অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশে অনেকের দেহে ওমিক্রনের লক্ষণ, কিন্তু টেস্ট করার আগ্রহ কম


বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কয়েকজন মহিলা মিশন সেভ বাংলাদেশ কর্তৃক বিতরণকৃত খাবারের প্যাকেট সংগ্রহ করে ঘরে ফিরেছেন। (ফাইল ছবি)

শরীরে ওমিক্রনের প্রচ্ছন্ন লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে অনেক মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যাচ্ছেন এক জেলা থেকে অন্য জেলায়। তারা মনে করছেন, এটা সাধারণ সর্দি-জ্বর। শীতের সময় এটা হয়েই থাকে। এ কারণে টেস্টে আগ্রহী নন। টেস্টে গেলে যদি পজেটিভ আসে এই ভয় থেকেই বেশির ভাগ মানুষ টেস্ট করানো থেকে বিরত থাকছে।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন জীবন আহমেদ। সর্দি-জ্বরে ভুগছেন। গলাব্যথাও আছে। টেস্ট করাবেন কি-না জানতে চাইলে বললেন, ভয় কেটে গেছে মানুষের। আমার মনে হয়, তেমন কিছু হবে না। এ কারণে টেস্ট করাচ্ছি না।

মিডিয়াকর্মী আলী ইমরান। কাজ করেন ঢাকার একটি গণমাধ্যমে। তিনদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। টেস্ট করেছেন কি-না জানতে চাইলে বললেন, টেস্ট করে কি হবে? আর তাছাড়া শীতকাল এলে তো এমন জ্বর-সর্দি থাকেই। যদিও এবার একটু অন্যরকম লক্ষণ তবুও দেখা যাক কি হয়।

কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম। তার স্ত্রী টানা পাঁচদিন হলো জ্বরে আক্রান্ত। বললেন, প্যারাসিটামল খাওয়াচ্ছি। শরীরে ব্যথা আছে। টেস্ট করলে শুধু শুধু একটা ঝামেলা। লাইনে দাঁড়ানো। করোনা ধরা পড়লে টেনশন বাড়বে। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।

ভিন্ন কথা বললেন আলি আকবর। মিরপুরে কাপড়ের দোকানি আকবর বললেন- "দুইবার টিকা নিছি। এরপরও প্রথম যখন করোনা হলো ঐরকম এইবারও লক্ষণ দেখতাছি। আর টেস্ট করামু না। আল্লাহ্‌ হায়াত দিলে বাঁচুম।"

কিন্তু দিনদিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। জ্যামিতিকহারে বেড়ে চলেছে ওমিক্রনের সংক্রমণ। গত এক মাসে সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ৪৩ হাজার ৮২৮ জন সংক্রমিত হয়েছেন। সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রায় ৩৪ শতাংশ মানুষের শরীরে ওমিক্রন প্রবেশ করেছে। গত ১১ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রথম ওমিক্রন ধরা পড়ে। জিম্বাবুয়ে ফেরত দুই নারী ক্রিকেটার ওমিক্রন শনাক্ত হন। আক্রান্ত হচ্ছেন মিডিয়াকর্মী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পরিবহনকর্মীসহ সমাজের সব স্তরের মানুষ।

সরকারের তরফে ১১ দফা বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হলেও বাজারহাট, যানবাহনে চলাচল আগের মতোই। মাস্ক দেখা যাচ্ছে কম। এর মধ্যে বাণিজ্যমেলাও চলছে। স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই হোটেল-রেস্তরাঁগুলোতে। গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী বহনের নির্দেশনাও উপেক্ষিত।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সোমবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, "সংক্রমণ উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। আমরা ঢাকায় যে নমুনা পরীক্ষা করেছি, জিনোম সিকোয়েন্স করেছি, তাতে দেখা গেছে ওমিক্রনে আক্রান্ত এখন ৬৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যেটা আগে ছিল ১৩ শতাংশ। আমরা গত ১০ দিনের মধ্যেই এই তথ্য পেয়েছি। আমরা মনে করি- ঢাকার বাইরেও একই হার হবে"।

স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম করোনার এই অব্যাহত ঊর্ধ্বমুখী ধারাকে অশুভ ইঙ্গিত বলে বর্ণনা করেছেন। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, "দেশে ওমিক্রনের সংক্রমণ বাড়লেও এখনো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। করোনা আক্রান্ত রোগীদের জিনোম সিকোয়েন্সিং পরীক্ষায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আক্রান্ত ৮০ শতাংশ। তবে ঢাকায় ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি"। তিনি বলেন, "যারা টিকা নেননি তারাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন"। সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছেন, যেভাবে মানুষজন সংক্রমণ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাতে ওমিক্রন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে না চললে সংক্রমণ ও মৃত্যু ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে সতর্ক করেন তিনি।

এই প্রসঙ্গে ভয়েস অব আমেরিকাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, "জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা গেছে, ওমিক্রন এখন ৬৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখানে নির্দিষ্টভাবে ওমিক্রনের কথা বলেছেন। তাই যদি হয়, তার মানে হলো- ওমিক্রন দ্রুত ছড়াচ্ছে। এটার এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য যেটা তাহলো- ওমিক্রন ৬ গুণ বেশি ছড়াতে পারে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে। সে হিসাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তথ্যমতে যেটা বোঝা যাচ্ছে- বাংলাদেশে ওমিক্রন খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। এখন ওমিক্রন নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষায় বলা যায়, এটা উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয়। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে- এটাতে (ওমিক্রন) ভীত হওয়ার কিছু নেই"।

"বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেফারেন্সে বলবো, আমাদের করণীয়- প্রথমত, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং জনগণ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য হয় সে জন্য তাদেরকে আইনের আওতায় এনে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হবে। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এটা হলো সরকারের কাজ। আর জনগণকেও মানতে হবে"।

তিনি আরও বলেন, "আমাদেরকে মনে রাখতে হবে- করোনা বা ওমিক্রন যেটাই হোক না কেন লক্ষণ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নিতে হবে। দেরি করা চলবে না এবং আমাদের আশ্বস্তের বিষয় এটা, প্রাথমিকভাবে আমরা যদি চিকিৎসা নেই তাহলে মৃত্যু ঝুঁকি কম। সাধারণ জনগণ যাতে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা নিতে পারে সেজন্য বাংলাদেশের সর্বত্র উপজেলা হাসপাতালগুলোকে শক্তিশালী এবং সক্ষম করে তুলতে হবে। আমরা যদি এটা সফলভাবে করতে পারি তাহলে এটার ভয়াবহতা এবং মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো"।

প্রফেসর মোজাহেরুল হক বলেন, "ঘরে ঘরে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়া বা এটার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এখনো পর্যন্ত কিন্তু দেশের সবগুলো জেলাতে যে সংক্রমণের হার তাকে সমর্থন করে না। সুতরাং আমরা এখনো এটাকে কমিউনিটি সংক্রমণ বলবো না। সংক্রমণকে সীমিত রাখার জন্য যা যা পদক্ষেপ নেয়া দরকার সরকারের উচিত আশু সেই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা। তাহলে আমরা কমিউনিটি সংক্রমণ এড়াতে পারবো"।

XS
SM
MD
LG