অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

খল অভিনেতা নিরঞ্জনের গল্প


নিরঞ্জন সরকার। (ছবি: মাহতাব হোসেন)
নিরঞ্জন সরকার। (ছবি: মাহতাব হোসেন)

এক হাজারের বেশি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন নিরঞ্জন সরকার। চলচ্চিত্রের সবাই তাকে “নিরঞ্জন পাশা” নামেই চেনে। খল অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি পেলেও মূলত তিনি একজন “ফাইটার”। ছোটখাটো নেতিবাচক চরিত্রেও তাকে চলচ্চিত্রে দেখা যায়। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সংখ্যাটা হাজার পেরোলেও ভাগ্যকে তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। রঙিন দুনিয়া বিচরণ করা এই শিল্পীর জীবনের অনেক বাঁকেই রয়েছে অন্ধকার আর আক্ষেপের গল্প।

প্রথম জীবনের কথা

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের মেকাইল গ্রামে আগুন লাগিয়ে দিলে চারজন হিন্দু শহীদ হন। তার মধ্যে একজন ছিলেন নিরঞ্জনের বাবা নিশিকান্ত। চার সন্তান নিয়ে মা সদাশী মন্ডল বেকায়দায় পড়েন। জমি চাষ, খালবিলের শাকসবজি বিক্রি করে সংসার টেনে নিচ্ছিলেন।

বড়বোনের পরেই নিরঞ্জন। তাই দায়িত্ব তার কাঁধেও এসে পড়ে। ১৯৭৫ সালে ১৬ বছর বয়সে খালাতো ভাইয়ের মাধ্যমে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে মোটর পার্টসের দোকানে কাজ শুরু করেন। কাজ খুব সহজেই রপ্ত করে নিলে ১৯৭৯ সালে জুরাইনের ইউসুফ আলী নামের এক ব্যক্তি নিরঞ্জনকে ডেকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি ছোট মোটর পার্টসের কারখানা করে দেন। থাকতে দেন তার বাসায়। শর্ত একটাই ওই কারখানা থেকে যা আয় হবে-তার অর্ধেক মালিককে দিতে হবে। নিরঞ্জনের জীবনে অল্প কিছুদিনেই স্বচ্ছলতা আসে। পরিবারের পুরো হাল ধরেন নিরঞ্জন।

চলচ্চিত্রের রঙিন দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ

এক সময় কাজের ফাঁকে প্রচুর সিনেমা দেখতেন নিরঞ্জন। সুযোগ পেলেই সিনেমা হলে চলে যেতেন। যাত্রাবাড়ীতে মোটর পার্টসের দোকানে কাজ করার সময়ই খেয়াল করতেন চলচ্চিত্রের রঙিন দুনিয়া তাকে আকর্ষণ করছে। পুরান ঢাকার নর্থ ব্রুক হল রোডে খ্যাতনামা নির্মাতা নারায়ণ ঘোষ মিতার অফিস ছিল। খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে সেখানে চলে যেতেন। দেখতেন চলচ্চিত্রের অনেকেই সেখানে আসছেন, যাচ্ছেন। যাদের দেখা যেত পর্দায়।

নিরঞ্জন বলেন, “আমি ফিল্মের লোকগুলারে দেইখা অবাক হইতাম। মনে মনে কইতাম আমি যদি ফিল্মে চান্স পাইতাম, তাহলে কত ভালোই হইতো।”

সেই সুযোগ চলে এল কিছুদিন পর।

যেভাবে চলচ্চিত্রে

মোটর পার্টসের কারখানা চালানোর সময়, মালিকের ছেলে মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় হয়। নিরঞ্জন দেখতেন মাহমুদ কারাতে প্র্যাকটিস করছেন। মাঝে মধ্যে তাকে ডেকে তার সঙ্গে শরীর চর্চা করতেন। পরে জানতে পারলেন, মাহমুদ ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমের কারাতে একাডেমিতে ভর্তি হয়েছেন।

নিরঞ্জন বলেন, “আমি যখন জানতে পারলাম মাহমুদ ভাই কারাতে শিখতে যায়, আমিও তাকে বলি আমাকে সঙ্গে নিতে। তিনি নিয়ে গেলেন। ঢাকার টিপু সুলতান রোডে, কারাতে শিখি আর বাকি সময় কারখানায় কাজ করি। সেখানে রুবেল ভাইয়ের (অভিনেতা মাসুম পারভেজ রুবেল) সঙ্গে পরিচয় হলো। রুবেল ভাই বলল মনোযোগ দিয়ে কারাতে শিখতে। বলল, আমি যদি নায়ক হই তাইলে তোরেও অভিনয়ে নিমু। রুবেল ভাই ব্ল্যাক বেল্ট পাইল। তারপরে সিনেমায় ঢুকল। আমিও একদিন সুযোগ পাইলাম। সেটা ১৯৮৪ সালে। তালাচাবি ছবিতে অভিনয় করলাম। এরপরে “পয়সা পয়সা”, “দশ গ্রামের মোড়ল”, এইভাবে এক বছরেই অনেক কয়েকটা ছবিতে কাজ করলাম। ধীরে ধীরে আমি মোটর পার্টসের কাজ বাদ দিয়া অভিনয়ে ঢুইকা গেলাম। তারপর তো চলতেছে।”

চলচ্চিত্রে তার চরিত্র

চলচ্চিত্রে খল অভিনেতা হিসেবে পরিচয় থাকলেও আসলে তিনি কোন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেন, জানতে চাওয়া হয়েছিল নিরঞ্জনের কাছে। জানালেন মূলত নায়ক–নায়িকা বা চলচ্চিত্রের মূখ্য চরিত্রগুলোর বিপরীতে নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে তিনি হাজির হন।

নিরঞ্জন বলেন, “আমি মূলত ফাইটার। আমাগোরে ফাইটার হিসাবে কাস্ট করা হয়। এরপর যেই কাজ দেয় সেইটা আমরা করি। ধরেন, কোনো নায়িকারে উঠায়ে নিয়ে আসতে হইব, কোনো নায়িকারে নির্যাতন করতে হইব। নায়করে ধইরা ঠ্যাঙ ভাইঙ্গা দিতে হইব, মাইরা আহত করতে হইব, আবার মাইর খাইয়া নিজেও মইরা যাইতে হইব, এইসব চরিত্র আমি করি।”

“আমার চোখ দুইটারে সবাই ডরায়। আমি যখন কাউরে ধইরা আনতে যাই তহন আমার চোখ দুইটা বড় বড় কইরা ফেলি। এই জন্য আমারে অনেকে বাংলার অমরেশপুরী কয়।”

নেতিবাচক চরিত্র করতে গিয়ে যত ঘটনা

পর্দায় অনেক কিছুই দেখা যায়, কিন্তু নেপথ্যের গল্পটা হয়তো জানা হয়ে ওঠে না কারও। এমন কিছু গল্পই জানালেন নিরঞ্জন। শহীদুল আলম খোকনের “মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা” চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়ে শাবানার সঙ্গে ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা।

সেই ঘটনা উল্লেখ করে নিরঞ্জন বলেন, “শাবানা আপারে বাইন্দা রাখছে। আমারে চাবুক দিয়া মারতে কইছে ডিরেক্টার। আমি সত্য সত্যই চাবুক দিয়া মাইরা দিছি। ক্যামেরা বন্ধ করার পর দেখা গেল শাবানা আপার পিঠে অনেকগুলা চাবুকের দাগ, লাল হইয়া গ্যাছে। খোকন ভাই আমারে ডাইকা ধমক দিব, এইসময় শাবানা আপায় কইল, ‘থাক ওরে কিছু বলবেন না। ও এই কাজ করছে দেখেই আমি সত্যিকার অভিনয়টা করতে পেরেছি।’ আব্দুল্লাহ আল মামুনের দমকা ছবির সেটে ফেরদৌসী মজুমদার ম্যাডামের শাড়ি খুলে নিতে হয়। একবার-দুইবার এভাবে ১১ বার চেষ্টা করে পারি না। আপারে আমি শ্রদ্ধা করি। আপায় রাগ দেখায়ে কইলেন, ‘নিরঞ্জন তোমার জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করো।’ ১২ বারের বেলায় পারলাম।”

নিরঞ্জন বলেন, “একবার জসিম ভাই কইল, ‘আমারে তুমি দুইটা ঘুষি দিবা, তারপর আমি যা করব তুমি সেরকম অভিনয় করে যাবা।’ আমি জসিম ভাইরে দুইটা ঘুষা মারছি আর সাথে সাথে জসিম ভাই আমার চুলের মুঠি ধইরা আমারে আছাড় মারছে। ক্যামেরা বন্ধ হওয়ার পর জসিম ভাই কইল, ‘লাগছে? কিছু মনে করো না। এই দৃশ্য তোমাকে পরিচিতি দেবে।’ অভিসার সিনেমা হলে ছবি দেখতে গিয়া দেখলাম এই দৃশ্যের সময় হলভর্তি দর্শক তালি দিতাছে, আর থামে না। কক্সবাজারে ‘ঘৃণা’ ছবির শুটিং করতে গিয়া আমার গলায় সাপ দিয়া দিছে। যেই ভয় পাইছি, লাখ টাকা দিলেও এমন কাজ আর করমু না।”

“আরেকটা ঘটনা, তখন অভিনয় নতুন শুরু করছি, আমাগো গ্রামের পাশে আটিবাজারে সিনেমা হল হইছে। সেই হলে আমার মায়রে (মা) এলাকার মানুষজন আমার অভিনয় করা ছবি দেখাতে নিয়া গেছে। ৮৬ সালের ঘটনা। সেই ছবিতে আমার পেটে চাকু ঢুকায়ে দেয়, আমি মইরা যাই। হলে আমার মা চিৎকার দিয়া কান্নাকাটি শুরু কইরা দেয়। মনে করছে, আমি সত্যিই মইরা গেছি। পরেরদিন ঢাকা থিকা আমি বাড়ি গিয়া মায়রে সান্ত্বনা দিছি।”

চলচ্চিত্রের সুখময় স্মৃতি

চলচ্চিত্র নিরঞ্জনকে অর্থনৈতিক সফলতা দিতে না পারলেও অনেক সুখময় স্মৃতি উপহার দিয়েছে। বাকি জীবনে তার আর তেমন কিছু পাওয়ার আগ্রহও নেই। যেভাবে জীবন চলছে সেভাবেই একটি জীবন পার করে দিতে পারেন।

নিরঞ্জন বলেন, “আগে এফডিসি জমজমাট ছিল। হুমায়ূন ফরিদী ভাই আমারে খুব পছন্দ করত। ফরিদী ভাই ‘দিনমজুর’ ছবিতে অভিনয় করছে, সিনেমা খুব হিট। ফরিদী ভাই এফডিসিতে আইল, আমি তারে কোলে তুইলা নিছি। ছবিটা একজন সে সময় তুলছে। এখনো আছে আমার কাছে।”

“আমি অনেক ছবি করছি, কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় আমি একটা ভালো ছবি করমু। কিন্তু কেমন ছবি হইব জানতাম না। হয়তো সৃষ্টিকর্তায় আমার কথা শুনছে। বঙ্গবন্ধুরে নিয়া বায়োপিক বানাইব শুনছিলাম। সব বড় বড় অভিনেতা সুযোগ পাইছে শুনতেছিলাম। তো আমি মধুপুরে গেছিলাম একটা শো করতে আমারে ফোন দিছে, বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে অভিনয় করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয়। আমি সাথে সাথে বাসে চইড়া বসছি। এই ছবিতে আমি মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করছি এইটা আমার জীবনে বড় পাওয়া।”

অভিনয় করা উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র

“দমকা”, “মুসা ভাই”, “দানব সন্তান”, “তুই যদি আমার হইতিরে”, “অঙ্গার”, “গডফাদার”, “মূর্খ মানব”, “সুসম্পর্ক”, “মৃত্যুর মুখে”, “চোখ”, “হিরো দ্য সুপারস্টার”, “বলবো কথা বাসরঘরে”, “ডন বাদশাহ”, “শিবা”, “ঘৃণা”, “ভাগ্য”, “ভালোবাসার রং”, “তালাচাবি”, “পয়সা পয়সা”, “দশ গ্রামের মোড়ল”।

নিরঞ্জনের পরিবার

নিরঞ্জন সরকার বিয়ে করেছেন ১৯৯৬ সালে। বড় ছেলে জয় সরকার ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। ছোট ছেলে রাজ সরকারকে এবার এইচএসসিতে ভর্তি করিয়েছেন। মেয়ে খুশি কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়নের একটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রী নিহার রানি ও মেয়ে খুশিকে নিয়ে মেকাইল গ্রামেই থাকেন নিরঞ্জন। জানালেন দুই ছেলের পড়াশোনা চালান তাদের মামা। মেয়ে তাদের কাছেই থেকে পড়াশোনা করছে।

হাজার ছবিতে অভিনয়েও সচ্ছলতা নেই

নিরঞ্জন এক হাজার ছবিতে অভিনয় করেও কেন বাড়ি–গাড়ি করতে পারেননি। এটা যে কারওরই মনেই প্রশ্ন তৈরি করবে। বিষয়টি খুব সহজ করে দিলেন নিরঞ্জন।

বললেন, “আমাগো মোটা টাকা দেয় না। আমরা চলচ্চিত্রে ফাইটার আছি ১৮০ জনের মতো। শিফট অনুযায়ী আমরা কাজ করি। দিনে দুইটা শিফট। একটা ফিল্মে কাজ করলে দুইটা শিফট বা চাইরটা শিফটে কাজ করি, তারপর শেষ। শিফটে এক হাজার। সারাদিন মিলায়া কাজ করলে দুই হাজার টাকা। আগে শিফটে ৪০০ টাকা ছিল, তারপর হইল ৬০০ টাকা। এখন এক হাজার। কিন্তু সিনেমা খুব কম। তারপর আমাগোরও অনেক অ্যাক্সিডেন্ট হয়। আমার হাত ভাইঙ্গা গ্যাছে, ওপর থেকে পইড়া গেছি। আমাগো ফাইটারের অনেক ঘটনা এমন।”

নিরঞ্জন জানালেন, কিছু টাকা জমিয়েছিলেন, সেই টাকা দিয়ে জুরাইনের দুই কাঠা জমিতে প্রথমে একতলা করেছিলেন, পরে সেটা দোতলা করতে পেরেছেন। ভাড়া দিয়েছেন। একদম গলির ভেতরে ও অনুন্নত জায়গা হওয়ায় খুব বেশি ভাড়া পান না। খরচ শেষে ভাড়া পান ১৫ হাজারের মতো। এখন এটা দিয়েই মূলত সংসার চলে। এর বাইরে তিনি সার্কাস, মঞ্চে কাজ করেন। এভাবেই চলে যায়। গ্রামের বাড়িতে অল্প অল্প করে ইট কিনে কিনে ঘর করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঘর হয়ে ওঠেনি।

নিরঞ্জন বললেন, “এখন তো সিনেমা কম, তাই ঢাকার বাইরে বাইরে স্টেজে কাম করতে যাই, এইভাবে কইরাই এখন জোড়াতালি মিলায়া চলতাছি।”

নিরঞ্জনের আক্ষেপ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন নিরঞ্জনের বাবা নিশিকান্ত সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত শহীদের স্বীকৃতি পাননি। নিরঞ্জন বলেন, “২৫ নভেম্বর হঠাৎ কইরা গ্রামে পাকবাহিনী [পাকিস্তান মেনাবাহিনী] ঢুইকা পড়ে। আমরা পালাইয়া যাই। মা, ভাইবোন, জেঠি মা সবাই মিল্লা লুকায়ে ছিলাম দূরের জমি বাড়িতে। পরদিন বিকালে আমরা গ্রামে আসি। শুনলাম আমার বাবা নিশিকান্তসহ চারজনরে মাইরা ফেলছে। পাশেই তাগোরে মাটি চাপা দিয়া রাখছিল। আমার মায়ে মাটি তুইলা দাহ করছে।”

স্বাধীনতার এত বছর পরেও বাবা শহীদের স্বীকৃতি পাননি এটাই নিরঞ্জনের আক্ষেপের কারণ। সহায়তা কিছুটা পেয়েছিলেন-এমনটাই জানিয়ে নিরঞ্জন বলেন, “স্বাধীনতার পরে প্রথম ৫০ টাকা সহায়তা দেয় আমাগো পরিবাররে। এরপরে ২০০ টাকা। একবার কম্বল পাইছিলাম। পরে আর কেউ আমাগো খোঁজ নেয় না। এলাকার চেয়ারম্যান মেম্বারের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি, আমার বাপে শহীদের মর্যাদা পায় নাই এখনো।”

XS
SM
MD
LG