্যাপী স্কুল শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন। স্কুল শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের প্রতি দেশের সকল স্তরের মানুষ সমর্থন প্রদান করে। তাঁদের এ আন্দোলন বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশিত এবং প্রচারিত হয়। তবে আন্দোলনের এক পর্যায়ে ঢাকায় সন্ত্রাসীদের আক্রমণের স্বীকার হন আন্দোলনরত শিশু কিশোররা। পরে সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে তাঁরা ঘরে ফিরে যায়।
এ বছরের বহুল আলোচিত-সমালোচিত বিষয় ছিল জাতিয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশের ঘটনা। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সম্পাদক, সাংবাদিক, বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ, সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন সমূহ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসমুহ এবং সর্বোপরি জাতিসংঘ বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মানুষের বাক স্বাধীনতার ওপর এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এমন উদ্বেগ এবং আশংকা প্রকাশ করে এর বিশেষ কয়েকটি ধারা বাদ দেয়ার আহ্বান জানালেও তা উপেক্ষা করে আইনটি পাশ করা হয়।
বছরটিতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা দেশ সমূহ এবং দেশ বিদেশের মানবাধিকার সংস্থা সমূহ সারা বছর তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে। খোদ জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
২০১৮ সালে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দুইটি পৃথক দুর্নীতির মামলায় আদালত ১০ বছর করে ২০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছে এবং তিনি জেলে বর্তমানে ওই সাজা ভোগ করছেন। ২০০৪ সালের ২৫ শে আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হয়েছে ২০১৮ সালে। রায়ে ওই মামলায় ৩৮ জন আসামির মধ্যে তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুতফুজ্জমান বাবর সহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং এব লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সহ ১৭ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
বছরটিতে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশ কিছু অর্জন থাকলেও খাতটি ব্যাপক ভাবে সমালোচিতও হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৭.৮ শতাংশের ওপর অর্জিত হলেও বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন এবং বেসরকারি ব্যাংক থেকে ব্যাপক হারে অর্থ লোপাট এবং একই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা পাচারেরও অভিযোগ উঠে। এবছর বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একই সাথে আয় বৈষম্যও বেড়েছে।
তবে সামাজিক খাতের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অগ্রগতির সুচকে ছিল সন্তোষ জনক। বছরটিতে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের অর্জনও ছিল লক্ষণীয় যখন স্বাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৩ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতের অর্জন ছিল উল্লেখযোগ্য যার ফলে দেশের মানুষের গড় আয়ু বেঁড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ বছরের ওপর কৃষি এবং মৎস্য খাতের অর্জনও ছিল লক্ষণীয়। ২০১৮ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্প উন্নত দেশ থেকে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।