ভারতের মধ্যপ্রদেশে ভোপালের রাস্তা ধরে বজরং সেনার মিছিলটি ইন্দিরা ভবন অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেসের সদর দফতরের রাস্তা নেওয়ায় পর্যবেক্ষকরা ভেবেছিলেন কর্নাটকে কংগ্রেস বজরং দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার হুঁশিয়ারি দেওয়ার প্রতিবাদে বজরং সেনা বুঝি মধ্যপ্রদেশে প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। কিন্তু পথচলতি জনতাকে অবাক করে দিয়ে সেই মিছিল সোজা ইন্দিরা ভবনের ভিতরে ঢুকে যায়। তাই শুধু নয়, মিছিলের প্রথম সারিতে থাকা নেতাদের গেটে ফুল-মিষ্টি দিয়ে স্বাগত জানান সেখানকার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথ।
পরের ঘটনাবলী আরও চমকপ্রদ। যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে কমলনাথের উপস্থিতিতে বজরং সেনার মধ্যপ্রদেশ ইউনিটের কর্তারা ঘোষণা করেন, আজ থেকে তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে সংগঠনকে মিশিয়ে দিলেন। আর সেই ঘোষণা মাত্র উপস্থিত কংগ্রেস নেতা এবং বজরং সেনার সমর্থকেরা স্লোগান দিলেন ‘জয় শ্রীরাম’, ‘জয় বজরংবলী’। কোনও কংগ্রেস অফিসে কংগ্রেস কর্মীদের মুখে জয় শ্রীরাম স্লোগান এর আগে শোনা গিয়েছে বলে জানা যায়নি।
গত মঙ্গলবার ৬ জুন ভোপালে প্রদেশ কংগ্রেস দফতরের এই ঘটনা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে রাজ্য-রাজনীতিতে। কংগ্রেসের কিছু নেতা আড়ালে দলের সমালোচনা করলেও বেশিরভাগেরাই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি কমলনাথের পক্ষ নিয়ে বলছেন, বিজেপি তাদের হিন্দুদের স্বঘোষিত মুরুব্বি হিসাবে তুলে ধরেছে। কংগ্রেস যে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির বিরোধী নয় সেটা বোঝাতে এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল।
কমলনাথ অবশ্য রাজ্য-রাজনীতিতে বিজেপির থেকেও বড় হিন্দু বলে পরিচিত। তাঁর একটা লোকসভা কেন্দ্র তথা রাজনীতির কর্মভূমি ছিন্দওয়ারাতে নিজের টাকায় বিশাল হমুমান মন্দির ও বজরংবলীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে সেখান আর্থিক হালও বদলে দিয়েছেন। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যান ছিন্দওয়ারার হনুমান মূর্তি ও মন্দির দর্শন করতে। কমলনাথ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর দলে ধর্মচর্চা শাখার আয়োজন করেছেন। সেই শাখার মাথায় সম্প্রতি এক কীর্তনীয়াকে বসিয়েছেন। তিনি রাজ্যের ২৩০টি বিধানসভা এলাকায় কীর্তন পরিবেশন এবং ভাগবত পাঠ করবেন।
ঠিক উল্টো ছবি কর্নাটকে। সেখানে বিধানসভা ভোটের ইস্তাহারে কংগ্রেস রাজ্যে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরির অভিযোগে ইসলামপন্থী পিএফআই এবং কট্টর হিন্দুত্ববাদী জঙ্গি সংগঠন বজরং দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ঘোষণা করে। এই ইস্যুকে সামনে রেখে বিজেপি, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কংগ্রেসকে নিশানা করেন ভোটের প্রচারে। বলেন, শতাব্দী প্রাচীন দলটি আসলে বজরংবলী অর্থাৎ ভগবান হনুমানকে তালাবন্দি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আসলে বজরং দল ভেঙেই তৈরি হয়েছে বজরং সেনা। ১০ বছর আগে তৈরি এই সংগঠনের সঙ্গে বজরং দলের কর্মসূচির কোনও ফারাক নেই। শুধু নেতাদের ইগোর লড়াইয়ে সংগঠনে ভাঙন ধরে। এখন ১২টি রাজ্যে শাখা থাকলেও বজরং সেনা মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কারণ বজরং সেনার জাতীয় সভাপতি রণবীর পাতেরিয়ার ব্যাখ্যা, আমাদের লক্ষ্য হিন্দু ধর্মস্থান, সাধুসন্তদের স্বার্থরক্ষা, গোরক্ষা এবং গোশালা নির্মাণে পুরোহিতদের আর্থিক সাহায্য চালু করা। এই সব ক’টিই মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস রক্ষা করবে বলে কথা দিয়েছে। কমলনাথ এক বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই অনেক প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন। তাই মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের স্বার্থে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি জানান, গত বছর উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে তারা যোগী আদিত্যনাথ, ২০১৯-এ নরেন্দ্র মোদীর হয়ে প্রচার করেছেন। আগামী নভেম্বরে মধ্যপ্রদেশে কমলনাথকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য প্রচার চালাবেন।
প্রসঙ্গত, বজরং দলের মতো বজরং সেনার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসায় যুক্ত থাকার অভিযোগ আছে। মধ্যপ্রদেশেই রামনবমীর মিছিল ঘিরে অশান্তি এবং সংখ্যালঘুদের উপর হামলায় নাম জড়িয়েছে এই সংগঠনের।
মধ্যপ্রদেশে এমন একটি কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে কংগ্রেসের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার আসল কারিগর হলেন দীপক যোশী। গত মে মাসে বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদান করা এই নেতার আসল পরিচয় তিনি কৈলাশ যোশীর পুত্র। কৈলাশ ছিলেন মধ্যপ্রদেশে বিজেপির প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তিনি দল ছেড়েছেন। তবে বজরং সেনার নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, শুধু মধ্যপ্রদেশেই তারা কংগ্রেসের জয় চান। বাকি রাজ্যে বিজেপির সঙ্গেই আছেন আপাতত।